ফুড বেনিফিট I মিষ্টিকুমড়া
সুস্থতা রক্ষা ও রোগবালাই প্রতিরোধে মিষ্টিকুমড়ার গুণপনার শেষ নেই। এর বীজও স্বাস্থ্যকর
মিষ্টিকুমড়া। ময়মনসিংহ অঞ্চলে এটি মিষ্টিলাউ নামেও পরিচিত। প্রাচীনকালে মধ্য কিংবা দক্ষিণ আমেরিকার কোনো এক বনবাদাড়ে মানুষ হদিস পেয়েছিল এ সবজির। স্বাদে ও পুষ্টিতে ভরপুর হওয়ায় ছেলেবুড়ো সবারই পছন্দ। জার্মানরা ফি বছর মেতে ওঠে কুমড়া উৎসবে। ‘কুরবিস ফেস্টিভ্যাল’নামের এই আয়োজনে দেখানো হয় ১৫০টির বেশি জাতের কুমড়া।
খাদ্য হিসেবে মিষ্টিকুমড়ার উপকারিতা ব্যাপক। ভিটামিন এ, বি কমপ্লেক্স, সি, ই, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, জিংক, ফসফরাস, কপার, ক্যারোটিনয়েড, ফ্লেভনয়েড পলিফেনলিক ও অ্যান্টি-অ্যাক্সিডেন্টের ভান্ডার এই সবজি। এসব উপাদান মানবদেহের সুস্থতায় সহায়ক। বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন ছোট-বড় রোগবালাই সারাইয়ের কাজ করে এই উপাদানগুলো।
চোখের সুরক্ষায়: পুষ্টিবিদেরা মতামত দেন, এক কাপ রান্না করা মিষ্টিকুমড়া চোখের সুরক্ষায় অন্যান্য খাবার থেকে ১০০ গুণ বেশি কাজ করে। এর কারণ সবজিটি ভিটামিন এ-এর আধার। পাশাপাশি আছে বিটা ও আলফা ক্যারোটিন। এই দুই ক্যারটিনয়েড উপাদান চোখে ছানি পড়া রোধ করে এবং রেটিনা কোষের সুরক্ষা দেয়। বয়োজ্যেষ্ঠদের মধ্যে অনেকেই রেটিনার অসুখে আক্রান্ত হন। তাদের জন্য মিষ্টিকুমড়া অদ্বিতীয় পথ্য। দৃষ্টিশক্তি হ্রাসের ঝুঁকি কমানো ছাড়াও চোখের ছোটখাটো অথবা মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করে সবজিটি।
ফ্রি র্যাডিকাল ড্যামেজ প্রতিরোধে: বিটা ক্যারোটিন যে শুধু চোখের ছানিই দূর করে, তা নয়। এটি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, যা শরীরকে ফ্রি র্যাডিকাল ড্যামেজ থেকে রক্ষা করে। পরিবেশদূষণ, স্ট্রেস ও খাবারের ক্ষতিকর কেমিক্যাল থেকে শরীরে ফ্রি র্যাডিকাল ড্যামেজ শুরু হতে পারে। ফলে কোষ নষ্ট হয় এবং খারাপ কোষের পরিমাণ বাড়ে। মিষ্টিকুমড়ার বিটা ক্যারোটিন এ ক্ষতি থেকে শরীরের সুরক্ষা দেয়।
হৃদপিন্ডের সুস্থতায়: হার্ট ব্লক এখন যেন মহামারি আকার ধারণ করেছে। বিশ্বে প্রতিবছর ১৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বা পৌনে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটে হৃদ্্রোগে! ধমনি তথা আর্টারিতে চর্বি জমে এমন দুরবস্থা হয়। মিষ্টিকুমড়া শরীরের ধমনি প্রাচীরে চর্বি জমতে বাধা দেয়। ফলে হৃদ্রোগ
প্রতিরোধ হয়। এতে থাকা ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম মৌল হৃদ্রোগ ও উচ্চ রক্তচাপ থেকে রেহাই দেয়। এর ভিটামিন সি একই কাজ করে।
ত্বকের সুরক্ষায়: উচ্চ রক্তচাপ প্রশমনের পাশাপাশি ত্বক ও চুলের চর্চায় কাজে আসে মিষ্টিকুমড়ায় থাকা ভিটামিন সি। ত্বক কোমল ও চকচকে রাখতে পারে বিটা ও আলফা ক্যারোটিন। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ফ্যাটি অ্যাসিড, যা ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না। বলিরেখা থেকেও বাঁচায়। ফলে বার্ধক্য আসে দেরিতে।
অস্টিওপোরোসিস নিরাময়ে: এই রোগ হলে অল্প চাপেই হাড় ভেঙে যেতে পারে। এমনকি হাঁটাহাঁটি করার সময়ও ভাঙতে পারে। বিশেষ করে কোমর, পায়ের গোড়ায় ও মেরুদন্ডের হাড়গুলো ভাঙে। এতে করে রোগী মাসের পর মাস ধরে বিছানায় পড়ে থাকে। মৃত্যুও হতে পারে। এ রোগ থেকে রেহাই দিতে পারে মিষ্টিকুমড়া। এর শাঁসালো অংশে থাকা প্রচুর ম্যাগনেশিয়াম হাড়ক্ষয় রোধ করে।
মিষ্টিকুমড়ার ভিটামিন সি সর্দি-কাশির দাওয়াই। এতে সম্পৃক্ত চর্বি নেই এবং ক্যালরির মাত্রা কম। ফলে শরীরের স্থূলতা কমায় এই সবজি। কোলেস্টেরলও নিয়ন্ত্রণে রাখে। হাড় শক্তিশালী করার মতোই দাঁত সুস্থ রাখে। কারণ একটাই—ম্যাগনেশিয়াম। এসব বাদেও বাতের ব্যথা প্রশমনে কার্যকর এটি। বিশেষজ্ঞরা মত দেন, প্রতিদিন দুই কাপ রান্না করা মিষ্টিকুমড়া খেলে বাতের ব্যথা সারবে।
কুমড়ার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়ে। ইউরিনেশন সমস্যা দূর করার পাশাপাশি কিডনিতে পাথর জমতে বাধা দেয়। দূর করে কোষ্ঠকাঠিন্যও। এর জিংক ও আলফা হাইড্রোক্সাইড ইমিউনিটি সিস্টেম ভালো রাখে। ডায়রিয়া নিয়ন্ত্রণে এবং পরিপাক নালিতে সঠিক উপায়ে খাবার সরবরাহে মিষ্টিকুমড়ার তুলনা হয় না। উপকৃত হতে পারবেন গর্ভবতীরাও। গর্ভকালীন রক্তস্বল্পতা এবং অকালপ্রসবের যন্ত্রণা হ্রাস করে কুমড়া। বিশেষ করে এর বীজ গর্ভবতীদের অনাগত সন্তানের সুস্থতা নিশ্চিত করে।
চলে এলো মিষ্টিকুমড়ার বীজের কথা। এর উপকারিতা অগ্রাহ্য করা যায় না। আমাদের মধ্যে অনেকেই কুমড়ার বীজ আবর্জনার পাত্রে ফেলে দেন। অথচ এর গুণ অনেক। খাদ্য আঁশ, উচ্চ মাত্রার প্রোটিন, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ ও ফসফরাস ছাড়াও অঢেল জিংকের উৎস মিষ্টিকুমড়ার বীজ। এ ছাড়া আছে মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড, ট্রিপটোফ্যান ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট।
ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে কাজ করার আশ্চর্য গুণ রয়েছে কুমড়ার বীজে। বীজে বিদ্যমান ডাই হাইড্রো এপি অ্যান্ড্রোস্টেনেডিয়ন ক্যানসার হতে বাধা দেয়। আছে প্রদাহবিরোধী গুণাগুণও। জার্মানির গবেষকেরা জানিয়েছেন, মেনোপজ অবস্থায় বেশি করে মিষ্টিকুমড়ার বীজ খেলে স্তন ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা ২৩ শতাংশ কমে যায়। তেলও হয় কুমড়ার বীজ থেকে। সেই তেল প্রোস্টেট বড় হয়ে যাওয়ার চিকিৎসায় লাগে। পৌরুষত্বও বাড়িয়ে তোলে কুমড়ার বীজ। শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স করে বীজের পটাশিয়াম। ফলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মস্তিষ্কের সুরক্ষায় পলি ও মনো আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের জোগান দেয় কুমড়ার বীজ। ডায়াবেটিসের রোগীদের সুগার নিয়ন্ত্রণ করতেও সক্ষম এটি। শরীরে ইনসুলিন সরবরাহ করে এবং ক্ষতিকর অক্সিডেটিভের চাপ কমায়। বীজের প্রোটিন হজমে সাহায্য করে। ফলে রক্তে চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে থাকে। মিষ্টিকুমড়ার মতো এর বীজও কোষ্ঠকাঠিন্যের পথ্য, ওজন হ্রাস করে এবং হাড় ও দাঁতের সুরক্ষা দেয়। বীজের বিশেষ গুণটি হচ্ছে এটি খেলে ভালো ঘুম হয়। কেননা, এতে ট্রিপটোফ্যান থাকে। এটি একধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড। এই অ্যাসিড শরীরে প্রবেশ করে সেরোটনিনে রূপান্তর হয়, যা ঘুমের উদ্রেক ঘটায়। এ গুণের জন্য মিষ্টিকুমড়ার বীজকে ন্যাচারাল স্লিপিং পিল বলা হয়। অস্থিসন্ধির ব্যথা, বাতব্যথা ও পেশির জ্বালাপোড়া কমায় এ বীজ। এতে থাকা ফাইটোকেমিক্যাল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণের আশঙ্কা কমায়।
সুস্থতা রক্ষা ও রোগবালাইয়ের দাওয়াইয়ের কাজ করার পাশাপাশি রূপচর্চায়ও ভূমিকা রাখে কুমড়ার বীজ। এতে কিউকুরবিটিন নামের অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়। এটি চুলের বৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এত গুণ যে বীজে, তা কীভাবে খাবেন?
পাকা মিষ্টিকুমড়ার বীজই খাওয়ার জন্য উৎকৃষ্ট। সংগ্রহের পর ভালো করে ধুয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। শুকনা বীজ ফ্রাই প্যানে মচমচে করে টেলে নিতে হবে। ভাজা বীজ চিবিয়ে, কোনো ফলের সঙ্গে বা স্যালাডে যোগ করে খেতে পারেন। ভর্তা করেও খাওয়া যায়। স্যুপেও নেওয়া যায়। খিচুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে নিলে স্বাদ বাড়বে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সংগ্রহ