আলাপন I ডিজাইনারদের ডিজাইনার
এড্রিক অঙ। বহুমুখী প্রতিভাধর এক সৃজন ব্যক্তিত্ব। মালয়েশিয়ার সারাওয়াক থেকে শিকড় ছড়িয়েছেন সারা বিশ্বে। সৃষ্টিসম্ভারে আবিশ্ব জয় করে চলেছেন বছরের পর ধরে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া এই নকশাব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতেছেন শেখ সাইফুর রহমান
বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের শেষ দিনে এড্রিকের সঙ্গে আমাকে এক শুভাকাঙ্ক্ষী পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। তাঁকে অবাক করে এড্রিক বলেন, আই নো হিম সিন্স হি ইজ আ বয়। আসলেই তাই। অসাধারণ প্রতিভাধর এই মানুষটার সঙ্গে আমার কবে পরিচয়, তা আজ আর মনে করতে পারি না। অনেকবারই মনে হয়েছে তাঁর সঙ্গে সময় বের করে আনুষ্ঠানিক আলাপনে মেতে উঠি। দেশে-বিদেশে নানা সময়ে দেখা হওয়া সত্ত্বেও কেন জানি কথা বলা হয়ে ওঠেনি। গেল মাসে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকে এসেছিলেন এড্রিক। এবার আমি নাছোড়। কথা তাঁর সঙ্গে বলতেই হবে। তাই চলে যাওয়ার দিন সাতসকালে ধুম বৃষ্টির মধ্যেই হাজির হয়ে যাই তাঁর ডেরা হোটেল লা মেরিডিয়ানে।
স্থাপত্য নকশা দিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর পেশাজীবন। পড়েছেন স্থাপত্যবিদ্যা। তাতেও তিনি কৃতবিদ্য। সারাওয়াকের কুচিং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সারাওয়াক কালচারাল ভিলেজসহ মালয়েশিয়ার অনেক উল্লেখযোগ্য স্থাপনার নকশা তাঁর করা। কেবল স্থাপত্য নকশা নয়, দেশের ঐতিহ্য সংরক্ষণ আর সেসব নিয়ে কাজ করা এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার আগ্রহ থেকেই তিনি হয়ে উঠেছেন ফ্যাশন, টেক্সটাইল ও ক্র্যাফট ডিজাইনার। লিখেছেন একাধিক বই। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানা প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট কাউন্সিলের উপদেশক। আশিয়ান হ্যান্ডিক্র্যাফট প্রমোশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের (আপাডা) দ্বিতীয়বারের প্রেসিডেন্ট। গবেষক এবং বক্তা। প্রতিষ্ঠা করেছেন ওয়ার্ল্ড ইকো-ফাইবার অ্যান্ড টেক্সটাইল নেটওয়ার্ক। ফটোগ্রাফি করেন। কিউরেট করেছেন অসংখ্য প্রদর্শনী। তাঁর সংগ্রহ সমৃদ্ধ নানা সম্মাননায়। ২০১৬ সালে সম্মানিত হয়েছেন মার্সিডিজ বেঞ্জ/স্টাইলো এশিয়ান ফ্যাশন অ্যাওয়ার্ডে, ২০০৯ সালে হয়েছেন মালয়েশিয়ান ডিজাইনার অব দ্য ইয়ার, এইড টু আর্টিসান অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন ২০০৬ সালে। এই তালিকা দীর্ঘতর। তাঁর কালেকশন পাওয়া যায় কুয়ালালামপুরের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারে, লঙ্কাউইয়ের দ্য দাতাইয়ে, সিঙ্গাপুরের টাঙ্গসে, ব্যাংককের গেসর্ন প্লাজা আর সিয়াম প্যারাগনে। এ ছাড়া জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া আর যুক্তরাষ্ট্রে।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষ এখন বিশ্বের সৃজনভুবনে মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সারাওয়াকের সৃজনসৌরভ ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বের নানা প্রান্তে।
আমাদের কথা শুরু হয় নাশতার টেবিলে। প্রথমত তিনি আর্কিটেক্ট। অথচ আর্কিটেকচার ছেড়ে কেন অন্য ভুবনে? প্রশ্নটা স্বাভাবিক। আর তা জানার কৌতূহল হয় বৈকি!
সব সময় লেগে থাকা মৃদু হাসির রেশ ছড়িয়ে এড্রিক বললেন, আর্কিটেকচার ইন্টারেস্টিং। কারণ, এটা তো হ্যাবিট্যাট ফর হিউম্যানিটি। এখানে গলাগলি করে আছে আর্টস আর সায়েন্স। প্রযুক্তি, অঙ্ক, পদার্থবিদ্যার সঙ্গে শিল্পসংস্কৃতি আর নন্দনতত্ত্বও জানতে হয়। কারণ, বাস করবে মানুষ। জীবনের নানা কিছু আবর্তিত হবে। স্থাপত্য নকশাকে আমি এভাবেই দেখি।
অসংখ্য হোটেল, রিসোর্ট, কালচারাল প্রজেক্ট, মিউজিয়াম ডিজাইন করেছেন এড্রিক। তবে তাঁকে একটু থামিয়ে জানতে চাই, ফ্যাশন ডিজাইনে কবে থেকে?
— পাউরুটিতে মাখন মাখাতে মাখাতে জানান, স্থাপত্য নকশা করার সমান্তরালে আমি ক্র্যাফট ডিজাইন করেছি। আরেকটা মজার বিষয় কি জানো, মানুষের শরীরও একটা স্ট্রাকচার। কখনো স্থবির থাকে, কখনো গতিশীল। ফলে সেটা মাথায় রেখেই কিন্তু তার আবরণের নকশা করা হয়। সেখানে আরও জানতে হয়, জলবায়ু, ভূপ্রকৃতি, সংস্কৃতি ইত্যাদি। আমি এখন সেই কাজটিই করে যাচ্ছি। তবে এখানে আমি স্বাধীন। এ জন্য আমাকে ভাবতে হয়, সেই মতো কাপড় তৈরি করতে হয়। আমি টেক্সটাইল ডিজাইন করি। ডাই করি। তারপর পোশাক তৈরি করি।
স্থাপত্য নকশা আর ফ্যাশন ডিজাইনে মিল-অমিল তো আছেই। আর সেটা তাঁর মুখ থেকেই শুনে নিতে চাই। এই প্রসঙ্গে অকপট এড্রিক, আমি যেটা সৃষ্টি করি, ক্রেতাকে সেটাই নিতে হয়। কেউ একটা ডিজাইন এনে আমাকে দেখালে আমি তো তা বানিয়ে দিই না। কারণ, আমার সৃষ্টিসম্ভার স্রেফ পণ্য নয়। এই সৃষ্টিতে থাকে আমার দর্শন। তাই যিনি কিনছেন তিনি আমার স্টাইল, আমার দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে, আগ্রহী হয়েই কিনছেন। আমি ট্রেন্ড সেট করি। আর সেটাই অনুসরণ করেন আমার ভোক্তারা। এ জন্যই আমি নিজেকে বলে থাকি ডিজাইনারদের ডিজাইনার।
পক্ষান্তরে স্থাপত্য নকশার ক্ষেত্রে তো আর এই স্বাধীনতা থাকে না। বরং যারা আমাকে কাজের জন্য সম্মানী দিচ্ছে তাদের রুচি, পছন্দ, স্টাইল ইত্যাদিকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। সেটা সরকার হতে পারে কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি। বলা যেতে পারে, নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ আমার কাছে থাকে না। তাই আস্তে আস্তে সরে এসেছি।
আবার ফিরে আসি আর্কিটেক্ট এড্রিক প্রসঙ্গে। কীভাবে তিনি কাজ করেছেন তা জানার আগ্রহ থেকেই। কেবল সুপারস্ট্রাকচার নয়, আমার নকশায় থেকেছে মাইক্রোস্ট্রাকচারও। বিশদে বলতে পারি, স্ট্রাকচার তো আছেই কিন্তু তার ভেতরের বিষয়ও আমি ডিজাইনে অন্তর্ভুক্ত করেছি। অর্থাৎ কোনো রিসোর্ট নকশায় আমি ফার্নিচার থেকে লাইট ফিটিং, কাটলারি, ক্রোকারিজ মায় টেক্সটাইল আর ফার্নিশিং—প্রতিটি জিনিসের নকশা আমি করেছি। তবেই তো সেটা এড্রিকের সিগনেচার হয়েছে।
সেই সময়ে এড্রিক ক্র্যাফট ডিজাইনও করতেন। এ ক্ষেত্রে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছেন সম্প্রতি প্রয়াত তাঁর পার্টনার ফিলিপিনো আর্কিটেক্ট ফ্রান্সিসকো ববি মানিওসা। তিনি বস্তুত উষ্ণমন্ডলীয় ফিলিপাইনকে মাথায় রেখে সেখানকার প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে স্থাপত্য নকশাকে উন্নীত করেছেন অন্যতর উচ্চতায়। তাঁর করা কোকোনাট প্যালেস এক অসাধারণ কাজ। নারকেলের মালা, ছোবড়া, কলার তন্তু ইত্যাদি তিনি তাঁর কাজে বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার করেছেন। ববির প্রেরণায় তিনিও তাঁর স্থাপত্য নকশাকে পূর্ণতা দিয়েছেন সবকিছুতে নিজের ছাপ রেখে।
আর বর্তমানে তিনিই আসলে সারাওয়াকের দূত। সেখানকার টেক্সটাইল আর ক্র্যাফটকে বিশ্বব্যাপী পরিচয় করিয়েছেন। বিশেষ করে ইবান টেক্সটাইলকে। তবে নিজেকে এখন আর কেবল সারাওয়াকের প্রতিনিধি মানতে নারাজ এড্রিক। বললেন, আসলে আমি এই অঞ্চলের প্রতিনিধি। দ্বিতীয় দফায় আমি আপাডার প্রেসিডেন্ট হয়েছি। ফলে আশিয়ান দেশগুলোর ক্র্যাফট আর টেক্সটাইলের উন্নয়নই আমার বিশেষ লক্ষ্য। দীর্ঘদিন ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট কাউন্সিলের এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন এড্রিক। বর্তমানে তিনি উপদেষ্টা। ফলে আঞ্চলিক উন্নয়নের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। এ জন্য নতুন বিষয় নিয়ে কাজও করছেন, নিরলস নিরীক্ষায় তৈরি করছেন নতুন সব পণ্য। এবার বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকে যে কালেকশন তিনি উপস্থাপন করেছেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল উত্তর থাইল্যান্ডের হাতে বোনা হেম্প বা কচুরিপানার তন্তু দিয়ে তৈরি কাপড়ের ড্রেস। আর এটা প্রথমবারের মতো করা। সঙ্গে ছিল ব্যাগ। যেগুলো এড্রিক তাঁর মতো করে গ্ল্যামারাইজড করেছের। আরও ছিল পয়েন্টেড হ্যাট। এটা আবার এড্রিকের বিশেষত্ব। এই হ্যাটগুলো রাত্তানের ছিলা দিয়ে তৈরি। এগুলো এতই নমনীয় যে সহজেই ভাঁজ করে ভয়ে নেওয়া যায়। আর অবশ্যই ব্যাগ। যেগুলো আমেরিকার বিখ্যাত সান্তা ফে মার্কেটে হট সেলিং আইটেম। মজার ব্যাপার হলো, মাত্র দুটো বাক্সে ভরেই এড্রিক তাঁর যাবতীয় পোশাক আর অ্যাকসেসরি এনেছিলেন এবারের ফ্যাশন উইকের জন্য।
বিশেষত টেক্সটাইল আর ক্র্যাফটসের উৎপাদন ও বাজারজাতকরণকে টেকসই করে তোলা ইন্টারেস্টিং চ্যালেঞ্জ বলেই অভিমত এড্রিকের।
এড্রিক কাজ করেন প্রাকৃতিক রঙ নিয়ে। প্রাকৃতিক তন্তু নিয়ে। আর অর্গানিক পণ্য আন্দোলনের প্রবক্তাও বটে। তবে সবাইকে কি এই পণ্য দেওয়া সম্ভব?
কফিতে চুমুক দিয়ে সদা ইতিবাচক এই শিল্পী বললেন, সম্ভব বটে। তবে রাতারাতি নয়। অবশ্য এ ক্ষেত্রে কাজ যে হচ্ছে না তা নয়। কেবল প্রাকৃতিক নীল বা ইন্ডিগোর কথাই ধরি। থাইল্যান্ডে কাজ হচ্ছে। সাকন নাখন শহরকে তো ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট সিটিই ঘোষণা করা হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশে চাষ হচ্ছে। তবে অনেক বেশি হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ায়। সেখানে এই রঙ দিয়ে বাটিক হচ্ছে।
কথায় কথায় সময় গড়ায়। বিশ্বের বদলতি ছবিকে তুলে ধরেন কথা প্রসঙ্গে। বলেন, কীভাবে বদলে যাচ্ছে ফ্যাশন বিশ্ব, আবেদন হারাচ্ছে ফ্যাশন উইক। ক্রেতা সরাসরি উৎপাদককে খুঁজে নিচ্ছে। অনলাইন শপিং জনপ্রিয় হচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম ক্রেতা আর উৎপাদককে কাছাকাছি নিয়ে আসছে।
ইবান পুয়া টেক্সটাইল নিয়ে কাজ করছেন তিনি। জানালেন একটা কাপড় বুনতে অনেক সময় লাগে। অন্তত ৬ মাস। তাই তিনি এই ইবান ইক্কাতকে একটু অন্যভাবে পরিচিত ও জনপ্রিয় করানোর চেষ্টা করছেন। আর সেটা হলো, ইবান ইক্কাতের মোটিফকে ব্লক প্রিন্ট করে ইয়ার্ডেজ ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা। ভারতের একজন ডিজাইনারের সঙ্গে কোলাবোরেট করছেন। এই ধরনের কাজ প্রথম নয়। বরং ফ্যাশন আর টেক্সটাইল নিয়ে কাজ করার সূচনা সময়েও যে তিনি সেটা করেছেন, তা-ও জানিয়ে দেন।
তবে ভবিষ্যৎ কী আসলে? আজকের প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের জমানায় কীভাবে টিকবে হাতে বোনা কাপড় আর শিল্পসামগ্রী?
— না, আশাহত নন তিনি। বরং মনে করেন, ফিউচার ইজ হ্যান্ডমেইড। ওয়ার্ল্ড ক্র্যাফট কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্টের সময় এই সেøাগান প্রবর্তন করা হয়। তবে এটা যেমন ঠিক, তেমনি তিনি মনে করেন কোনো কিছু নিয়ে স্বার্থপর হওয়া অনুচিত। বরং আমি যেটা জানি, সেটা অন্যকে জানানো আর অন্যের কাছ থেকে শেখা—এই প্রক্রিয়া হবে যথার্থ। তাহলেই পৃথিবী সত্যিকারের সুন্দর আর টেকসই হবে।
কথায় কথায় সময় গড়িয়েছে। তাঁরও হোটেল ছাড়ার সময় হয়ে আসছে। তাই সমে পৌঁছানোর আগে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক নিয়ে তাঁর অভিমত জেনে রাখতে চেয়েছি। উত্তরে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন এড্রিক। বলেছেন, ফ্যাশন উইকে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার উপস্থিতি একান্ত জরুরি। কিন্তু এখানে তা ছিল না। এমনকি স্থানীয় মিডিয়ার অপ্রতুল উপস্থিতি, ফটোগ্রাফারদের জন্য নির্দিষ্ট স্থান না থাকাও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। উপরন্তু এই উইকের উদ্দেশ্য দেশি বাজার নাকি আন্তর্জাতিক, সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়নি। তাই তিনি জানেন না বায়াররা উপস্থিত ছিল কি না। বাংলাদেশ অনেক আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করছে সুনামের সঙ্গে। ফলে এটাকে তিনি সঠিক সময় মনে করছেন, বিদেশে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার।
ধন্যবাদ জানিয়ে আপাতত যতি টানি এই কথোপকথনের। এড্রিকও বিদায় নিয়ে রুমের দিকে এগোন।
ছবি: সৈয়দ অয়ন