ফিচার I পানকীর্তন
বিয়েতে পানচিনির পর্ব মুছে গেলেও পানবিলাসীরা হারিয়ে যাননি। তাদের জন্যই রাজধানীতে পানের বিশেষ পসরা আজও জমজমাট
‘নতুন মুখের নতুন কথা শুনিতে সুন্দর/ মাঝে মাঝে পান চিবাইতো হাসির ভিতর…’
এম এন আক্তার রচিত প্রেমের গানের দুটি লাইন। প্রেমিকের মুখের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রেমিকা হাসির ভেতর পান চিবানোর কথা বলেছেন। পান এমনই জড়িয়ে আছে বাঙালির প্রেমে ও সংস্কৃতিতে। বিয়ের সম্বন্ধও শুরু হয় পান দিয়ে। বরপক্ষ কনের বাড়িতে এসে যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দেয়, সেদিনের পর্বকে ‘পানচিনি’ বলা হয়। আমরা এই অনুষ্ঠানকে পাকাকথা নামেও জানি। পানচিনির জন্য বর-কনে উভয় পক্ষের কিছু প্রস্তুতি থাকে। বরপক্ষের যারা কনের বাড়ি যান, তারা সঙ্গে নিয়ে যান নানা ধরনের মিষ্টি ও পান-সুপারি। বেশি পরিমাণে মিষ্টি ও পান-সুপারি নেওয়ার মধ্য দিয়ে আভিজাত্য প্রমাণ করা হতো। অভিজাত বরপক্ষ পানের সঙ্গে বাহারি মসলা পাঠাতে। অবশ্য এসব চল আগের মতো নেই। অনুষ্ঠানটির সেই জৌলুশও বিলুপ্ত। অনেকের বিয়েতে পানচিনি অনুষ্ঠান হয়ও না।
তবে বর্তমানে পানের মহিমা ধরে রেখেছে নগরীর এখানে-ওখানে ছড়িয়ে থাকা কিছু পানের দোকান। এগুলো সাধারণ পানের দোকান নয়। একেকটি দোকানে ২০ থেকে ২৫ পদের পানের খিলি বিক্রি হয়। সুপারি ছাড়াও একেকটি পানে দেওয়া হচ্ছে ১৫ থেকে ২০ প্রকারের মসলা। চেনা-অচেনা এ মসলাগুলো পানের স্বাদকে ব্যতিক্রমী মাত্রা দিয়েছে। তাই পানবিলাসীরা ভিড় করেন এসব দোকানে। অনেকেই আছেন, যারা শুধু পান বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করছেন। গুলশানের মো. শামীম তাদের একজন।
গুলশান ১ নম্বর থেকে ২ নম্বরের দিকে যেতে বাম পাশে ওয়ান ব্যাংক। সেখানে ফুটপাতের এক কোণে মো. শামীমের দোকান ‘পান দরবার’। অস্থায়ী। দোকান খোলা হয় সন্ধ্যার পর। চলে রাত ১২টা পর্যন্ত। পান বেচা ছাড়া আর কোনো কাজ করেন না শামীম। ৩০ বছর ধরে পান বিক্রি করছেন ৫০ বছর বয়সী এই ব্যক্তি। এর আগে পান দরবারের দায়িত্বে ছিলেন তার বাবা। প্রতিষ্ঠাতা তার দাদা। পাকিস্তান আমলে। কত সাল থেকে শুরু, তা সঠিকভাবে বলতে পারেন না। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো সন্ধ্যা ৬টায়। সবে দোকান খুলেছেন। ভেতরে বসে পান সাজাচ্ছিলেন। শাহি পান। পান পাতার উপর একে একে ঢেলে দিলেন নানা রকমের মসলা। মিষ্টি আচার, গ্লুকোজ, নারকেল, মোরব্বা, রাসিলি, মধু, পান পরাগ, রজনীগন্ধা, শেখর, চিরাঙ্গা, সারগল মাওতাজ ও চুটকি। এ মসলাগুলো অনেকের কাছেই অচেনা। নাম পড়ে হয়তো বুঝতে পারছেন না। শামীম জানালেন, একেক পান বিক্রেতা এসব মসলাকে একেক নামে চেনে। স্থানভেদে এই ভিন্নতা। শাহি পানের এক খিলির দাম ২০ টাকা। পান দরবারের অন্যান্য পানের তুলনায় শাহি পানই সস্তা। তাই এর চাহিদাও বেশি। মোট ১৭ প্রকার মিষ্টি পান পাওয়া যায় পান দরবারে। মসলা আছে শতাধিক। মসলার পরিমাণ বাড়লে পানের দামও বাড়ে। বেশির ভাগ মসলাই আসে ভারত থেকে। শুধু সুপারিই আছে ২০ রকমের। যেগুলোর ১৮টিই ভারতীয়। পানের পাতা হয় দুই ধরনের। কিছু আসে ভারতের বিহার থেকে আর কিছু বাংলাদেশের মহেশখালী থেকে।
বিহারের পান কেমন হয়, তা খেয়ে দেখার ইচ্ছা হলো। বলতেই এক খিলি তৈরি করতে বসে পড়লেন শামীম। গুলকান, গ্লুকোজ, নারকেল, মোরব্বা, সবদানা, পপাইয়া, খেজুর, জোয়ান, মৌরি, হীরামতি, রোজ, স্ট্রবেরি ও চকলেট নামের মসলা সহযোগে এক খিলি বিহার পান মুখে পুরে নিতেই মিনিটখানেকের মধ্যে মিলিয়ে গেল! শুধু স্বাদটাই থেকে গেল মুখে। মিষ্টি স্বাদ, জিভে ঠান্ডা ভাব। এ পানের দাম ৫০ টাকা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিহার পান খাওয়া শেষ। তাতে আরেকটি পান খাওয়ার অজুহাত পাওয়া গেল। এবার বললাম মুম্বাই পান বানাতে। কিছুটা সময় লাগলো খিলি তৈরিতে। পানে দেওয়া হলো রাসিলি, চাটনি, ভুটান থেকে আসা চেরি ফল, নারকেল, মেওয়া, ডিলাক্স, সিলভার সুপারি, খই, পান পরাগ, কেশর, মসলা সুপারি, আইসক্রিম, মধু, হীরামতি, সিরা, গরম মসলা, তবক। আইসক্রিম একধরনের মসলার নাম। খিলি মুড়ে দেওয়া হলো খাবারযোগ্য রুপার পাতলা আবরণে। মুম্বাই পানের স্বাদ বিহার পানের চেয়েও বেশি। এর কারণ মসলার অধিক্য। পানের দাম পড়লো ১২০ টাকা।
পান দরবারে আরও যেসব পান পাওয়া যাবে সেগুলো হচ্ছে: নবাবি ঠান্ডা, বিহার, বেনারসি, হায়দরাবাদি, সাদা খুশবু, স্ট্রবেরি, আজমিরি, সুলাইমানি, স্প্যানিশ জাফরানি, চকলেট, চুসকি, সুপারি, কাটিয়ার ও ভিআইপি। দাম পড়বে ২০ থেকে ১৫০ টাকা। পার্সেলও পাওয়া যায়। সুন্দর একটি কাগজের বাক্সে।
পানের আরেকটি স্থায়ী দোকানের নাম ‘পান সুপারী’। এর অবস্থান ধানমন্ডির ৪ নম্বর রোডে। মমতাজ প্লাজার নিচতলায়। এ ছাড়া বনানী, বসুন্ধরা ও বিমানবন্দর এলাকায় এর শাখা আছে। ধানমন্ডি ৪ নম্বরের পান সুপারীর দোকান রীতিমতো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এর প্রতিষ্ঠাতা নারী উদ্যোক্তা কণা রেজা। ২০০৩ সালের ২১ নভেম্বর যাত্রা শুরু করে পান সুপারী।
এ দোকানে পান আসে মহেশখালী থেকে। এর বিভিন্ন পানের মধ্যে আছে: পান সুপারী লাল, পান সুপারী সবুজ, পান মায়সুরী, পান বানারসী, পান রেগুলার, পান হায়দ্রাবাদি, টেন ও ক্লক নাইট পান, পান সুপারী রুপা, পান সুপারী সোনা, পান সুপারী (নবযতী), পান আফসানা (ডায়াবেটিক), পান-এ-খুশ, পান স্পেশাল ডাবল শাচি, বাংলা পান, বৌ পান, জামাই পান, পান সুপারী স্পেশাল। মসলা অনুযায়ী একেকটি পানের দাম পড়বে ২৫ থেকে ২২০ টাকা। তাতে ব্যবহৃত হয় কিশমিশ, এলাচি, লাল ও সাদা খোরমা, কাঠবাদাম, পেস্তা, মধু, জায়ফল, জয়ত্রী, দারুচিনি, মোরব্বা, চেরি ও জাফরান। এ ছাড়া বিশেষ ধরনের হারবাল পানি ব্যবহার করা হয়। এই পানি ৮০ রকম প্রাকৃতিক উপাদান থেকে তৈরি। খুরমা, বাদাম ও পেস্তা আনা হয় আরব কিংবা ভারত থেকে। শুধু পান ও সুপারিই হয় দেশি।
সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, অর্থাৎ বিয়ের মৌসুমে তারা ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার পানের অর্ডার পান। এ ছাড়া প্রতিদিন সন্ধ্যায় এ দোকানে পানবিলাসীদের ভিড় লেগেই থাকে।
পিলে চমকে ওঠা একধরনের পানের নাম আগুন পান। পানের মধ্যে রকমারি মসলা দিয়ে তার ওপর আগুন ধরিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুরে দেওয়া হয়। শুনতে ভীতিকর হলেও এ পানের ক্রেতা কিন্তু কম নয়। এটি মেলে পুরান ঢাকার নাজিরা বাজারের চার রাস্তার মোড়ে ‘আল্লাহর দান জলিলের মিষ্টি পান’ নামের একটি দোকানে। পরিচালনা করেন আবদুল জলিল। আগুন পান খেতে আসা গ্রাহকদের চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় তাকে। একেকটি আগুন পানে ১৮ রকম মসলা ব্যবহার করা হয়। ঘি, মধু, মোরব্বা, নারকেল, জেলি, খেজুর, রকমারি পান মসলা ইত্যাদি দিয়ে এই পান বানানো হয়। একেকটি পানের দাম ৪০ টাকা।
আগুন পান ছাড়াও সেখানে মিলবে দিলখোশ পান, শাহি পান, বেনারসি পান, বউ জামাই পান, কিমাম পান, মুম্বাই পান ও কস্তুরী পান। এগুলোর দাম সর্বনিম্ন ১৫ থেকে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা। ২৪ ঘণ্টাই দোকান খোলা থাকে। এ ছাড়া নগরীর পথে-ঘাটে ঘুরে বেড়ান ভ্রাম্যমাণ পান বিক্রেতারা। তাদের মিষ্টি পানের স্বাদও বেশ। সময়-সুযোগ পেলে একদিন পানমুখ করে নিতে পারেন রাজধানীর বিশেষ পানের দোকানগুলো থেকে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সজীব রহমান ও ক্যানভাস