ফিচার I বিশ্বকাপের স্টাইলিশরা
চলছে বিশ্বকাপ ফুটবল। বিশ্বজুড়ে দারুণ উন্মাদনায় মেতে রয়েছেন ফুটবলপ্রেমীরা। আধুনিক সময়ে ফুটবল শুধু মাঠ কিংবা খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। খেলোয়াড়-কোচদের স্টাইল, জার্সির বাহার– সবই ছড়িয়ে পড়েছে দিকে দিকে। ফুটবলারদের ফ্যাশন নিয়েও অনেকের কৌতূহল অপার। তা মেটানোর প্রয়াস করেছেন শুভ্র মিসির
রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া খেলোয়াড়দের মধ্য থেকে আলোচিত ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ভোগ’ নির্বাচন করেছে সেরা দশ স্টাইলিশ প্লেয়ার। জেনে নেওয়া যাক তাদের স্টাইল সম্পর্কে:
কেইজুকি হোন্ডা
‘জাপানিজ ম্যারাডোনা’ হিসেবে খ্যাত মিডফিল্ডার কেইজুকি হোন্ডা, জাপানের এক সেরা ফ্যাশন আইকন। রাশিয়ায় এসেছেন ছিমছাম পোশাকে। লেমন ইয়েলো লিনেনের স্যুট আর কালার ম্যাচ করে চামড়ার লোফার তাকে আলাদা করে তুলেছিল সবার থেকে। ক্যাজুয়াল পোশাক তার পছন্দের হলেও তাতে নতুনত্ব আনতে ভালোবাসেন। তবে হোন্ডা পছন্দ করেন বিলাসবহুল ঘড়ি জমাতে। ২০১০ সালে এক অনুষ্ঠানে দুই হাতে দুটি গাগা মিলানো ঘড়ি পরে তো চমকেই দিয়েছিলেন সবাইকে।
জেরেমি বোয়েটাঙ্গ
জার্মানির সেন্টারব্যাক জেরেমি বোয়েটাঙ্গ ফ্যাশন আইকন প্লেয়ারদের একজন। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রায় সাড়ে ছয় শ জোড়া স্টাইলিশ জুতার বিরাট এক সংগ্রহ রয়েছে তার। পছন্দের ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে সুপ্রিম, ব্যালেঁসিয়াগা, বালমেঁসহ আরও নানান ব্র্যান্ড। তবে সানগ্লাসের ক্ষেত্রে একটু বেশিই দরদি দেখা যায় তাকে। সংগ্রহেও আছে অনেক। সোনালি সানগ্লাসে তাকে ভালোই মানায় সব সময়।
পল পগবা
একসময়ের বিশে^র সবচেয়ে দামি খেলোয়াড় ফ্রান্সের মিডফিল্ড জেনারেল পল পগবা। পগবা কী পরবেন, সেটার দিকে তাকিয়ে থাকেন তার ভক্তরা। বাহারি পোশাকের পাশাপাশি ভিন্ন মাত্রার কালারফুল চুলের স্টাইল তাকে আলাদা করে তোলে সবার কাছ থেকে। তার পছন্দের রং কালো। কালো রঙের সবই তাকে মানায়। পছন্দের ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে ডলশে অ্যান্ড গাবানা, গুচি, ইয়েজি, সুপ্রিম, জিভঁশি। বিশ্বকাপের আগে তার স্টাইল নিয়ে সমালোচনার ফলে আপাতত ফ্যাশন রেখে খেলাতেই মন দিয়েছেন সাদাসিধেভাবে চুল কেটে।
হেক্টর বেল্লেরিন
স্পেন ও আর্সেনালের রাইট ব্যাক হেক্টর বেল্লেরিন, ভালোবাসেন স্ট্রিটওয়ার ফ্যাশন। র্যাফ সিমন্সের ভক্ত বেল্লেরিন ফিউশনধর্মী স্পোর্টসওয়্যার পরতে পছন্দ করেন। পোশাকে নজরকাড়া ফিউশনের জন্য দলের ভেতর ও বাইরে তিনি আলোচিত। এসবে কান না দিয়ে বেল্লেরিন সব সময় আলাদা হতেই চেয়েছেন। উঁচু করে বাঁধা পনিটেইল চুলের সঙ্গে কালারফুল ফিউশনে তাকে ভালোই মানায়। পছন্দের ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে ফিয়ার অব গড, কিডসুপার, অফ-হোয়াইট, গুচি, জিমারম্যান। বেল্লেরিনের দাদার ছিল সেলাইয়ের কারখানা, ফলে কখনো-সখনো নিজের কাপড় নিজেই নাকি সেলাই করে নিতেন তিনি!
কিলিয়াঁন এমবেপ্পে
বিশে^র সবচেয়ে দামি টিনএজ ফুটবলার ফ্রান্সের এই স্ট্রাইকার। গেল বছর রেকর্ড পরিমাণ ফিতে মোনাকো থেকে পিএসজিতে নাম লিখিয়েছেন তিনি। অল্প বয়সেই ফ্যাশনেবল ফুটবলারদের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। নিজের ওয়্যারড্রোব ভরিয়ে তুলেছেন বিলাসবহুল সব ব্র্যান্ডের পোশাক দিয়ে। তবে হুগো বসের নেভিব্লু স্লিম ফিট পোশাক পরতেই স্বাচ্ছন্দ্য করেন তিনি। ফ্যাশন-সচেতন এমবেপ্পে নিজেই নিজের স্টাইল ঠিক করেন এবং নিজ হাতে যত্ন করতেও ভোলেন না।
মারুওয়াইন ফেল্লাইনি
বেলজিয়ামের মিড ফিল্ডার মারুওয়াইন ফেল্লাইনি খেলেন ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে। সোনালি ঝাঁকড়া চুলের জন্য দারুণ জনপ্রিয় ফেল্লাইনি স্টাইলের দিক থেকেও কম যান না। সম্প্রতি জিকিউ স্টাইল ম্যাগাজিনের জন্য মিকি মাউস ঢঙে চুল বেঁধে ছবি তুলে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। পছন্দ করেন ব্ল্যাক জিনস, ব্লু শার্ট আর কালারফুল ¯িœকার। বেলজিয়ামের হয়ে এখনো মাঠে আলো ছড়াতে না পারলেও ফ্যাশন-দুনিয়ায় ফেল্লাইনি ঠিকই আছেন আলোচনায়।
এরিক দিয়ার
ইংল্যান্ডের সুদর্শন মিডফিল্ডার এরিক দিয়ার। খেলেন ইংলিশ ক্লাব টটেনহ্যামের হয়ে। ফ্যাশনের চেয়ে চিত্রকলায় যার বেশি মন। তাই বলে ফ্যাশনেবল পোশাক আর বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের কদর করতেও কম যান না তিনি। তার ছেলেবেলা কেটেছে পর্তুগালে। সেখানেই হয়েছে ফুটবলে হাতেখড়ি। সময় পেলে ঢুঁ মারেন আর্ট গ্যালারিতে। পাশাপাশি স্টাইলিশ পোশাকের তার সংগ্রহে আছে বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীর চিত্রকর্ম। বই পড়তে ভালোবাসেন অবসরে। ক্লিন লাইন আর সিল্ক টেইলারিংয়ের পোশাক পছন্দ করেন তিনি।
অ্যান্তোনিও গ্রিজম্যান
এ সময়ের আলোচিত ফ্যাশন-সচেতন ফুটবল তারকার কথা এলে নামটি চলে আসবে তালিকার শুরুতেই। চুলের স্টাইলের কারণে সব সময় আলোচনায় থাকলেও ফ্যাশনের দিক থেকে কম যান না গ্রিজম্যান। গুচি তার পছন্দের তালিকার ওপরেই থাকে। এ ছাড়া ভালোবাসেন স্প্যানিশ ব্র্যান্ড বালেঁসিয়াগা, সেইন্ট লরাঁ ও লুই ভিতোঁর পোশাকও। প্রিয় রঙ কালো। তাই গ্রিজম্যানের পোশাকে কালোর আধিক্য অবধারিত।
সার্জিও রামোস
রাশিয়া বিশ্বকাপে স্পেনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা সার্জিও রামোস। মাঠে বদমেজাজ আর ফাউলের জন্য বেশ বিখ্যাত। গেল বছর লা লিগায় সবচেয়ে বেশি লাল কার্ড পেয়েছেন। তবে মাঠের বাইরে তাকে বেশ ফ্যাশন-সচেতন। শরীর-ভর্তি ট্যাটু আর বাহারি চুলের কাটের পাশাপাশি হাল ফ্যাশনের সব পোশাকের কদরই তিনি করেন। পোশাকে অতটা ক্যাজুয়াল না হলেও ফরমাল থাকতেই ভালোবাসেন রামোস। পছন্দের ব্র্যান্ড হুগো বস, গুচি, ডলশে অ্যান্ড গাবানা।
জেন্নিক ভাসটারগ্রাড
ডেনমার্কের সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার ফুটবলভক্ত তরুণীদের পছন্দের তালিকায় তার স্থান অনিবার্য। কালো জিনস, সাদা টি-শার্ট, খাকি আর্মি জ্যাকেট আর ক্যাজুয়াল কনভার্সে সোনালি চুলের জেন্নিককে সবার চেয়ে আলাদা দেখায়। বিশ্বকাপে ডেনমার্ক কতটা সফল হয়, তা দেখার চেয়ে অনেকেই ভাবছেন দলটি যত দূর যাবে, তত বেশি দেখা যাবে জেন্নিক ভাসটারগ্রাডকে।
বিশ্বকাপের সেরা স্টাইলিশ জার্সি
রাশিয়া বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে ৩২টি দল। ৩২টি দেশের শতাধিক খেলোয়াড়কে আলাদা করে চেনা যায় তাদের জার্সির কল্যাণে। স্টাইলিশ জার্সির দিক থেকে দর্শকদের ভোটে সেরা পাঁচটি দেশের জার্সির খবর জেনে নেওয়া যাক এবার…
নাইজেরিয়া
সুপার ইগলরা বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে উঠতে না পারলেও তাদের খেলা দর্শকদের যতটা পছন্দ হয়েছে, তার চেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে জার্সি। কয়েকটি প্রতিযোগিতা থেকে জার্সি ডিজাইনের অনুপ্রেরণা নিয়েছে তারা। মডার্ন লুকিং এই জার্সিতে রয়েছে সবুজ জমিনে হোয়াইট প্যাটার্ন। হাতার মধ্যেও রয়েছে সাদার উপর কালো প্যাটার্ন। ইগলের ডানায় এ রকম প্যাটার্ন লক্ষ করা যায়।
জাপান
এশিয়ার প্রতিনিধি জাপানের জার্সি দেখে মনে হবে নীল জমিনে নকশিকাঁথার বুনন। কিন্তু আসলে এটা জাপানের ঐতিহ্যবাহী সাশিকো সেলাইয়ের প্যাটার্ন। ষোলো শতাব্দীতে সেদেশে সাশিকো সেলাইয়ের আবির্ভাব ঘটে। তখন থেকে এই প্যাটার্ন বেশ জনপ্রিয় জাপানিদের কাছে। জাপানের প্রাচীন সামুরাই যোদ্ধাদের পোশাকেও দেখা যেত এমন প্যাটার্ন। ঐতিহ্য আর যুদ্ধ জয়ের মনোবাসনা থেকেই এসেছে জাপানের জার্সির এই স্টাইল।
রাশিয়া
আয়োজক রাশিয়ার জার্সিও হয়েছে বেশ। ডিজাইনার গোসা রুবচিনস্কি ও সেভার ভেসেভোলোদ চেরপানভের ডিজাইনে লাল জার্সিতে হাতার মধ্যে রয়েছে মোটা সাদা স্ট্রাইপ আর কাঁধে চিকন স্ট্রাইপ। ডিজাইনে অনুপ্রেরণা রেট্রো লুক। আশির দশকের শেষ ভাগে যখন তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে দ্বিতীয় হয়েছিল, সে সময় নাকি তাদের জার্সিটা দেখতে অনেকটা এ রকমই ছিল।
আর্জেন্টিনা
এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা খুব একটা অদল-বদল করেনি জার্সিতে। হালকা আকাশি আর সাদার স্ট্রাইপ বরাবরের মতোই আর্জেন্টিনা-সমর্থকদের মনে শান্তির দোলা দেয়। আকাশি-সাদা সামনে আর পিঠে, দু’কাঁধে কালো স্ট্রাইপ; ক্লাসিক্যাল জার্সির স্টাইলটিই ধরে রেখেছে আর্জেন্টিনা। ম্যারাডোনা, বাতিস্তুতা, ক্যানিজিয়ারা যেই জার্সি গায়ে বিশ্ব মাতিয়েছেন।
স্পেন
টিকিটাকার দলের জার্সি তো বরাবরের মতোই ফুটবলপ্রেমীদের মন কেড়েছে। চিরাচরিত লালের ওপর ডায়মন্ড চেকারবোর্ড ইফেক্ট, এক পাশে হলুদ আর আর পার্পল কালারের উপস্থিতিতে এবারের জার্সিটি বেশ নজরকাড়া।
সেরা স্টাইলিশ কোচ
কোচ খেলেন মাঠের বাইরে। খেলোয়াড়েরা যখন মাঠের খেলায় এবং মাঠের বাইরে ফ্যাশন নিয়ে রীতিমতো দুনিয়া মাতিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন কোচরাও বসে থাকবেন কেন! বিশ্বকাপে সবচেয়ে ফ্যাশনেবল কোচ কে, তা নিয়ে আলোচনার কমতি নেই। তবে এযাত্রায় বিজয়ী কোচের নাম গ্যারেথ সাউথগেট। ৪৭ বছর বয়সী এই ব্যক্তিকে বলা হচ্ছে বিশ্বকাপের সবচেয়ে ফ্যাশনেবল কোচ।
পোশাক হিসেবে সাউথগেটের পছন্দ মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সারের ওয়েস্টকোট। পানামার ম্যাচ চলাকালে তাকে দেখা গিয়েছিল নিখাদ সেলাইয়ের তিন পিসের একটি দারুণ স্যুটে। হালকা আকাশি রঙের শার্ট, ছোট করে কামানো দাড়ি, সাধারণ চুলের কাটিং, দামি কালো এক জোড়া শু, ডান হাতে ঘড়ি, বাম হাতে চিকন দড়ির ব্যাজ। সঙ্গে রয়েছে লাল, নেভি ব্লু আর সাদা স্ট্রাইপের টাই। ইংলিশ এই কোচকে দেখে নিখাদ ভদ্রলোকই মনে হয়েছে।
প্রায় প্রতি ম্যাচেই সাউথগেটকে ভিন্ন ভিন্ন লুকে দেখা যায়। দেখে মনে হবে, সাধাসিধে চেহারার মানুষটি ফ্যাশন নিয়ে অতটা মাথাই ঘামান না। ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের এক প্রীতি ম্যাচে মাথায় ক্যাপ আর ওয়েস্টকোটের সঙ্গে প্রিয় আকাশি শার্ট ও আকাশি কালারের টাই পরে পুরোদস্তুর এক ফ্যাশন আইকন হয়ে মাঠে উপস্থিত হয়েছেন তিনি।
এবারের বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড দলটিকে নিয়ে বেশ আশাবাদী খোদ ইংলিশরাই। হ্যারি কেইন, ডেল আলি, রাহিম স্টার্লিং, জেসি লিনেগার্ডদের সমন্বয়ে গড়া ইংল্যান্ড টিমের আসল প্রাণভোমরা কিন্তু ওই গ্যারেথ সাউথগেটই। ফ্যাশনেবল কিন্তু বাড়াবাড়ির মতো কিছু করে কখনোই আলোচনায় আসতে চান না তিনি। পোশাকে নয়, মাঠের খেলাতেই মন দিতে চান সব সময়।