skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I ফ্যাশন-পোশাক-আশাক : বাঙালিনীর বদলতি তসবির -যশোধরা রায়চৌধুরী

 

গত সংখ্যার পর…


সাহিত্যের পরতে মেয়েদের ফ্যাশন-সমীক্ষা
The body: a surface on which events are inscribed…Genealogy, as an analysis of where things come from is thus situated at the point of articulation of the body and history. Its task is to show a body totally imprinted with history, and history destroying the body. –Michel Foucaoult

চলে আসি পঞ্চাশ-ষাটের দশকে। কেননা এখান থেকেই পাড়ি দেওয়া সোজা হবে সিধে সত্তর আশির দিকে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বহু লেখায় মেয়েদের সাজপোশাকের বর্ণনা পাই। রবি ঠাকুরের মতো পুঙ্খানুপুঙ্খ না হলেও, তাতে স্পষ্ট লেখা থাকে একটা দ্বৈততার কথা, সিসি লিসি বনাম লাবণ্যে যে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছে। একদিকে আছে অতি চর্চিত, মহার্ঘ, অতি সচেতন সাজগোজের উগ্রতা (পড়ুন চরিত্রের উগ্রতা), যা নায়িকা নয়, প্রতিনায়িকা অথবা সরাসরি ভ্যাম্পের রোলে ঠেলে দেয় নারীচরিত্রগুলোকে, অন্যদিকে অসচেতন, ঢলঢল কাঁচা সৌন্দর্য, যা আত্মার বিশুদ্ধতাকে দেহসৌষ্ঠব ফুঁড়ে নায়কের চোখের সামনে হাজির করছে। নায়িকারা সর্বদাই কিছুটা সাজগোজে অন্যমনস্ক হবেন, এ যেন তারপর থেকে দাঁড়িয়ে গেল বাংলা আইডিওলজির সঙ্গে সমান্তরালে, সাহিত্যশিল্পেও।
দেখা যাক, সুনীলের প্রতিদ্ব›দ্বীতে কীভাবে এসেছে এই সংজ্ঞায়ন।
‘মেয়ে দুটির নাম মালবিকা আর কেয়া। মালবিকা তার পায়ের জুতো, শাড়ির রং, আংটির পাথর, হাতব্যাগ, টিপ সব মিলিয়ে পরেছে। চুল বাঁধার ধরন দেখলেই বোঝা যায়, সে একেক দিন একেক রকমভাবে চুল বাঁধে। নিজের রূপ সম্পর্কে মেয়েটি সজাগ। মুখে সেই হালকা অহংকারের ছায়া পড়েছে। কেয়া মেয়েটি খানিকটা এলোমেলো স্বভাবের, পোশাকের পারিপাট্য নেই, কিন্তু মুখখানি তার ভারী সুন্দর- বড় বড় চোখ দুটিতে সরল সৌন্দর্য।’
এই বর্ণনা থেকে লেখকের বা তার নির্মিত নায়কের পক্ষপাত স্পষ্ট, বাংলায় এই পক্ষপাত কিন্তু চলবে, একেবারে কালবেলার মাধবীলতা পর্যন্ত। বলা ভালো সমরেশ মজুমদারে এসে বাঙালি মেয়ের এই ইমেজ কালমিনেশনে পৌঁছবে। ‘মাধবীলতাকে সে চেনে না, শুধু এটুকুই মনে হয়েছে মেয়েটি নরম এবং বোকা নয়। মাধবীলতার নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, এবং সেটাকে গুছিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বলার ক্ষমতা রাখে। এরকম সতেজ ডাঁটো আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলতে কোনো মেয়েকে অনিমেষ দেখেনি। কলকাতায় এসে নীলার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। নীলা অবশ্যই খুব ডেসপারেট মেয়ে, কোনো রকম ভিজে ব্যাপার ওর নেই। কিন্তু নীলা কখনোই আকর্ষণ করে না, বুকের মধ্যে এমন করে কাঁপন আনে না। যেকোনো পুরুষ বন্ধুর মতো নীলার সঙ্গে সময় কাটানো যায়। নীলার মানসিকতা বদ্ধ, মাধবীলতার মতো এমন দ্যুতি ছড়ায় না।’
রাবীন্দ্রিক লাবণ্যর থেকে আলাদা হয়েও আসলে কোথাও এক থেকে গেছে মাধবীলতা। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্র, বহু কলেজ পড়ুয়া ছেলেমেয়ের মতো আমারও কম বয়সের ফ্যান্টাসির উপাদান সে। সবচেয়ে বড় কথা, সে মেয়ে মেয়ে, সে নারী, অথচ নারীর যে অবয়বটি আরোপিত সেই তথাকথিত ‘ফ্যাশন’-সর্বস্ব নয়, আবার নীলার মতো ‘পুরুষালি’-ও হলে তাকে চলবে না।
এখানেও বহাল রয়েছে পুরুষের দৃষ্টিকোণ, অবশ্যই। নির্মাণ যে করছেন একজনে পুরুষই!


সিনেমার ছায়াশরীরিনীরা
Because there is so little room for expression otherwise, a lot of people love cinema because they find it a way of expressing themselves.
Mohsen Makhmalbaf

Cinema has only been around for about 100 years. Has all of the worldÕs violence towards women taken place only within the past 100 years?
Richard King

এরপরের অনেকগুলো বছর পাশ্চাত্যের ছায়াসঞ্চরণে বাঙালিনীর পোশাক ক্রমশ হয়ে উঠেছে মুম্বাই-অনুগামী। সাহিত্য থেকে আত্মপ্রকাশ মাধ্যমটির অনিবার্য পদোন্নতি যদি হয়ে থাকে সিনেমায়, তাহলে সেখানেই খুঁজতে হবে পোশাক রীতিনীতি বদলের চিহ্নগুলোকে, আর একই সঙ্গে পড়ে নিতে হবে মেয়েদের পোশাক-সম্পর্ক, সেই সঙ্গে নিজের সঙ্গে নিজের সম্পর্ককেও!
সিনেমা যখন মেনস্ট্রিম, প্রকৃত অর্থে, তখন সেখানেই পাওয়া সহজ হবে ফ্যাশনের শেষতম বিধিনিষেধ, পাওয়ার প্লে। কেমন ছিল পঞ্চাশের দশকে, ষাটের দশকে ফ্যাশনের হাল হকিকত? অজয় কর-অগ্রগামী-অগ্রদূতের পরিচালিত বাণিজ্যিক বাংলা ছবিকে ধরলে বোধ হয় পুরুষদৃষ্টির সেই একপেশেমি দেখব, নারী নির্মাণে ভালো খারাপের দ্ব›দ্ব তখনো অবিচল, এবং অতি সজ্জিতা বনাম সাদাসিধে সুন্দরীর নতুন সংজ্ঞায়ন তৈরি হচ্ছে।
মুম্বাই-মার্কা শিফন বা সিল্কের সঙ্গে বেনারসি কাপড়ের টাইট ব্লাউজ, শেষত, গ্লামারের শেষ কথা কিন্তু ৫০-৬০-এর দশকে এটাই। যে পোশাক সুচিত্রা-মাধবী-সাবিত্রীদের করত অতিরম্যা, তেল চপচপে টান করে বাঁধা চুল (হয় বিনুনি নয় খোঁপায় পরিমার্জিত ও অত্যন্ত আঁটোসাঁটো) আর ফ্ল্যাট চটির সঙ্গে। তার সঙ্গে যোগ হতো চোখের কাজলের টানটোন, কটাক্ষের চমক। কানের ঝোলা দুল, যা সুচিত্রা সেনের প্রায় একচেটিয়া। আর, প্রতিনায়িকার অহংকার আর দম্ভের অনুষঙ্গে এসে পড়ত শাড়িতে জরির অতিরিক্ত উপস্থিতি আর হাতব্যাগের ঠুঁটো ডিজাইন। (যাকে ইদানীং ফিরতে দেখছি ক্লাচ ব্যাগে!)
যদি যাই অলটারনেটিভের খোঁজে, যা নাকি আরও রিয়ালিস্টিক বলেই আমাদের অধিক আগ্রহের বিষয়? ঋত্বিক ঘটকের ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীর সাদা শাড়ি ও কালচে কাঁধ ঢাকা ব্লাউজের আটপৌরে জমকহীনতা একভাবে রচনা করত নতুন একটা বয়ান। যা ফ্যাশনের দর্প চূর্ণ করে দেয়। এ সেই চিরন্তন মৃত্তিকা-ছোঁয়া মাতৃরূপের স্নিগ্ধ ঘরানা। যা নিজেই এক অনুকরণযোগ্য মডেল।
সত্যজিতের ছবির মেয়েরা আবার এগিয়ে গেছে ছিমছাম পাশ্চাত্য পোশাকের অনুরণনে, ‘সীমাবদ্ধ’ বা ‘মহানগরের’ অ্যাংলো মেয়েদের অনুষঙ্গে (ডোর টু ডোর ক্যাম্পেনিংয়ের এডিথ অথবা বড় সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারির চরিত্রে ফ্রক বা স্লিভলেস ব্লাউজ-শিফন শাড়ি, চলতি ট্রেন্ডের হেয়ারডু লক্ষণীয়) বাঙালি মেয়েদেরও বদল ঘটেছে। মাধবী চক্রবর্তী অথবা শর্মিলা ঠাকুরের পোশাকে এসেছে অনুচ্চারিত চাপা কিন্তু স্মার্ট পোশাক-কল্পনা, শাড়িতে হালকা রং হলেও, ব্লাউজের কাটে বা বক্ষ আবরণীর ডিজাইনে সাম্প্রতিকতা প্রকট। মহানগরের মাধবীর প্রধান চারিত্র্য ছিল পেছন থেকে দেখা যাওয়া হালকা রঙের ব্লাউজ থেকে ফুটে বেরোন ব্রেসিয়ারের রেখা। এটা লক্ষ না করেছেন কোনো দর্শক, আর কেই-বা ভুলেছেন, ব্লাউজ আর শাড়ির সন্ধিস্থলে পেন গুঁজে রাখা ‘নায়কে’র অদিতিকে?
অথবা প্রতিদ্ব›দ্বীর আপওয়ার্ডলি মোবাইল মেয়ে সুতপা খুঁজে নিয়েছে অফিসে বসের মনোরঞ্জন ও পার্টিতে বল ডান্স করার উপযোগী শরীর কামড়ে থাকা ভয়েলের শাড়ির চটুলতা, যা তার মডেলিং-কামনার সঙ্গে একেবারে মানানসই। সুনীলের বর্ণনায়, মূল উপন্যাসে যে মেয়েটি এই রকম: ‘সুতপা এক হাত দিয়ে শাড়িটা একটু উঁচু করে পা টিপে টিপে হাঁটছে। একটা ময়ূরকন্ঠী রঙের ছাপা শাড়ি পরেছে সুতপা, হাতে একটা সাদা রঙের ব্যাগ। তাকে এখন একজনে পুরোপুরি মহিলা বলা যায়। সুতপার বুক দুটি ভরাট সুগোল, হাঁটার ভঙ্গিতে খানিকটা মাদকতা মাখানো, ফরসা মুখটাতে একটা অন্য রকম আভা।’ পুরুষের নির্মিতি হলেও, নিজের অজান্তেই সুনীল কিন্তু ভেঙে ফেলেছেন ছাঁচ, ব্যবহারহীন একরকমের আত্ম-পরিতৃপ্ত চরিত্র হিসেবে সৃষ্টি করে ফেলেছেন সুতপাকে, সত্যজিৎ যাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন, ছাতে, একলা একলাই, কাল্পনিক পুরুষ সঙ্গীর কাঁধে হাত রেখে নেচে চলতে।
এখানে কিন্তু স্পষ্টই দেখতে পাব একটা ব্যাপার। মার্ক্স সাহেবের চোখ দিয়ে না দেখলেও, সহজেই আমাদের চোখে পড়ে যায় এই তথ্য যে, মেয়েদের সাজগোজের ব্যাপারটা আর রাবীন্দ্রিক যুগের মতো দৃষ্টিনান্দনিকতায় নিছক আবদ্ধ থাকছে না, অন্য ভাষায় যাকে বলা যায়, প্রিয় পুরুষটির মনোরঞ্জনের জন্যই সাজ (সে হোক নিখিলেশ অথবা সন্দীপ, পুরুষকে উদ্দিষ্ট করেই ঘটছে ঘটনাটা)। বরঞ্চ ঘরের বাইরে বেরিয়ে পেশাগত কোনো না কোনো কাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সাজার ব্যাপারটা এসে পড়ছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা জরুরি উপাদান হিসেবে। ব্যক্তিত্ব নির্মাণের উপাদান।
মানে, অন্য এক ক্ষমতার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে নারীর শরীরটি।
মেয়েরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন ৫০-৬০-এর দশকে। গৃহবধূর পাটভাঙা “পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে সিঁদুর’-এর ছাঁচ ভেঙে বাধ্য হয়ে রুজি-রুটির জন্য পথে নামছেন । সঙ্গে সঙ্গেই, ফ্যাশনের একটা কেজো, প্র্যাগম্যাটিক, ব্যবহারমুখী মধ্যবিত্তায়ন ঘটে যাচ্ছে। সেই মধ্যবিত্তায়নের বয়ানের ভেতরেই ধরা থাকছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ অথবা ‘কোমল গান্ধারে’র পার্টিশন-তাড়িতা নায়িকার আটপৌরে কিন্তু কর্মঠ পোশাক (সাদা শাড়ি, সঙ্গে ঝোলা) টিপিকাল হয়ে উঠেছিল কেরানি/স্কুল শিক্ষিকা/অধ্যাপিকা/অবিবাহিতার। মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত মেয়ের ছিমছাম পারিপাট্য ও সাদাসিধে বেশবাসের একটা প্রোটোটাইপ তৈরি হয়ে উঠছিল, বা উঠেছে। অন্যদিকে সাহেবি কোম্পানি অথবা নবলব্ধ স্বাধীনতার প্রেক্ষিতে ভারতীয়দের জমানার নতুন নতুন সব পেশা এক্সপ্লোর করতে আসা মেয়েদের (বাড়ি বাড়ি সেলাই মেশিন বিক্রি করা যার ভেতরে প্রতিনিধিত্বপূর্ণ কাজ) ভেতরে নতুন নতুন পণ্য ব্যবহারের ঝোঁক ও ঝুঁকি (মনে করুন মহানগরের লিপস্টিক ঘটনা, অথবা প্রতিদ্ব›দ্বীর বসের স্ত্রীর বাড়ি বয়ে এসে কুৎসা গেয়ে যাওয়া) বাড়ছিল।
চোখ রাখুন আগামী সংখ্যায়…

[লেখা: লেখকের ব্লগ থেকে]

মডেল: সূর্য, মাহি, সায়রা ও শ্রাবণী
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস
ওয়্যারড্রোব: বিশ্বরঙ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top