বিশেষ সাক্ষাৎকার I কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি
এশিয়ান আর্ট বিয়েনাল ২০১৮। এই সৃজন মহোৎসবে এবার অংশ নেন দিনেমার শিল্পী শেফালি রনটি। প্রদর্শিত হয়েছে তাঁর এক জোড়া পেইন্টিং। স্মৃতির মুক্তা ছড়ানো ক্যানভাসে বস্তুত বাংলাদেশকেই প্রতীয়মান করতে চেয়েছেন তিনি। সম্প্রতি এক সন্ধ্যায় শেফালি-সান্নিধ্যে তাঁর সৃজন, ব্যক্তি আর শিকড়বিচ্ছিন্ন এক শিল্পীসত্তার স্বরূপ সন্ধানের প্রয়াস পেয়েছেন শেখ সাইফুর রহমান
আমি শিল্পী বা শিল্পবোদ্ধা নই। ফলে তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত না হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুভানুধ্যায়ী কায়সার বাবু ভাইয়ের কাছ থেকে শিল্পী সম্পর্কে অবগত হয়ে তাঁর সান্নিধ্যসুখ উপভোগে লুব্ধ হই। বাবু ভাই সেই রাতে ফোনটা ধরিয়ে দিলে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। পরদিন সন্ধ্যায় আমাদের মুখোমুখি বসিবার ক্ষণ নির্ধারিত হয়। তার আগে শিল্পীর কাজগুলো ভার্চ্যুয়ালি দেখার চেষ্টা করি। আকাশভরা সূর্য-তারার মতোই ক্যানভাসজুড়ে উজ্জ্বল সব রঙের দেয়ালা। সবই শিশুদের জন্য। কাজগুলো দেখতে দেখতে আমি সাদৃশ্য খুঁজে পেতে থাকি হাশেম স্যারের (শ্রদ্ধেয় শিল্পী হাশেম খান) কাজের সঙ্গে। যেখানে মাছ, পাখিদের সানন্দ সহাবস্থান। তবে এই শিল্পীর ক্যানভাসে বর্ণের উদ্ভাস ¯সিগ্ধ আবহ তৈরি করে। শোনায় জীবনানন্দের রূপকথা।
তাঁর রঙিন ভুবনে আবর্তনের আনন্দ নিয়ে পরদিন যথাসময়ে হাজির হয়ে যাই সোনারগাঁও হোটেলের লবিতে। রাত তখন ৯টা। হঠাৎ দেখায় তাঁকে ক্যারিবীয় বা লঙ্কাতনয়া বলে ভ্রম হতে পারে। মুখোমুখি বসি আমরা।
শুরু হয় কথা। একটি-দুটি পোশাকি প্রশ্নোত্তরের বেড়া ডিঙিয়ে বহুচেনা বন্ধুর মতো আড্ডায় মেতে উঠতে সময় লাগে না। শিউলি তাঁর গল্পের ঝাঁপি উপুড় করে দেন। সেসব সত্যিই হাসি-কান্নায় মোড়ানো হীরে-পান্না।
অদ্ভুত এক পরিযায়ী জীবন বয়ে চলেছেন মাঝ চল্লিশের এই কৃষ্ণকলি। ভবিতব্য তাঁকে সেই কোন ছেলেবেলায় ঠাঁইনাড়া করেছে। করেছে তো করেইছে। এখনো থিতু হতে পারেননি। বর্তমানে দুবাইতে থাকলেও সেখান থেকে আরও একবার ঠিকানা বদল হবে তাঁর। হয়তো বছর দুয়েকের মধ্যে। সেই আভাসও শিউলি কথায় কথায় দিয়ে দেন।
চট্টগ্রামে জন্ম। স্বাধীনতার বছর দুয়েক পরে। গ্রামের নাম তাঁর মনে নেই। ছয় বছর যখন বয়স, দাদু তাঁকে ঢাকার এক খ্রিস্টান মিশনারিতে দিয়ে দেন। স্থানীয়দের ধারণা ছিল, তাঁকে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ সেই অপবাদ দীর্ঘদিন বয়ে বেড়িয়েছেন। তবে ২২ বছর আগে দেশে ফিরে শিকড়সন্ধানী শিউলির সঙ্গে দেখা হয় তাঁর দাদুর। ফলে শান্তিতে অন্তত মরতে পেরেছেন তিনি। শিউলির জন্য এ এক অনাবিল স্বস্তির। ছেলেবেলায় মা তাঁদের ছেড়ে যান। বিয়ে হয় আরেকজনের সঙ্গে। তাঁকে আশ্রমে দেওয়ার সেটাও একটা কারণ বৈকি। কিন্তু বিধি বাম হলে যা হয়। মা শব্দটা কোনোকালেই যেন আপ্লুত করতে পারেনি। দিতে পারেনি মমতা, উষ্ণতা আর নিরাপত্তা। অন্য কেউ হলে হয়তো বিরূপ হতো। বিক্ষুব্ধ হতো। শিউলি তা হননি। বরং নিজে সত্যিকারের মা হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন। করে যাচ্ছেন অহর্নিশ। কেবল নিজের সন্তানদের (এক মেয়ে ও এক ছেলে) জন্য নয়, অন্যের সন্তানদের জন্যও। হয়তো তাই, তাঁর ক্যানভাস সত্যিকারের মাময় আনন্দ নিকেতন।
শিউলির বয়স তখন মাত্র ৬। ১৯৭৯। তাঁকে আশ্রমে দিয়ে দেওয়া হয়। জীবনে সেটা ছিল একটা বড় ধাক্কা। তাই আশ্রমে তিনি ভীষণই স্তব্ধবাক থাকতেন। তবে একটা গান আজও তাঁর মনে আছে। সবাই মিলে গাইতেন আর তিনি শুনতেন… ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে…। দুই লাইন গেয়ে শোনান তিনি। সে বছরই তাঁকে দত্তক নেয় এক দিনেমার পরিবার। নাম রাখা হয় অ্যান রনটি। রাজধানী কোপেনহেগেনে নয়, তাদের বাস পুব উপকূলের শহর আরহুসে। কিন্তু ভাগ্য পুনর্বার তাঁকে নিয়ে মশকরায় মেতে ওঠে। নতুন একটা জায়গায় গিয়ে কয়েকটা বছর না কাটতেই আবারও মা হারা হন। এবারও পরপুরুষের আকর্ষণ। বিচ্ছেদ হয়ে যায় রনটি দম্পতির। মা অন্যত্র সংসার পাতেন। বাবাকে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য কাজ করতে হয়। বাইরে যেতে হয়। ফলে ছয়-সাত বছরের মেয়েটাকে দ্রুত বড় হয়ে উঠতে হয়। শিখে নিতে হয় দিনেমার ভাষা। শিখে নিতে হয় কাজ। সারা দিন পর বাবা এসে অবশ্য তাঁকে রান্না করে খাওয়ান। স্কুলে যাওয়াও শুরু হয়েছে ততোদিনে। কিন্তু অনেক কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না। অথচ তাঁকে একের পর এক ক্লাস টপকে উঁচু ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া হয়। বয়সও বাড়ে সময়ের নিয়মে। কিন্তু শিশু থেকে কিশোর থেকে নারী হয়ে ওঠার পর্বগুলো পেরিয়ে যান মাঝবয়সী এক পুরুষের সঙ্গে থেকে। সেটা তাঁর পালকপিতা। কিন্তু শেখা হয় না তাঁর অনেক কিছুই। না স্কুলের পাঠ, না জীবনের। আজও সেই অতৃপ্তি তাঁর মনোবেদনার কারণ হয়। তবে নিজের বাচ্চাদের জন্য সত্যিকারের মা হয়ে ওঠেন শিউলি। অন্তত চেষ্টা করেন আন্তরিকভাবে। অনেক সময় অনভিজ্ঞতার কারণে হয়তো হয় না। সে কথা স্বীকারেও অকপট এই সৃজনমানবী নিজের স্কুলজীবনের অসহায় পরিস্থিতিতে ত্রাতারূপে অবতীর্ণ হন এক শিক্ষক। তখন ক্লাস নাইন। বেছে নিতে হবে পরবর্তী লক্ষ্য অনুযায়ী বিষয়। বাবা চান এক। অথচ শিউলি তো সে জন্য প্রস্তুত নন। হয়ে ওঠেননি। সেই শিক্ষক তাঁকে বলেন, তোমার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা আছে। তাই তুমি সে পথেই যাও। তিনিই এ জন্য শিউলির বাবাকে বুঝিয়ে রাজি করান। কেবল আঁকা নয়, নাচ আর গানেও ছিল শিউলির পারঙ্গমতা। এমনকি তিনি লন্ডনের ফেম স্কুলে নাচ শেখা এবং নাচ নিয়ে পড়ার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যয়ভার বহনের সামর্থ্য ছিল না। অর্ধেক সরকার দিলেও বাকিটা দিতে পারেননি তাঁর বাবা। ফলে সেই স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিতে হয়েছে।
হঠাৎই শিউলি বলেন, জানো, বড় হওয়ার পরও আমার বাইরে যাওয়ার, বন্ধুদের সঙ্গে মজা করার অনুমতি মিলত না। বাবা চাইতেন না। তাই অ্যাডাল্ট হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে নিজে থাকতে শুরু করে প্রথম বছরটা আমি জীবনকে উপভোগ করেছি। যাকে বলে আশ মিটিয়ে।
শিউলি বলে চলেন, আমি মাঝেমধ্যেই গির্জায় গিয়ে বসে থাকতাম। ক্রুশবিদ্ধ যিশু আমাকে দুদন্ড প্রশান্তি দেন। সেখানে বসে বসে এঁকেছি। একদিন আমার আঁকা দেখে এক ওলন্দাজ শিল্পী বলেছিলেন, দেখো, তুমি একদিন বিখ্যাত শিল্পী হবে। আমি আজও সেই ব্যক্তিকে খুঁজে ফিরছি। তাঁকে পেলে বলতে চাই, আপনার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হয়েছে। আমি শিল্পী হয়েছি। গ্রেট হয়েছি কি না জানি না। বলতে বলতে তৃপ্তির উদ্ভাসে উজ্জ্বল হয় এই লাবণ্যময়ীর মুখাবয়ব।
কম্পিউটার আসার আগে তো সবকিছু হাতে আঁকতে হতো। ফলে গ্রাফিক ডিজাইনকে বেছে নেওয়ার মূলত সেটাই ছিল কারণ। গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে সিঙ্গাপুর আর লন্ডনে কাজ করেছেন। পরবর্তী সময়ে অবশ্য পেইন্টিং শিখেছেন। কিন্তু সেটাও এক মজার বিষয়ে। নন্দনতত্ত্ব। তবে তা শিশুদের উন্নয়ন আর দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজে লাগানোর জন্য। ফলে ক্যানভাসজুড়ে তারই দ্যোতনা। পঞ্চাশ দশকের শিল্পদল কোবরা আর আভাঁ গার্দ আন্দোলনে প্রাণিত শিউলির রঙেরা গল্পকথক। তার অনন্য স্টাইল মুগ্ধতা ছড়ায়। আধাবিমূর্ত, শিশুতোষ, স্বতঃস্ফূর্ত আর সারল্যে বাঙ্্ময় মাছ, সাপ, পাখি আর শিশুরা। কারও সঙ্গে সেভাবে মেলানো যাবে না। সাপ তার কাছে স্মৃতির মণিকাঞ্চন। চট্টগ্রামে তাদের মূল জীবিকাই ছিল মাছধরা। বর্ষাকালে মাছ ধরতে যেয়ে একাধিকবার সাপে কামড়েছে। সাপ তাই তাঁর ক্যানভাসে মূর্ত হয়েছে বারবার।
শিউলির সবচেয়ে আলোচিত সিরিজ ‘জয় অব লাইফ’ আর ‘ট্রিবিউট টু মাদার’। একাধারে তিনি যেমন জীবনের আনন্দ খুঁজে বেড়ান, তেমনি যেন হারায়ে খোঁজেন মাকে। নিজের মা কিংবা পালক মা। কিংবা বলা যেতে পারে মা হয়ে ওঠার প্রাণান্ত প্রয়াস অব্যাহত রাখেন আমার সামনে বসে অনর্গল কথা বলে চলা এই কৃষ্ণকলি। তাঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর বয়স। তাঁর আর আমার বয়স নিয়ে তাই খানিক হাসাহাসি করি আমরা। জানা হয় পোশাকের প্রতি তাঁর আকর্ষণ। নিজের ডিজাইন করা কালো কামিজের মতো টপসের সঙ্গে কালো সালোয়ার-প্যান্টে বেশ লাগে তাঁকে। শিয়ার ফ্যাব্রিকের ব্যবহারে টপসকে অ্যাসিমেট্রিক বলে ভ্রম হতে পারে। কানে পরেছেন দুল। সেটাও নিজের আঁকা। তবে এসবই নিজের জন্য। বাণিজ্যিক নয়। ডেনমার্ক ছাড়াও সুইডেন, ঘানা আর দুবাইতে পড়েছেন শিল্প বিষয়ে। ডেনমার্ক, দুবাইসহ তাঁর শিল্পকর্মের প্রদর্শনী হয়েছে বিশ্বের নানা দেশের নানা শহরে। পরিব্রাজকের মগ্নতায় ঘুরেছেন বহুদেশ। বর্তমানে শিউলির প্রতিনিধিত্ব করে নিউইয়র্কের আন্তর্জাতিক গ্যালারি ক্যারে ডি আর্টিস্ট। বিভিন্ন জায়গায় তার প্রদর্শনী হচ্ছে।
গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে গিয়েই পরিচিত হন এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনিই এখন তাঁর অর্ধেক জীবন। দীর্ঘদিন থেকেছেন একসঙ্গে। তারপর দুবাই আসার আগে বিয়ে করে সম্পর্ককে দৃঢ়তর করেছেন।
স্বীকৃতি আর সম্মাননায় ঋদ্ধ জীবন। সবশেষ ২০১৬ সালে ভূষিত হয়েছেন দুবাই ইন্টারন্যাশনাল আর্ট সিম্পোজিয়াম সম্মাননায়। কিউরেট করছেন ইভেই আর্ট কম্পিটিশন ‘ডিসকভার ইওরসেল্ফ’। শারজাহ ইন্টারন্যাশনাল বিয়েনাল ফর চিলড্রেন’স আর্ট জুরিবোর্ডের অন্যতম সদস্যও তিনি।
১৯৯৬ সালে শিকড়সন্ধানী শিউলির দেশের ফেরার অভিজ্ঞতা মধুর ছিল না। পরবর্তীকালে তাকে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। সেই আতঙ্ক আর হতাশায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। তবে এবার এসে তিনি অন্য বাংলাদেশ আবিষ্কার করেছেন। ফিরে গেছেন দারুণ এক প্রশান্তি নিয়ে। চেয়েছেন বারবার ফিরে আসতে। পরমানন্দ খুঁজে ফেরা শিউলির কণ্ঠে যেন ছিল জীবনানন্দের অনুরণন: আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে- এই বাংলায়/ হয়তো মানুষ নয়, হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে।…
কথায় কথায় যে রাত যথেষ্ট হয়ে গেছে, তা টেরই পাইনি আমরা। পরদিন সকালে তাঁকে ছুটতে হবে এয়ারপোর্ট। কিন্তু কখনো মনে হয়নি সেই তাড়া তাঁর আছে। তাই তো অবলীলায় বললেন, রাতে না হয় আর ঘুমোবো না। কথায় কথায় রাত পার করে দেওয়া যায় তাঁর সঙ্গে। তবু তাঁকেও যেমন যতি টানতে হয়, আমাকেও। অসাধারণ এক সন্ধ্যার রেশ রেখে বিদায় নিতে হয়।
পুনশ্চ: তার পোশাকি নাম অ্যান রনটি। আর খ্রিস্টান মিশনারিতে দেওয়া নাম শেফালি। এই নামটাই তিনি ধারণ করেন। আবিশ্ব পরিচিতিও। আমাদের কাছে শেফালিই তো শিউলি।
sksaifurrahman@gmail.com
ছবি: ক্যানভাস ও শেফালির ব্যক্তিগত সংগ্রহ