সালতামামি ২০২৫ I সোশ্যাল মিডিয়ায় ফুড ম্যাডনেস
সোশ্যাল মিডিয়া আজকের বিশ্বে শুধু যোগাযোগের নয়; খাদ্যসংস্কৃতিরও শক্তিশালী আয়না হয়ে উঠেছে। চলতি বছরে তা প্রবলভাবে টের পাওয়া গেছে
ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব—এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে শুধু রেসিপি শেয়ার হয় না; বরং নতুন, দৃষ্টিনন্দন ও অভিনব খাবারের ধারণাগুলো ভাইরাল হয়ে ওঠে। আলোকপাত করা যাক এমন কিছু উদ্ভাবনী ফুড‑ট্রেন্ডের ওপর, যেগুলো বছরজুড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সাড়া ফেলেছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ও খাদ্যসংস্কৃতি
প্রথমে বোঝা দরকার, কেন সোশ্যাল মিডিয়া খাবারের ট্রেন্ড তৈরিতে এত শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। একটি কারণ হলো ভিজ্যুয়াল অ্যাপিল। ‘ফুডপর্ন’ হ্যাশট্যাগের জনপ্রিয়তা তারই প্রতিফলন। মানুষ শুধু খেতে চায় না; দেখতে, অনুপ্রাণিত হতে এবং কনটেন্ট তৈরি করতেও আগ্রহী। গবেষণা দেখিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় খাদ্য এমন এক মাধ্যম, যা ব্যবহারকারীদের আবেগ, পরিচয় ও শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশের সুযোগ দেয়। তা ছাড়া এই প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের খাদ্য গ্রহণকে পারফরম্যান্সের মতো করে তুলেছে। রান্না আরেকটি শিল্পকলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি পদ শুধু খাওয়া নয়, প্রদর্শনও করার বিষয়। এই পরিবর্তন শুধু ব্যাঙ্কেট স্মৃতি তৈরি করে না; গ্লোবাল ফুড ট্রেন্ডকে ত্বরান্বিতও করে।
উদ্ভাবনী ও ভাইরাল ফুড
কিছু খাবার ও পানীয়ের ট্রেন্ড আছে, যেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ২০২৫ সাল জুড়ে রীতিমতো ভাইরাল।
প্রোপিসাস ম্যাঙ্গো আইসক্রিম
চীনা এই আইসক্রিম দেখতে আমের মতো। বাইরের কোটিং হালকা সাদা চকলেটের; ভেতরে ক্রিমি এবং মোল্ডের মতো টেক্সচার। নকশার কারণে ভাইরাল হলেও এটি শুধু শোভাময় নয়; এর চাহিদা এত বেশি যে চেখে দেখার জন্য নাগাল পাওয়া দুষ্কর!
টুম্বা শিন রামেন
দক্ষিণ কোরিয়ান কোম্পানি নংশিম এ বছর রামেনের এই নতুন ফ্লেভার বাজারে আনে। শিন রামেন এমনিতে সে দেশে আগে থেকে জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট নুডলস স্যুপ, যা মসলাদার ও সুস্বাদু স্বাদের জন্য খ্যাত। এর স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজে নুডলস, মসলার গুঁড়া আর সবজির ফ্লেক্স থাকে। টুম্বা শিন রামেন সেটিরই একটি পরিমার্জিত রূপ, যেখানে আধুনিক ট্রেন্ডের প্রতিফলন ঘটানো হয়েছে। এতে রয়েছে হুইপড ক্রিম, চেডার ও পারমেসান চিজ এবং শীর্ষে গার্লিকের মতো অপুলেন্সসহ মাশরুম। এই ট্রেন্ড মূলত সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয়, যেখানে মানুষ রামেনে দুধ, পনির, বেকন, শ্রিম্প ও অন্যান্য অতিরিক্ত উপকরণ মিশিয়ে রান্নার ভিডিও শেয়ার করত। সেই ধারার জনপ্রিয়তা শেষ পর্যন্ত কোম্পানিটিকে নতুন অফিশিয়াল ফ্লেভার তৈরিতে অনুপ্রাণিত করে।
দুবাই চকলেট বার
জনপ্রিয় এই ডেজার্ট দুবাই কুনাফা চকলেট বার নামেও পরিচিত। এর বাইরের অংশ গাঢ় বা দুধ চকলেট দিয়ে তৈরি এবং ভেতরে ক্রিস্পি কুনাফে, কদাইফি (ক্ষুদ্র সিল্কি ফিলো প্যাস্ট্রি), পিস্তাচিও-তাহিনি ক্রিম ও পেস্তাবাদামের ক্রিম থাকে। এটি প্রথমে ছিল একটি লাক্সারি উদ্যোগ; তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ করে টিকটকে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় বিশ্বজুড়ে বহু ভেন্ডর এই আইডিয়া অনুকরণ করেছে।
অনিয়ন বয়েল
একটি বড় পেঁয়াজকে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল দিয়ে মুড়িয়ে, মাখন, মসলা ও অন্যান্য উপকরণ যোগে রান্না করার বিশেষ এক রেসিপি এটি। তৈরি করা সহজ এবং সুস্বাদু এই পদ সাধারণত সাইড ডিশ হিসেবে পরিবেশন করা হয়, তবে মূল খাবার হিসেবেও উপভোগ সম্ভব। মিমি বারেটেলা নামে একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর একটি ভিডিও শেয়ার করেছিলেন, যেখানে তিনি দুটি কেন্দ্রীকৃত সাদা পেঁয়াজে তেল, সিজনিং ও মার্জারিন ব্যবহার করে এয়ার-ফ্রায়ারে রান্না করেছেন। এর ফলে পেঁয়াজের স্তরগুলো নরম হয়ে যায় এবং বাইরের তেল ও মাখন মিশ্রণ ভেতরের স্বাদের গভীরতা বাড়ায়। তারপর এটি ভেঙে, সেই স্তরগুলো ডিপ করে খাওয়া হয়। খাবারটি ভিজ্যুয়ালি আকর্ষণীয়।
স্লিপি গার্ল মকটেল
এই ট্রেন্ডিং পানীয় ঘুমের সহায়ক হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টার্ট চেরির রস, ম্যাগনেশিয়াম পাউডার এবং একটি প্রোবায়োটিক স্পার্কলিং পানীয় বা সোডা ওয়াটার মিশিয়ে তৈরি। সাধারণত ঘুমানোর দু-এক ঘণ্টা আগে বরফ যোগে উপভোগ করা হয়। এই মিশ্রণে থাকা টার্ট চেরির রসে মেলানটোনিন থাকে, যা ঘুমের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক। পানীয়ের দুনিয়াতেও সোশ্যাল মিডিয়া বেশ কিছু চাইল্ড‑ফ্রেন্ডলি এবং ফাংশনাল ট্রেন্ড তৈরি করেছে। এটি তারই নমুনা।
টার্কিশ পাস্তা
এই পাস্তা সাধারণত তৈরি করা হয় মসলাযুক্ত গরুর মাংস, দই যোগে গ্রিল করা পেপরিকা বাটার এবং সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহৃত কিছু গার্লিক দিয়ে। সহজে তৈরিযোগ্য, প্রোটিন-সমৃদ্ধ এবং ভিজ্যুয়াল ফুড দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ উপযোগী।
সুশি কাপস
সুশির জনপ্রিয় রূপ, যেখানে সুশিকে রোল না করে ছোট ছোট কাপের আকারে তৈরি করা হয়। সাধারণত মাফিন টিনে নোরি (শৈবালবিশেষ), চাল এবং চিংড়ি বা কাঁকড়ার মতো বিভিন্ন পুর দিয়ে বেক করে তৈরি করা হয়, যা বেশ সুস্বাদু। সাধারণ সুশির ধারণাকে পুরোপুরি নতুন রূপ দিয়েছে সুশি কাপস। ব্যবহারকারী নিজস্ব ট্রপিক্যাল বা ক্ল্যাসিক টপিংস দিয়ে কাস্টমাইজ করতে পারেন।
মোজাইক স্যালাদ
ফল, সবজি, পনির প্রভৃতি বিভিন্ন ধরন ও রঙের উপকরণ ছোট ছোট কিউব আকারে কেটে, সুন্দর মোজাইকের মতো সাজানো হয় এই স্যালাদ। সাজানোর সময় অলিভ অয়েল, ভিনেগার বা অন্য কোনো ড্রেসিং ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন রং ও ধরনের ফল ও সবজি টুকরা টুকরা করে সাজানো হয় বলে একটি মিউজিক্যাল বা আর্টওয়ার্ক তৈরি হয়। এটি শুধু পুষ্টিকরই নয়; ফুড-আর্ট হিসেবেও আকর্ষণীয়।
পাস্তা চিপস
ক্রাঞ্চি কার্বসের ধারণাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে এটি। মূলত সেদ্ধ পাস্তা কেটে, ওভেনে বা ফ্রায়ারে ক্রিস্পি চিপসে রূপান্তর করা হয়।
ট্রেন্ডের প্রভাব ও সামাজিক বিশ্লেষণ
এসব ট্রেন্ড শুধু স্বাদের পরিবর্তনই আনেনি; সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। ডিজিটাল মাধ্যমে টার্কিশ পাস্তা বা দুবাই চকলেটের মতো ফিউশন ফুড দ্রুত গ্লোবাল হয়ে উঠেছে। এ ধরনের ট্রেন্ডে বিভিন্ন সংস্কৃতির খাবারের একে অপরকে প্রভাবিত করার প্রবণতা রয়েছে।
ভিজ্যুয়াল পারফরম্যান্স ও খাদ্য অভিজ্ঞতা
অনেক ট্রেন্ড যেমন সুশি কাপস, মোজাইক স্যালাদ ইত্যাদি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, এগুলো স্বয়ং ভিজ্যুয়াল ক্যানভাস হিসেবে কাজ করছে। এ ধরনের খাবার ব্যবহারকারীদের জন্য শুধু খাওয়ার অভিজ্ঞতা নয়; বরং পারফর্ম করার মাধ্যমেও পরিণত হয়।
সতর্কতা ও বিপর্যয়ের শঙ্কা
ভাইরাল ট্রেন্ড সব সময় ইতিবাচক না-ও হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে আসা ফুড ট্রেন্ড অনেক সময় পুষ্টিগুণের দৃষ্টিকোণ থেকে যাচাই করা হয় না। কিছু বিশ্লেষণকারী সতর্ক করছেন, ভাইরাল রেসিপি বা নতুন উপকরণ কখনো কখনো স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর হতে পারে।
বাজার ও অর্থনৈতিক প্রভাব
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল খাবার শুধু রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ থাকে না; বাজারকেও প্রভাবিত করে। যেমন দুবাই চকলেটের জনপ্রিয়তা পিস্তাচিওর চাহিদা বাড়িয়ে দিয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব শুধু ডিজিটাল স্পেসেই সীমাবদ্ধ নেই; এটি আজকাল খাদ্যসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। ভাইরাল ট্রেন্ড যেমন প্রাণ উজাড় করে দেয়, নতুন স্বাদের দরজা করে উন্মুক্ত এবং খাদ্যকে এক পারফরমেটিভ শিল্পে রূপান্তর করে, তেমনই এগুলোর পুষ্টি, অস্থায়িত্ব এবং ঝুঁকি মূল্যায়ন করার গুরুত্ব কিছু চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসে। তবে এই উদ্ভাবনী ফুড ট্রেন্ডগুলো আমাদের দেখায়, খাদ্য এখন উদরপূর্তির পাশাপাশি এমন একটি সামাজিক, শিল্পগত ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা, যা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে আমরা সবার সঙ্গে ভাগাভাগি, উদ্যাপন ও পর্যবেক্ষণ করতে পারি।
ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সংগ্রহ
