বিশেষ ফিচার I বাঙালির জীবনে গরু
গ্রামবাংলার জীবন ও সংস্কৃতিকে বহমান রেখেছে এই প্রাণী। কতো কথা-কাহিনি, কিংবদন্তি, প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে একে ঘিরে। লিখেছেন উদয় শংকর বিশ্বাস
ঈদুল আজহা এলেই বাঙালি মুসলমানের ভাবনায় অনিবার্যভাবে চলে আসে গবাদিপশু, বিশেষ করে গরু। কারণ, গরু কোরবানি দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমান উদ্যাপন করে প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, বাঙালির গরু নিয়ে ভাবনা আজকের নয়, বরং তা আবহমানকালের। দিনক্ষণ ধরে এ হিসাব কারও পক্ষেই মেলানো সম্ভব নয়। বাঙালির জীবনে গরুর মতো আর কোনো প্রাণীর এমন সরব উপস্থিতি নেই। গরুপ্রীতি বাঙালির সত্তাজুড়ে। আমাদের জীবনে গরুর উপস্থিতির গুরুত্ব নিয়ে গরু খোঁজার প্রয়োজন পড়ে না। বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়। আমরা বন্ধুরা পরস্পরকে হরহামেশাই গরু বা বলদ বলে সম্বোধন করি, কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে। তাতে কেউ কেউ সামান্য চটে বটে, তবে অধিকাংশই রা কাড়ে না। কারণ নীরবতাই এ ক্ষেত্রে শ্রেয়! বন্ধুর মুখে গরু সম্বোধন যে শোনেনি, সে সত্যিই অভাগা! এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্বোধন আমলে নিয়ে বলা যায়, বাবা-মা-মুরব্বিদের ‘মাথা মোটা গরু’ বা ‘মাথা ভর্তি গরুর গোবর’- তিরস্কারে অনেকের পক্ষে রাগ সংবরণ সম্ভব নয়। তা সে যতই যুক্তিবাদী বা শান্তশিষ্ট লেজবিশিষ্ট হোক না কেন! স্কুলের শিক্ষকেরা অবশ্য আরেক কাঠি সরেস; তাঁরা ‘গরুর বাচ্চা’ বলে অবলীলায় শিক্ষার্থীদের ভর্ৎসনা করে থাকেন। যদিও এসব গরুই পরবর্তীকালে দেশের হালচাল নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
গরু বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে সবক্ষেত্রে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে গরুর দেখা মেলে না। রসনাবিলাসী বাঙালির মাংসপ্রীতি এখন গরুর দড়িতেই বাঁধা পড়ে আছে। গোমাংস খেতে (মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোমাংস খেয়েই হারিয়েছিলেন নিজ ধর্ম) বারণ- এমন অপ্রিয় কথা ডাক্তারবাবুরা যতই বলুন না কেন, আমরা তা থোড়াই কেয়ার করি। প্রতিদিন নামে-বেনামে গরুর মাংস বিক্রির ধুম দেখে ভিরমি খেতে হয়। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাংস নির্দ্বিধায় বলা যায় গোমাংস। অবশ্য অনেক আগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইতে লিখেছেন, ‘আমেরিকা এসে গরুর মাংস না খেলে আমার জানাই হতো না পৃথিবীতে এমন সুস্বাদু কিছু থাকতে পারে’। শুধু কি মাংস? গরুর মাথা-পা মায় নাড়িভুঁড়ি এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই যা খাওয়া হয় না বা ব্যবহার করা হয় না। আগুনে পুড়িয়ে-ঝলসিয়ে-ভেজে-রান্না করে হরেক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত গরুর মাংস ছাড়া বাঙালি মুসলমানের এক দিনও চলে না।
শোনা যায়, প্রাচীনকালে ভারতবর্ষের নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণেরা তাঁদের দিন শুরুই করতেন কচি বাছুরের মাংস (এই কচি বাছুরের মাংসকেই কিন্তু ভিল বলে যা বিশ্বে বিশেষ সমাদৃত) ভক্ষণ করে। সময়ের ঘূর্ণিপাকে তা আজ ট্যাবুতে পরিণত হয়েছে। এখন ব্রাক্ষণেরা গরুকে মাতৃজ্ঞানে ভক্তি করেন, খাওয়া তো দূরের কথা! মাংস না খেলেও তারা দুগ্ধজাতীয় খাদ্যে এখন মশগুল। প্রাচীন ভারতে ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ- এই মোট আট রকম বিয়ের রীতি ছিল সমাজসিদ্ধ। এর মধ্যে ‘আর্য’ বিয়েতে কন্যাকে গরুদানের রীতি ছিল। বিয়েতে যৌতুক হিসেবে জোড়াগরু (বলদ) দেওয়ার রীতি আমাদের কৃষিজীবনকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এখনো গোদান পবিত্রতম দান। আজও হিন্দু বিয়ে ও সৎকারে গোদানের রীতি বহাল আছে।
গরুকেন্দ্রিক অনেক লোকাচার বাঙালির জীবন থেকে হারিয়ে গেছে সময়ের আবর্তে। যেমন ‘চাঁদবদনী’ নামের লোকাচারটি আর পালিত হয় না। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে এটি একসময় দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হতো। আনুষ্ঠানিকভাবে গরুকে নিয়ে রচিত গান গাওয়ার ধুম পড়ে যেত এ সময়। এ উপলক্ষে গোয়ালঘর পরিষ্কার করে আলপনা আঁকতেন বাড়ির মহিলারা। মাটির প্রদীপ, ফুলের মালা, সরিষার তেল, কাঁচা হলুদ ও ধান পিতলের থালায় নিয়ে গোয়ালঘরে যেতেন বাড়ির মহিলারা। সাজ-সাজ রব পড়ে যেত পুরো বাড়িতে। শিংয়ে তেল-সিঁদুর মেখে কলার পাতায় সুন্দর করে গরুকে খেতে দেওয়া হতো। এদিন গরু পূর্ণ বিশ্রামে থাকত। গরুর সঙ্গে কৃষির যে নিবিড় সম্পর্ক, সে সম্পর্কিত একটি লোকাচার হলো গোষ্ঠবেড়। হাওরে এটি প্রচলিত ছিল। এখন বিলুপ্ত। গোষ্ঠবেড়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হতো বাড়ির পাশের নিচু জায়গায়। কীর্তন গানের আসর বসত। গরুকে ওই দিন ছেড়ে দেওয়া হতো। সারা দিন কীর্তন চলত। সন্ধ্যায় গরুকে নিয়ে এসে আসরে ছেড়ে দেওয়া হতো। গরু আসর বেড় দিত। অন্যদিকে চৈত্রসংক্রান্তিতে গোরক্ষপূজার কথাও কারও কারও মনে থাকতে পারে। কলা, গুড় ও আতপ চালের প্রসাদ খাওয়া হতো। সধবা মহিলারা ‘গোকালব্রত’ পালন করতেন গরুর মঙ্গলের জন্য। এখন এসব আর নেই। ‘ভোলাভুলি’ নামের লোকাচারটি হারিয়ে গেছে চিরদিনের মতো। গরুকে চোখে ঠুলি পরিয়ে তেলি সম্প্রদায়ের সরিষা তেল তৈরির প্রক্রিয়াও এখন আর দেখা যায় না। তেল পেতে বা দিতে পছন্দকরা বাঙালি তার প্রিয় সরিষার তেল প্রস্তুতে গরুকে ব্যবহার করেছে। এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রাণী ঠাঁই পায়নি। ঘানিতে ভাঙা তেলের কদর সব থেকে বেশি। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট মাথায় রেখে বলা যায়, সরিষা তেলের কদর উত্তরোত্তর বরং বৃদ্ধি পাচ্ছে। সে জন্য দেশের বাঘা বাঘা তেল প্রস্তুতকারী জাতীয়-আন্তর্জাতিক কোম্পানি বিজ্ঞাপনে গরুর ঘানিতে, শুধুই ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল বলে হরহামেশাই গলা সাধছেন। চোখে ঠুলি পরানো ঘানিটানা গরু যা ‘প্রাসঙ্গ’ নামে পরিচিত ছিল, তার সরব উপস্থিতি আজকাল আর নেই। মাঠের কাজে ব্যবহৃত গরু যা ‘হালিক’ নামে পরিচিত ছিল, সেও বিশ্রামে চলে গেছে। তেলি সম্প্রদায়কে কলু বলা হতো। আর তাদের ঘানি টানা গরুকে বলা হতো কলুর বলদ। একসময় নির্বিবাদে কাজ করে যাওয়া ব্যক্তি বোঝাতে কলুর বলদ বাগধারা ব্যবহার করা হতো। গ্রামাঞ্চলে একসময় ‘হালিক’ আর ‘জালিক’-এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে জবর রেষারেষি ছিল। জালিকেরা মাছ ধরার কাজ করতেন এবং হালিকেরা নিজেদেরকে তাদের থেকে কিছুটা অগ্রসর শ্রেণি মনে করতেন। হালিকদের মূল পেশা ছিল গরু দিয়ে জমি চাষ করা। গ্রামাঞ্চলে এ ধরনের বিভাজন এখন খুব একটা নেই। হালিক-জালিক এক হয়ে গেছে গ্লোবাল ভিলেজের জাদুর টানে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মাঠে রুগ্ণ বা বলবান গরু দিয়ে লাঙল টানার চিরপরিচিত দৃশ্য শেষ হতে বসেছে; সেই সঙ্গে হালিক শব্দটিও হারিয়ে যাওয়া শব্দকোষে স্থান করে নিয়েছে অবলীলায়। হাল চাষে এখন কদাচিৎ গরুর দেখা মেলে। সাধারণত ট্রাক্টর দিয়েই দেশের জমিজমা চাষ হচ্ছে, তবে এতেও কারও কারও আপত্তি দেখা যায়। ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করা হলে জমির উর্বরতা হ্রাস পায় এমন বিশ্বাসী কোনো কোনো সনাতন কৃষক তার বাপ-দাদার শেখানো পথেই হাঁটচ্ছেন এখন অবধি। কত দিন সে ধারা রক্ষা করতে পারবেন, তা অদৃষ্টই জানেন। দুপুরে খানিকক্ষণ গরুকে বিশ্রাম দিয়ে কৃষক তার আহার সারতেন জমিতে বসেই। বিকেল-সন্ধ্যায় ধুলো মাড়িয়ে গরু-রাখালের বাড়ি ফেরার মনোরম দৃশ্য আজ ম্রিয়মাণ। পড়ন্ত বেলায় ধুলা উড়িয়ে গরুর পাল গোষ্ঠে বা গোয়ালে ফিরত। সেই দৃশ্য থেকেই এসেছে চমৎকার একটি বাংলা শব্দ- গোধূলি। সারা রাত গরু দিয়ে ধান মাড়ানোর দৃশ্য কচিৎ গ্রামে খুঁজে পাওয়া যাবে। গ্রামীণ কৃষক কত বিনিদ্র রজনী পার করেছে গরুর সঙ্গে ধান মাড়াতে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই; তবে সেসব আজ কেবলই গল্প মনে হয়। গরু নিয়ে যত গল্প তৈরি হয়েছে, এত গল্প আর কোনো গৃহপালিত প্রাণীকে নিয়ে বাঙালির ভান্ডারে নেই। গরু রচনার সঙ্গে বঙ্গীয় সংস্করণের বিদ্যালয়গামী ও প্রাক্তন শিক্ষার্থী সবারই পরিচয় আছে। বাংলা সাহিত্যের পাঠকের কাছে প্রিয় রচনা হিসেবেই স্থান করে নিয়েছে গরু রচনা।
এমন গৃহস্থ সংযুক্ত প্রাণীটিকে নিয়ে বাংলায় অজস্র কথা-কাহিনি-কিংবদন্তি, ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ-প্রবচন সৃষ্টি হয়েছে। বান্দরবানের মুরং আদিবাসীদের গো-হত্যা পরবের কথা অনেক বাঙালিরই অজানা। মুরংদের বিশ্বাস, স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের প্রেরিত বাণী কলা পাতায় নিয়ে আসার সময় ক্ষুধার্ত গরু তা খেয়ে ফেলে। এর ফলে মুরংদের কোনো ধর্মীয় পুস্তক নেই। এই ক্রোধে তারা গরুকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে কষ্ট দিয়ে বর্শা বিঁধিয়ে মারে এবং আনন্দ উদ্যাপন করে। আমাদের কাছে তা যতই নৃশংস হোক, মুরংদের কাছে তা-ই ধর্মীয় আচার। কথা-কাহিনির মতো বাংলা প্রবাদে ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’, ‘কানা গরু বামুনকে দান’, ‘গোনা গরু বাঘে খায় না’, ‘বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়’, ‘গাছে গরু চরান, মুখে ধান শুকান’, ‘গল্পের গরু গাছে ওঠে’, ‘গরু মেরে জুতা দান’ কিংবা উল্টোটা- এমন সব প্রবাদবাক্য যতই বলি না কেন, একথা বলা যায় না ‘রাঁড়কে (বিধবা) রাঁড় আর ষাঁড়কে ষাঁড় বলা দায়’, অর্থাৎ বিধবাকে বিধবা বললে সে বেজার হয়, গরুকে গরু বলার মতোই। অন্যদিকে নাতির মুখ দেখে প্রসন্ন গৃহকর্ত্রী নিজ সৌভাগ্য গোপন করার চেষ্টা করেন অপরের ঈর্ষাপীড়িত দৃষ্টি থেকে- প্রবাদে তা-ও বলা আছে এভাবেÑ বউ বিয়ালো বেটা, গাই বিয়ালো নই,/ প্রাণ ধরে একথা কারে বলি সই।
বহুল প্রচলিত ‘দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভাল’ প্রবাদ প্রায়শই আমরা আওড়াই একরকম ক্ষোভ ও হতাশা থেকে। আবার উল্টো কথাও আছে, ‘যে গরু দুধ দেয় তার লাথিও ভাল’ বা ‘দুধালা গরুর চাটও মিষ্টি’। নিকট আত্মীয় অপেক্ষা নিঃসম্পর্কীয় প্রতিবেশীর কাছ থেকে আমরা সচরাচর অনেক বেশি সহায়তা পাই। সে জন্য প্রবাদে বলে: ‘পাড়া-পড়শীর গুণে বেড়ে গরুও বিকিয়ে যায়’। সে জন্যই তো নিত্য সাহায্যকারী গরু দেখেশুনে কিনতে হয়। প্রবাদে সেটাই বলা হয়েছে: ‘বাড়ির কাছে ধান গাছ,/ যার মা আছে ছা।/ চিনিস্ বা না চিনিস্,/ ঘুঁজি দেখে গরু চিনিস।
প্রবাদের মতো ধাঁধাতেও গরুর অজস্র উল্লেখ আছে। যেমন পুকুরে জাল ফেলার কথাটি এ ধাঁধায় এমনভাবেই বলা হয়েছে: আঁধারে আঁধার চৌ-পুকুরে বাঁধা/ কালো গাই চরতে গেল, লেজ রইল বাঁধা।
আমাদের দেশে বিদ্যুৎ এই আসে এই যায়, বিদ্যুতের এমন কারসাজি নিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলের ধাঁধায় গরুকে আনা হয়েছে এভাবে: এই দেখলাম এই নাই/ বেতগড়াতে (বেতের ক্ষেত) গাই নাই।
জঙ্গলে বেঁধে রেখে আসা গরু আর বাঁশের চোঙ্গাতে দুধ রাখার বিষয়টি রংপুরে প্রচলিত ধাঁধায় একই বন্ধনে নিয়ে আসা হয়েছে; আরা বাড়িত (জঙ্গলে) রাঁধিনু গাই/ চোঙ্গা (বাঁশের চোঙ্গা) আন দোয়াবার যাই।
যে গরুর দুধ মিষ্টি, সে গরুর তেজ ও ক্রোধ বেশি। যেমন: আমমানাতে তিরিবিরি, চৌডালেতে বাসা/ গাই বড় হাটিহুটি, দুধ বড় মিঠা।
গরুকে নিয়ে সরাসরি মুর্শিদাবাদে প্রচলিত ধাঁধাটাও কম চমকপ্রদ নয়: চারটি ঘড়া উপুড় করা/ তার ভিতর মধু ভরা।
বাংলা লোকসাহিত্যের পরতে-পরতে এমন অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। গৃহস্থের কল্যাণ-অকল্যাণ একসময় পুরোটাই নির্ভর করতো গরুর ভালোমন্দের ওপর। সে জন্য গরুকে তুষ্ট রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা ছিল কৃষকের। সূর্যোদয়ের আগেই হালের বলদ দিয়ে কৃষক মাঠে যেতেন। ঘুমমাখা চোখে বলদের হালচাষের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ না থাকলেও কৃষকের মনে তা আজও জাগরূক। হালচাষই ছিল কৃষকের ধ্যানজ্ঞান। হালকর্ষণের সময় রিপুতাড়িত স্ত্রীসহবাস পর্যন্ত কোনো কোনো কৃষকের কাছে নিষিদ্ধ ছিল। অধিক শস্য লাভের আশায় নিয়মনিষ্ঠ অনেক কৃষক এসব নিয়ম মেনে চলতেন অক্ষরে-অক্ষরে। গরুর রোগব্যাধি নিয়ে সদা চিন্তিত থাকতেন কৃষক। রোগব্যাধি থেকে গরুকে রক্ষার জন্য ‘গোয়াইলার শিরনি’ নামে একটি লোকরীতি পালন করতেন তারা। ভাদ্র মাসের ১৩ তারিখে তা সাড়ম্বরে উদ্যাপিত হতো। গোয়ালঘরের ভেতর চুলা তৈরি করে তাতে খিচুড়ি রান্না হতো। সে খিচুড়ি গোয়ালঘরে বসেই খাওয়া হতো। বাংলার বাইরে এ রীতি বিহার, দক্ষিণ ভারতে এখনো প্রচলিত আছে। ‘গো-ফাল্গুনী’ রীতিটিও উদ্যাপন করা হতো একই উদ্দেশ্যে। গরুর রোগব্যাধির হাত থেকে রক্ষার জন্যই মূলত রীতিটি উদ্যাপন করা হতো। ফাল্গুন মাসের শেষ দিন তা করা হতো। এদিন গরুর গা ভালোভাবে ধোয়ানো হতো। এরপর শিমুল-মান্দারসহ বারো রকম কাঁটা গাছ পুড়িয়ে গোয়ালে ধোঁয়া দেওয়া হতো। বিশকাটালি দিয়ে গরুকে মাঠে নিয়ে যাওয়া হতো। কাঁটাযুক্ত গাগরার ছোট ডাল দিয়ে গরুকে পেটানো হতো। মনে করা হতো, এর মাধ্যমে গরুর কোনো অসুখ-বিসুখ হবে না। গরুর ভালোমন্দের দিকে কৃষকের সজাগ দৃষ্টি রাখা ছিল বাধ্যতামূলক। ভিন্ন ধরনের আরেকটি লোকাচারের এখনো দেখা মেলে, যা ‘অম্বুবাচী’ নামে পরিচিত। আষাঢ় মাসের ৭ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত হিন্দু বিধবা মহিলারা অম্বুবাচী পালন করেন, তাদের বিশ্বাস- এ সময় বসুন্ধরা রজঃস্বলা থাকে। এ জন্য এই তিন দিন কৃষকেরা জমিতে গরু দিয়ে লাঙল দেন না। কৃষিকাজের সবকিছুর সঙ্গে গরুর কোনো না কোনো যোগ আছে।
উপকারী, প্রভুভক্ত গরুকে বাঙালি নানা কাজে ব্যবহার করেছে। মুটে বহন থেকে শুরু করে হেন কাজ নেই যেখানে গরুর দেখা মেলে না। মাল বহন করার জন্য গরুর ব্যবহার অনেক পুরোনো। রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের চরাঞ্চলের যাতায়াতের এখনো প্রধান বাহন গরুর গাড়ি। ভাওয়াইয়া গানে গরুর গাড়ি ও গাড়িয়ালদের অসংখ্য উদাহরণ আছে। বাংলা সিনেমায় হেলে-দুলে চলা গরুর গাড়ির দৃশ্য কতবার যে দেখানো হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। এ নিয়ে আলাদা গবেষণা হতে পারে। ‘দেবদাস’ সিনেমায় নায়কের গরুর গাড়িতে চলার দৃশ্যের কথা মনে পড়লেই এখনো মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। গরুকে দিয়ে পরিবহন বা ভারবহনের রীতি এখন আগের মতন না থাকলেও ‘একধুর’ (এক পিঠা বা এক ভার বহনযোগ্য গরু) শব্দটি একসময় লোকসমাজে বহুল প্রচলিত ছিল। যেমন ছিল দুই পিঠা গরু বা ‘সর্ব্বধুরীন’ নামক শব্দখানা। গরুর একদ- বসে থাকার জো ছিল না। সারা বছর একে দিয়ে নানান কিসিমের কাজ করানো হতো। এ জন্য গরুর কদর কৃষকের কাছে ছিল সব থেকে বেশি। কারণ, কৃষিকাজের বিভিন্ন পর্যায়ে এই প্রাণী প্রয়োজন মেটাত অবলীলায়। গরু ছাড়া জমিতে মই দেওয়া, হাল চাষসহ কোনো কাজই করার জো ছিল না। ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য নানান ধরনের গরু ছিল। একটি গরু দিয়ে সব কাজ করা সম্ভব নয়। উচ্চতা-অবয়বের ধরনানুসারে এর কাজের ভিন্নতা ছিল বা আছে। কাজের সঙ্গে সঙ্গে গরুকে সংসারের সদস্য হিসেবে বরণ করার রীতি ছিল। হাট থেকে কিনে আনার পর ‘গো-বরণ’ উৎসব উদ্যাপিত হতো ধুমধাম করে। এখনো ময়মনসিংহ অঞ্চলে নতুন কিনে আনা গরুর গায়ে পানি ছিটানো হয়। ফরিদপুরে গরুর গায়ে পানি এবং কপালে তেল দেওয়া হয়, সোনা-রুপায় চুবানো পানি গরুর গায়ে ছিটানো হয় নোয়াখালী অঞ্চলে। গরুর গায়ে চালের গুঁড়ার তৈরি পিঠার ছাপ দেওয়া হয় বরিশালে, যাতে গরু গৃহস্থের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসে। একসময় গরুর সংখ্যার উপরেই বাঙালি সমাজে সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্ণীত হতো। গরুকে ভাগিয়ে আনা, রাত জেগে পাহারা দেওয়া, বন্যার সময় গরুর ভেসে যাওয়া ঠেকানো ইত্যাদি নানা কাজে সারা বছরই ব্যস্ত থাকত মালিক। গরুর মতন অপলক ভাসা ভাসা চোখে তাকিয়ে থাকলেই তো জগৎসংসার চলবে না। খেদমত করতে হবে। গরুর থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। গরু বা গাভি যেন বেশি দুধ দেয়, সে জন্য গোরক্ষনাথের শিরনির প্রচলন আছে কোথাও কোথাও। উঠানে বসিয়ে ছোট ছেলে-মেয়েকে শিরনি খেতে দেওয়া হয় গোরক্ষনাথের নাম করে। মনে করা হয়, গোরক্ষক থেকেই গোরক্ষনাথের জন্ম হয়েছে। বৌদ্ধদের মধ্যে গোরক্ষনাথের অবস্থান অনেক উঁচুতে। নাথ গুরুদের অন্যতম হলেন এই গোরক্ষনাথ। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলের নেকমরদের কাছে আজও দেখতে পাওয়া যায় গোরক্ষনাথের প্রাচীন মন্দিরটিকে। পৌষ মাসের শুক্লপক্ষের শেষ দিনে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে গুরুনাথের দোহাই দিয়ে মাগন করা হয় এই অঞ্চলে। যা ‘কুলের মাগন’ নামে পরিচিত।
গরুর দুধ বাঙালির প্রধান পানীয়। পাবনা-সিরাজগঞ্জে দেশের সেরা মানের দুধ উৎপাদিত হয়। এ জন্য দেশের সমস্ত দুগ্ধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখান থেকে দুধ সংগ্রহ করে। দেশের সর্ববৃহৎ সমবায় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার প্রধান কেন্দ্রটিই গড়ে উঠেছে এখানে। মিল্ক ভিটার লোগোতে দেখা মেলে লেজবিশিষ্ট গাভীর। আকিজ গ্রুপের দুধ যা ফার্ম ফ্রেশ নামে পরিচিত তার লোগোতেও গরু আছে। প্রাণ-এর দুধের প্যাকেটেও স্বাস্থ্যবান গরুর দেখা মেলে। এমনকি দেশের প্রতিটি সাধারণ রেস্তোরাঁর (যা হোটেল নামে পরিচিত) সাইনবোর্ডে গরু বিশেষত বলবান ষাঁড়কে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গ্রামবাংলায় একসময় বেশি দুধ পাওয়ার আশায় গাভির ‘দৈ-পান্তা’ উৎসবটি উদ্যাপিত হতো। গাভির প্রথম দুধ দিয়ে তৈরি দই কলার পাতায় করে খেতে দেওয়া হতো উপস্থিত সবাইকে। এমন বিশ্বাস ছিল- সাপ যদি গরুর দুধ খেয়ে যায়, তাহলে সেই গরুর দ্রুত স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। এ জন্য মা মনসার উদ্দেশে নানা কৃত্যানুষ্ঠান করা হতো। এমন নানা কিসিমের লোকাচার ছিল গরুকে কেন্দ্র করে।
গরু যে জায়গায় রাতযাপন বা অবসরযাপন করে, সে জায়গা গোয়ালঘর নামে পরিচিত। গোয়ালঘরে গরু সারা বছর কাটায় একান্ত নিজের মতন করে। শুধু গরু নয়, কখনো-কখনো মানুষের আশ্রয়স্থল হয়েছে গোয়ালঘর। বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশবরেণ্য অনেকেই মাতুলালয়ের গোয়ালঘরে জন্ম নিয়েছেন। স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় গোয়ালঘরেই অস্থায়ী আঁতুড়ঘর বানানোর রেওয়াজ ছিল একসময়। বন্যা-ঝড় নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাড়ির সবাই পদমর্যাদা ভুলে আশ্রয় নিতেন আপাত অবহেলিত সেই গোয়ালঘরে। মানুষ-গরুর এ সহাবস্থান ছিল দেখার মতন! বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ স্মারক বড়– চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটি পাওয়া গেছে গোয়ালঘরে। গোয়ালঘরসহ গ্রামাঞ্চলে উঠোন, বাড়ির আঙিনা এখনো পরিষ্কার করা হয় গোচনা কিংবা গোবর দিয়ে। গোবিষ্ঠাকে পবিত্র মনে করা হয়। যদিও এর আসল কারণ হলো গোবিষ্ঠা অ্যান্টিসেপটিক। আর এখন তো বায়োগ্যাস তৈরি হচ্ছে গোচনা এবং গোবিষ্ঠা দিয়ে; তা দিয়ে মেটানো হচ্ছে জ্বালানি চাহিদা। এমনকি গোবর তো সার হিসেবে বিশেষ কার্যকর। বরেন্দ্র অঞ্চলে এখনো দেখা মেলে ঘরের দেয়ালে শুকাতে দেওয়া গরুর মল দিয়ে প্রস্তুত ‘ঘসি’। গরুর গোবর, পাটকাঠি দিয়ে তৈরি ঘুঁটের রান্নার স্বাদ অনেকেরই জিভে লেগে আছে। একসময় গ্রামাঞ্চলের জ্বালানির প্রধান ক্ষেত্র-ই ছিল এ ঘুঁটে। অসহায় মহিলারা অর্থ উপার্জন করতেন ঘুঁটে বানিয়ে। সবাই অবশ্য ঘুঁটে বানাতে পারতেন না। এর জন্য বিশেষ দক্ষতার প্রয়োজন হতো। গরুর গোবরের সঙ্গে কী পরিমাণ তুষ মেশালে ঠিক ঘুঁটেতে পরিণত হবে, তা কেবল অভিজ্ঞ রমণীরাই জানতেন। তৈরিকৌশলে একটু হেরফের হলেই শেষ। এমনকি সন্ধ্যার সময় ঘুঁটের ধোঁয়া দিয়ে বাড়িকে মশকমুক্ত করার রীতি এখনো আছে। সিটি করপোরেশন যতই মশা মারার ওষুধ প্রয়োগ করুক না কেন, গরু বাঙালিকে মশামুক্ত রাখতে বরাবরই সাহায্য করেছে। যদিও গরু মশার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। এখনো গোয়ালঘরের পরিচিত দৃশ্য মশারি-আবৃত গরুর অলস সময় কাটানো। এমন জনবান্ধব গরু নিয়ে মারামারির রেকর্ড কোনো মহাফেজখানাতেই নেই। তবে, এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে একটা-দুইটা গরু নিয়ে কাইজার কথা মানুষের স্মৃতিপটে নেই। অবলা গরু তার প্রাণ রক্ষায় একটু-আধটু ঘাস খাওয়ার ছলে অন্যের জমির শস্য খেয়েছে- সে অপরাধে গরুর সঙ্গে তার মনিবের যে কী হেনস্থা হতে হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। আবার কখনো কখনো এই গরুই বাঙালিকে লেজে-গোবরে করে ছেড়েছে।