skip to Main Content

সঙ্গানুষঙ্গ I অতিরঞ্জনের গুঞ্জন

গয়না। যুগ যুগ ধরে নারীর আত্মপ্রকাশের চমকপ্রদ মাধ্যম। কখনো ছিল ঐতিহ্যের প্রতীক, কখনো ভালোবাসার স্মারক; আজকের দিনে এটি পরিণত হয়েছে দাপুটে স্টাইল স্টেটমেন্টে

ফ্যাশনের ইতিহাসে প্রতিটি যুগেই গয়না নিজের অবস্থান বদলেছে; কিন্তু ২০২৫ সালের শরৎ-শীতকাল যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে—‘অ্যাকসেস জুয়েলারি’, অর্থাৎ অতিরিক্ত গয়নার ট্রেন্ড দিয়ে।
কমই বেশি থেকে বেশিই সুন্দর
কয়েক বছর আগেও মিনিমালিস্ট স্টাইলের ছিল রাজত্ব। পাতলা চেইন, ছোট দুল ও সূক্ষ্ম আংটিতে সীমাবদ্ধ ছিল ফ্যাশনের সংজ্ঞা। এখন সেখানে দাপট দেখাচ্ছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারা। বড়, ভারী, স্তরে স্তরে সাজানো নেকলেস, একাধিক আংটি, বিভিন্ন দৈর্ঘ্যরে ব্রেসলেট, এমনকি দুই কানে অসমান দুল—সব মিলিয়ে শরীরজুড়ে যেন এক চমৎকার গয়নার উৎসব! এই অ্যাকসেস জুয়েলারি ট্রেন্ড আসলে এক আত্মবিশ্বাসী ফ্যাশন দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ।
প্রাদা, সেন্ট লরেন ও মিউ মিউর মতো ব্র্যান্ডগুলো এই ভাবনাকে রানওয়েতে রূপ দিয়েছে দৃষ্টিনন্দন নাটকীয়তায়। প্রাদার ফেব্রুয়ারি শোতে দেখা গেছে ঝুলন্ত পিন ও রত্নখচিত নিট কলার, যা পোশাক ও অলংকারের সীমারেখা মুছে দিয়েছে। অন্যদিকে সেন্ট লরেনের উপস্থাপনায় ছিল সাহসী নকশা। যেমন টেক্সচারড মেটাল ইয়াররিং, যা ব্যাগের মতোই স্টেটমেন্ট পিসে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোভিড-পরবর্তী সময়ে যখন মানুষ জীবনের প্রতিটি দিকেই স্বাধীনতা ও আত্মপ্রকাশের নতুন সংজ্ঞা খুঁজছে, সেই মানসিক ঢেউ ফ্যাশনেও ছড়িয়ে পড়েছে। লন্ডন বেসড জুয়েলারি ব্র্যান্ড মিসোমা, লোরা ভ্যান, আলিগিয়েরির মতো ব্র্যান্ডগুলো তাদের সাম্প্রতিক সংগ্রহে সেই ম্যাক্সিমালিজমের মেজাজকে উজ্জ্বলভাবে ফুটিয়ে তুলেছে মিশ্র ধাতু, ওভারল্যাপিং চেইন আর আর্ট-ডেকো প্রেরণায় তৈরি জেমস্টোন পিসের মাধ্যমে। ফলাফল? গয়না আর শুধু পরিপূরক নয়; এটি এখন ব্যক্তিত্বের ঘোষণা। মানুষ চায় নিজেকে দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করতে, আর গয়না তার চমৎকার শিল্পিত ও উজ্জ্বল মাধ্যম।
রানওয়ে রিদম
২০২৫ সালের অটাম-উইন্টার র‌্যাম্প যেন পরিণত হয়েছে চলমান জুয়েলারি গ্যালারিতে। সেন্ট লরেন থেকে প্রাদা, প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ডগুলো গয়নাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা, যেখানে অলংকার শুধু সাজ নয়; বরং পোশাকের সম্প্রসারিত ভাষাও। প্রাদা ওয়্যারেবল এস্টাবলিশমেন্টের ধারণাকে আরও সমসাময়িক করে তুলেছে। অন্যদিকে মিউ মিউর স্তরে স্তরে সাজানো ব্রোচ ও ইয়ারপিসগুলো যেন পুরোনো ফ্লি-মার্কেটের সংগ্রহকে আধুনিক ফ্যাশনের ছোঁয়ায় নতুন জীবন দিয়েছে। অন্য প্রান্তে, আলিগিয়েরির গোলাকার, এক্সপেরিমেন্টাল ইয়ারপিসগুলোও যেন একই বার্তা দিয়েছে—ফ্যাশনে এখন সাহসই আসল অলংকার।
পুরোনো-নতুনের মেলবন্ধন
অ্যাকসেস জুয়েলারি ট্রেন্ডের অন্যতম আকর্ষণ হলো পুরোনো ও নতুনের নিখুঁত মেলবন্ধন। আজকের গয়না কেবল ঝকঝকে সোনার নয়; বরং সোনার উষ্ণতা, রুপার শীতল দীপ্তি আর রেডিয়ামের ধাতব উজ্জ্বলতা মিলিয়ে তৈরি করছে সাহসী ও ব্যতিক্রমী নান্দনিকতা। একই নকশায় স্বর্ণ ও রুপার মিশ্রণ—আগের একরঙা জুয়েলারির ধারণাকে ভেঙে দেওয়া এই নতুন ধারার দেখা মিলছে মিসোমা ও লোরা ভ্যানের সাম্প্রতিক কালেকশনগুলোতে। অনেকে এক হাতে পরছেন গোল্ড ব্যাঙ্গেল, অন্য হাতে সিলভার কাফ কিংবা একই গলায় মিশিয়ে নিচ্ছেন বিভিন্ন ধাতুর চেইন—এই বৈপরীত্যই হয়ে উঠেছে নতুন যুগের স্টাইল স্টেটমেন্ট।
অন্যদিকে, লিবার্টি লন্ডনের ডিজাইনগুলো ফিরিয়ে এনেছে অ্যান্টিক অ্যালকেমির মোহ, যেখানে নিখুঁত পালিশ নয়; বরং সময়ের ছাপই হয়ে উঠেছে সৌন্দর্যের পরিচায়ক। অসমান পাথর, অ্যান্টিক টেক্সচার আর প্রাচীন ধাতব প্যাটিনা তৈরি করছে একরকম অপূর্ণতার শিল্প, যা একই সঙ্গে নস্টালজিক ও আধুনিক। এই পুরোনো-নতুনের মেলবন্ধন আজকের গয়নার মূল দর্শন হলো পারফেক্ট ইমপারফেকশন, যেখানে প্রতিটি খুঁতই আলাদা চরিত্রের প্রতীক।
রঙে-রত্নে উষ্ণতা
এই মৌসুমে গয়নায় উষ্ণ ও প্রাকৃতিক রঙের জয়জয়কার। টারকোয়েজ, টাইগার’স আই, স্মোকি কোয়ার্টজ ও অ্যাম্বার—এসব টোন চোখে এনে দিচ্ছে প্রশান্তি; মনে জাগাচ্ছে নীরব স্থিরতা। লন্ডনের পারায়া জুয়েলারি ব্র্যান্ডের ডিজাইনার সোফি হাওয়ার্ড বলছেন, ‘জুয়েলারি এখন আর শুধু অলংকার নয়; এটি পরিধানকারীর মেজাজ ও অনুভূতির প্রকাশও।’ তার মতে, স্মোকি কোয়ার্টজ বা শ্যাম্পেন ডায়মন্ডের মৃদু ঝলক গয়নাকে দিচ্ছে আধুনিকতা ও স্মৃতিকাতরতার সংমিশ্রিত এক সূক্ষ্ম বিলাসিতা।
আঙুলে আঙুলে গল্প
আগে যেখানে এক-দুটি আংটি পরাই যথেষ্ট ছিল, এখন সেখানে ইক্লেকটিক হ্যান্ডস্ক্রেপিং ট্রেন্ডে একাধিক আঙুল যেন ক্যানভাস হয়ে উঠছে। বোটেগা ভেনেটা, শ্যানেল, গুচি প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ব্র্যান্ড এবার খেলছে নানা মেটাল ও টেক্সচারের মিশেলে। গোল্ড, সিলভার, রোজ গোল্ড—সব একসঙ্গে পরা হচ্ছে একটি বোন্ড স্টেটমেন্ট হিসেবে। বড় জিওমেট্রিক রিংয়ের পাশে ভিনটেজ ইনস্পায়ার্ড আংটি কিংবা বোল্ড কাফের সঙ্গে কোমল পাথরের রিং—এমন কনট্রাস্টই এখন স্টাইলের ভাষা। এখানে রীতিবদ্ধতা নয়, বরং স্বাধীনতাই নিয়ম। প্রতিটি হাত যেন এক ব্যক্তিগত আর্টওয়ার্ক; একটি গল্প, যেখানে ফ্যাশন মিশে যায় আত্মপ্রকাশের সঙ্গে।
আজকের ফ্যাশন দুনিয়ায় অ্যাকসেস মানে কেবল অনেক গয়না নয়, এটি এক গভীর আত্মপ্রকাশের ভাষা। মানুষ এখন দেখাতে নয়; বরং বলতে চায় নিজের গল্প, পরিচয়, অনুভূতি। ফ্যাশন বিশ্লেষক এবং মিসোমা লন্ডনের প্রতিষ্ঠাতা মারিসা হরডার্ন এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘অতিরিক্ত গয়না মানে শুধু পরিমাণ বৃদ্ধি নয়; এর মানে হলো তা কতটা অর্থবহ। প্রতিটি পিসে থাকে পরিধানকারীর ব্যক্তিগত বার্তা।’ এই প্রবণতার সূত্রপাত মূলত করোনা-পরবর্তী মানসিকতা থেকে, যেখানে মানুষ নিজেদের সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকেও সৌন্দর্য ও স্বাধীনতার নতুন সংজ্ঞা খুঁজে নিয়েছে।
বড় ব্র্যান্ডগুলোও এই আবেগকে তুলে ধরছে নিজস্ব ভাষায়। ডিওরের বারোক-ইনস্পায়ার্ড চোকার্সের ইউরোপীয় শিল্প, শ্যানেলের মাল্টি-লেয়ার্ড পার্লস কিংবা গুচির মিসম্যাচড হেয়ারলুম-স্টাইল ব্রোচেস—সবই প্রমাণ করছে, এখন ফোকাস সিমেট্রি নয়, বরং সেলফ-স্টোরিটেলিং। এই ট্রেন্ড প্রতিফলিত করছে এমন এক সমাজচেতনা, যেখানে বৈচিত্র্য, স্বাধীনতা ও আত্মবিশ্বাস মূল শক্তি। এ জন্য ২০২৫ সালের শীতকালীন ফ্যাশনে গয়না আর পরিপূরক নয়; বরং পুরো লুকের কেন্দ্রবিন্দু। লেয়ারড চেইনস, মিক্সড মেটালস এবং কালার-রিচ জেমস্টোনস—সব মিলিয়ে এক সাহসী নান্দনিকতা, যা পরিধানকারীর উজ্জ্বল, দৃঢ় ও নির্ভীক রূপ উদ্‌যাপন করছে। আজকের নারী গয়নার মাধ্যমে বলছেন, ‘আমি আছি, আমি দৃশ্যমান’; কখনো তা ঝলমলে আলোয়, কখনো রঙিন পাথরের মাধুর্যে, আবার কখনো নিঃশব্দ অথচ অমলিন সৌন্দর্যে।

 শিরীন অন্যা
মডেল: সিনথিয়া
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দীন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top