এডিটর’স কলাম I উদ্যাপনে সচেতনতা
কোনো উদ্যাপনই নিশ্চয় কারও জন্য ক্ষতিকর হওয়া উচিত নয়। অন্যথায়, সেটির তাৎপর্য আর উদ্যাপন থাকে না; পরিণত হয় হত্যাযজ্ঞে
সময়ের ঘড়ি কখনো থেমে থাকে না, জানা কথা। প্রতিটি মুহূর্তই ক্রমাগত হাজির করে পরের মুহূর্তকে। ফলে আগেরটি জমা পড়ে অতীতে, খরচের খাতায়। পৃথিবীতে জীবন এভাবেই নিরন্তর বহমান। তা আমরা বেশির ভাগ সময় হয়তো বিশেষভাবে টের পাই না কিংবা খেয়াল করি না। তবু নিরবধি বয়ে চলা সময়কে নিজেদের সুবিধার্থে নানা ভাগে ভাগ করে নিই। সেই ধারণা থেকে ক্যালেন্ডারের আবির্ভাব। গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের হিসাব ধরে, জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে যাত্রা শুরু যে নতুন বছরের, তার সমাপ্তি ঘটে ডিসেম্বরের ৩১-এ। ঘণ্টার হিসাবে রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে। এই শেষ ক্ষণগুলো থার্টি ফার্স্ট নামে পরিচিত, যা দুনিয়াজুড়ে উচ্ছ্বাসমুখর উৎসবের উপলক্ষ। কাউন্টডাউন করে, পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে, নতুন বছর বরণ করে নেওয়া। এমন উদ্যাপনে সব পর্যায়ের মানুষই কম-বেশি অংশ নেয়। বিশেষত শহর ও নগরগুলোতে আকাশজুড়ে আতশবাজির আওয়াজ আর চোখধাঁধানো ঝলক মাত করে রাখে। পুরোনো বছরের তথা জীবনের অতীত ক্লেদ থেকে বেরিয়ে, নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন বোনার উচ্ছ্বাসের এমন বাঁধভাঙা উদ্যাপন ঘিরে হয়তো কারও তেমন অভিযোগ থাকার কথা নয়। তবু কথা আছে!
দুই
নববর্ষ উদ্যাপনের ইতিহাস বেশ পুরোনো। দূর অতীতে চোখ রেখে জানা যায়, এ ধারণার উৎপত্তি চার হাজারের বেশি বছর আগে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়া সভ্যতার ব্যাবিলনীয় অধিবাসীরা মার্চ মাসের শেষ দিকে নতুন চাঁদ ওঠাকে নতুন বছরের সূত্রপাত গণ্য করে উদ্যাপন করতেন। চান্দ্রবর্ষ ঘিরে আবর্তিত ‘আকিতু’ নামে পরিচিত সেই উৎসবের প্রবর্তন ঘটে ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে। তাতে ধর্মীয় ও পৌরাণিক বিশ্বাসগুলোর সম্মিলন ঘটত। প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যে চান্দ্রবর্ষনির্ভর সেই উদ্যাপনের ক্ষণ সৌরবর্ষে পুনর্নির্ধারণ করা হয়। সৌর ক্যালেন্ডারের সূচনা ও সমাপ্তি মাসেরও অদলবদল ঘটেছে বারকয়েক। অবশেষে জানুয়ারি থেকে শুরু আর ডিসেম্বরে শেষ—বর্তমান এই ক্যালেন্ডারের যখন সূত্রপাত ঘটে, প্রাচীন রোমানরা তখন থেকে পয়লা জানুয়ারিকে নববর্ষ ধরে এই উদ্যাপন করতে থাকে। দেশ ও সংস্কৃতিভেদে নিজস্ব নববর্ষ (যেমন বাংলা নববর্ষ) উদ্যাপনের চল থাকলেও ইংরেজি নববর্ষ উদ্যাপনের সার্বিক সেই রেওয়াজ এখনো চলমান। ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১ জানুয়ারি ভোর পর্যন্ত পুরো রাত দুনিয়াজুড়ে থার্টি ফার্স্ট তথা নিউ ইয়ার’স ইভ উদ্যাপনে মত্ত হয় মানুষ।
তিন
ঘরোয়া পরিবেশে নির্ঝঞ্ঝাট আয়োজন থেকে শুরু করে কোনো হলরুম বা খোলা জায়গায় বিপুল জনসমাগমের মিলনমেলা—নানাভাবে উদ্যাপন করা হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। চলে রংবেরঙের আলোর বিচ্ছুরণ, কান ফাটানো আওয়াজে আতশবাজি ও সংগীতের বিস্ফোরণ…কত কিছু! বৈশ্বিকভাবে বিশেষ উৎসব বলে তা যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, বলা বাহুল্য। কিন্তু তাতেই বিপত্তি ঘটে। বিশেষত আবাসিক এলাকায় এ ধরনের মাত্রা ছাড়ানো উদ্যাপনের প্রভাব হতে পারে মারাত্মক হানিকর। হয়ে থাকেও। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, মাত্রাতিরিক্ত আতশবাজি ফোটানোর কারণে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির মৃত্যুর খবর বহুবারই জেনেছি আমরা। শুধু তা-ই নয়; বিশেষত শিশু, বৃদ্ধ ও রোগীরা এমন চোখধাঁধানো আলো আর কানে তালা লাগানো আওয়াজের কারণে ভয়ানক বিপদগ্রস্ত হন। এমনকি কেউ কেউ প্রাণও হারায়, যা কাম্য নয়। কোনো উদ্যাপনই নিশ্চয় কারও জন্য ক্ষতিকর হওয়া উচিত নয়। অন্যথায়, সেটির তাৎপর্য আর উদ্যাপন থাকে না; পরিণত হয় হত্যাযজ্ঞে।
চার
‘আমাদের সময়ের মানুষ উদ্যাপনের শক্তি হারিয়ে ফেলছে। উদ্যাপনের বদলে আমরা বরং আমোদ বা বিনোদন পাওয়ার উপায় খুঁজি। অথচ উদ্যাপন মানে হলো সক্রিয় থাকার একটি অবস্থা; শ্রদ্ধা বা প্রশংসা প্রকাশের একটি কার্যকলাপ। অন্যদিকে, বিনোদিত হওয়া মানে নিষ্ক্রিয় থাকার একটি অবস্থা; কোনো আমুদে কার্যকলাপ কিংবা জমকালো প্রদর্শনীর মাধ্যমে পুলকবোধ গ্রহণের প্রয়াস।…উদ্যাপন মানে হলো কারও কর্মকাণ্ডের সর্বোৎকৃষ্ট তাৎপর্যগুলোর মুখোমুখি হওয়া এবং সেগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করা,’ লিখেছেন পোলিশ-আমেরিকান দার্শনিক আব্রাহাম জশুয়া হেশেল, তার ‘দ্য উইজডম অব হেশেল’ গ্রন্থে। উদ্যাপনের প্রকৃত মর্মার্থ উপলব্ধি করতে জানলে তা সবার জন্যই প্রাণোচ্ছ্বাসের তুমুল প্রবাহ বয়ে আনে।
পাঁচ
আনন্দের উপলক্ষ শোকে রূপ নেওয়া কারও কাম্য নয়। আবার, ব্যক্তিজীবনে নানা কারণে মানুষ ছোট-বড় নানা চাপে পিষ্ট থাকে; যা থেকে স্বস্তি এনে দেয় উৎসব। তাই তা উদ্যাপনকে নিরুৎসাহিত করাও কাজের কথা নয়। তবে উৎসব উদ্যাপন হওয়া চাই সকলের জন্যই হিতকর।
সবার মনে সচেতনতাবোধ সক্রিয় থাকুক। শুভকামনা।
