ফিচার I রাইনস্টোন রোমান্স
পাঁচ হাজার বছর ধরে কনে সাজে অপরিহার্য। রানির প্রসাধন থেকে সাধারণে প্রবেশ। চিরায়তে এবারে রাইনস্টোনের সঙ্গত। ম্যাক্সিমালিজমের চূড়ান্ত!
মিসরীয় সভ্যতায় মেহেদি ছিল রাজকীয় প্রসাধনের অংশ। ক্লিওপেট্রা ও নেফারতিতির মতো রানিরা সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য হাত ও নখে ব্যবহার করতেন। এরপর ছড়িয়ে পড়ে পারস্য, আরব ও আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে। ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মেহেদি ভারতীয় উপমহাদেশে আসে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে। সে সময় নারীরা গরমে শরীর ঠান্ডা রাখতে হাতে-পায়ে এর প্রলেপ দিতেন। ধীরে ধীরে এটি পরিণত হয় বিশেষ সাজসজ্জায়। কনের হাতে মেহেদি আঁকার রীতি শুরু তখনই। এই উপমহাদেশের লোকবিশ্বাসে আছে, কনের হাতে যত গাঢ় হবে মেহেদির রং, দাম্পত্যজীবনে ততই ভালোবাসা আসবে। তবে ২০২৫ সালের কনেরা সেই ঐতিহ্যকে নিয়ে গেছেন নতুন উচ্চতায়। এখন আর শুধু জটিল নকশা নয়; সঙ্গে থাকছে ঝলমলে রাইনস্টোন। এটি এখন বিয়ের সাজের সবচেয়ে আলোচিত ট্রেন্ড। আজকের প্রজন্ম একে রূপ দিয়েছে আধুনিকতায়। মেহেদির নকশার মাঝে ছোট ছোট পাথরের ঝলকানি কনের হাতে এনে দিচ্ছে রূপকথার রানির মতো সাজ।
আগে যেখানে মেহেদিতে নজর কাড়ত জটিল ফুল, পাখি, ময়ূরের নকশা; এখন তাতে যোগ হয়েছে ঝলমলে রাইনস্টোনের আলোকচ্ছটা। এই ক্ষুদ্র পাথরগুলো আলোর প্রতিফলনে মায়াবী ঝিলিক ছড়ায়। মেহেদির রং শুকিয়ে গেলে তার ওপরে সযত্নে বসানো হয় এগুলো। কেউ কেউ মেহেদির মাঝখানে, কেউবা হাতের প্রান্তে সাজান নানা নকশায়। এর ফলে হাতে তৈরি হয় থ্রিডি ইফেক্ট, যা বিয়ের সাজে আনে অন্য রকম আবহ। এখনকার কনে বিয়ের সাজে ঐতিহ্যের পাশাপাশি চান আধুনিকতারও ছোঁয়া। রাইনস্টোন হেনা সেই ভারসাম্যই তৈরি করে নিখুঁতভাবে।
বর্তমান সময়ে বিয়ের ছবি ও ভিডিওর গুরুত্ব ব্যাপক। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। রাইনস্টোন হেনা ক্যামেরার ফ্ল্যাশে এমনভাবে ঝলমল করে ওঠে, ফলে কনের হাত-পা জুড়ে আলাদা এক আভা ছড়ায়। ছবিতে বা ভিডিওতে এর প্রতিফলন কনেকে করে তোলে আরও উজ্জ্বল।
আগের প্রজন্মে মেহেদির নকশা ছিল প্রায় একই রকম, খানিকটা একঘেয়ে; কিন্তু আজকের কনে চান কিছুটা আলাদা হতে, নিজের মতো করে সাজতে। রাইনস্টোনের মাধ্যমে তিনি নিজের স্টাইল, পছন্দ ও রুচি প্রকাশ করতে পারেন। কেউ বেছে নিচ্ছেন মিনিমাল ডিজাইন, কেউ আবার হাতজুড়ে ঝলমলে পাথরের সজ্জা। রাইনস্টোন হেনা হাতে রাজকীয় সাজের ছোঁয়া এনে দেয়। কনের পোশাক, গয়না ও মেকআপের সঙ্গে যখন এর ঝিলিক মিলে যায়, তখন পুরো লুক হয়ে ওঠে সিনেমাটিক। রাইনস্টোন হেনার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য, এটি সম্পূর্ণ কাস্টম ডিজাইনযোগ্য। ডিজাইনাররা মেহেদির প্যাটার্ন অনুযায়ী পাথরের রং, আকার ও বসানোর জায়গা বেছে দেন। কেউ সোনালি বা রোজগোল্ড রাইনস্টোন নিচ্ছেন, কেউবা নীল বা লাল, কনের পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে। এতে প্রতিটি ডিজাইন হয়ে ওঠে অনন্য। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক বা পিন্টারেস্টে তাই রাইনস্টোন হেনার ছবি ভাইরাল। কনেরা তাদের সাজের ছবি পোস্ট করে প্রশংসা পাচ্ছেন, ফলোয়ার বাড়ছে, আবার অনেকে একে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট হিসেবে গ্রহণ করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ার এই প্রভাবেও রাইনস্টোন হেনা হয়ে উঠেছে আলোচিত ও আকাঙ্ক্ষিত ট্রেন্ড।
মোটিফ ম্যাজিক
মান্ডালা
২০২৫ সালের অন্যতম জনপ্রিয় রাইনস্টোন হেনা প্যাটার্ন হলো মান্ডালা ডিজাইন। কনের হাতের ঠিক মাঝখানে একটি বড় গোল মান্ডালা আঁকা হয়; যার চারপাশে থাকে সূক্ষ্ম ফুল, লতাপাতা ও জ্যামিতিক রেখাচিত্র। এই ডিজাইনের বিশেষত্ব, মান্ডালার কেন্দ্র বা প্রান্তে ছোট ছোট রাইনস্টোন বসানো হয়।
ফ্লোরাল নেট
আরেকটি জনপ্রিয় প্যাটার্ন। এতে মেহেদির নকশা ফুল, লতা ও পাতার মাধ্যমে তৈরি হয়; আর মাঝখানে বা প্রান্তে জাল বা নেট ডিজাইনের সূক্ষ্ম কাজ থাকে। রাইনস্টোন বসানো হয় সেই জালের সংযোগ বিন্দুগুলোতে।
জিওম্যাট্রিক
যারা মিনিমাল বা আধুনিক ধাঁচের কিছু চান, তাদের জন্য চলতি ট্রেন্ড হলো জ্যামিতিক রাইনস্টোন হেনা। এখানে ব্যবহৃত হয় সরলরেখা, ত্রিভুজ, ডায়মন্ড বা গ্রিড প্যাটার্ন। ডিজাইনের নির্দিষ্ট অংশে ছোট পাথর বসিয়ে দেওয়া হয়, যা নকশাটিকে একধরনের লাইট অ্যান্ড শ্যাডো ইফেক্ট দেয়। এ ধরনের ডিজাইন বিশেষত শহুরে কনেরা বেশি পছন্দ করেন।
ফিঙ্গার সেনট্রিক
বর্তমানে অনেক কনে এমন ডিজাইন বেছে নিচ্ছেন, যেখানে পুরো হাত নয়; বরং শুধু আঙুল বা কবজি পর্যন্ত নকশা করা হয়। আঙুলের গাঁট থেকে কবজি পর্যন্ত সরু রেখা বা ফুলেল প্যাটার্ন এঁকে মাঝে মাঝে বসানো হয় রাইনস্টোন। এই সূক্ষ্ম ও লাইট ডিজাইন দেখতে যেমন এলিগেন্ট, তেমনি হাতে পরা গয়নার সঙ্গে দারুণ মানানসই।
অ্যাসিমেট্রিক
২০২৫ সালে আরেকটি আলোচিত ট্রেন্ড হলো অ্যাসিমেট্রিক রাইনস্টোন হেনা। দুই হাতের নকশা একই রকম নয়; এক হাতে বেশি ঘন, অন্য হাতে তুলনামূলক হালকা। কোথাও রাইনস্টোনের ঘনত্ব বেশি, কোথাও একেবারে কম। এই অসম ভারসাম্যই ডিজাইনটিকে আধুনিকতার নতুন মাত্রা দিয়েছে।
থ্রিডি ও হাইলাইটেড ইফেক্ট
এখন অনেক ডিজাইনার রাইনস্টোন ব্যবহার করছেন থ্রিডি লুক আনতে। মেহেদির নির্দিষ্ট অংশকে সামান্য উঁচু করে, তার ওপর রাইনস্টোন বসানো হয়, যাতে আলো পড়লে একধরনের থ্রিডি ইফেক্ট দেখা যায়। এতে হাতের ডিজাইন জীবন্ত মনে হয়।
স্ক্যাটার্ড স্টোন
এই ডিজাইন চলতি মৌসুমে ব্যাপক জনপ্রিয়। পুরো নকশার মধ্যে সমানভাবে পাথর না বসিয়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছোট রাইনস্টোন দেওয়া হয়। এতে পুরো হাতে একধরনের আলোঝলমল ভাব তৈরি হয়। এটি বিশেষ করে রাতের অনুষ্ঠানে দারুণ লাগে।
পার্সোনালাইজড ডিজাইন
সবশেষে এসেছে ফিউজড ও পার্সোনালাইজড ডিজাইনের ট্রেন্ড, যেখানে কনে পছন্দমতো থিম বেছে নেন। কেউ গ্রহণ করেন ফুলেল থিমের সঙ্গে তারা বা চাঁদের প্রতীক; কেউবা নিজের নাম, বরের নাম বা বিয়ের তারিখ যুক্ত করেন।
কর্মযজ্ঞ
প্রথমে প্রচলিত নিয়মে মেহেদি আঁকা হয়। শুকিয়ে গেলে ডিজাইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশে ত্বকের উপযোগী নিরাপদ আঠা দিয়ে বসানো হয় রাইনস্টোন। ফুলের মাঝখানে, পেইসলির কেন্দ্রে কিংবা পাতলা লেস ডিজাইনের ধারে ছোট পাথরের ঝলকানি নকশাকে করে তোলে দৃষ্টিনন্দন। অনেকে মেহেদি নাইট অনুষ্ঠানে কাঁচা মেহেদির ওপরেও বসান রাইনস্টোন; যাতে ফটোসেশনে মেহেদির সাজ আরও সুন্দর দেখায়। রাইনস্টোন হেনা দীর্ঘস্থায়ী করতে কিছু সতর্কতা জরুরি। প্রথম দিন পানি এড়িয়ে চলা ভালো। খোঁচাখুঁচি করা বা চুলকানো থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। পাথর খুলতে হলে বেবি অয়েল বা মেকআপ রিমুভার ব্যবহার নিরাপদ। আর মেহেদির রং গাঢ় করতে চাইলে পাথর লাগানোর আগে লেবু-চিনির মিশ্রণ ব্যবহার করা যায়।
অন্তর্জালে পাওয়া ভবিষ্যদ্বাণী বলছে, আগামী দিনে শুধু রাইনস্টোন নয়; মুক্তা, ক্রিস্টাল আর মেটালিক স্টোনও দেখা যাবে কনের মেহেদিতে।
উম্মে হানি
মডেল: বনি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: সাফিয়া সাথী
জুয়েলারি: রঙবতী
ছবি: কৌশিক ইকবাল
