ফুড বেনিফিটস I কতবেল
স্বাস্থ্যকর বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ এই ফল যেমন নানা রোগবালাই দূর করতে সক্ষম, তেমনি সৌন্দর্যরক্ষায়ও এর জুড়ি নেই
শারদীয় ফল কতবেল। আদি নিবাস ভারত উপমহাদেশ। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় প্রচুর জন্মে। খাদ্যশক্তিতে ফলটি কাঁঠাল ও পেয়ারার সমতুল্য। কতবেলে আমিষ আমের চেয়ে সাড়ে তিন গুণ, কাঁঠালের দ্বিগুণ, লিচুর তিন গুণ, আমলকী ও আনারসের চেয়ে চার গুণ বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম কতবেলে পানির পরিমাণ ৮৫.৬ গ্রাম, খনিজ ২.২ গ্রাম, আমিষ ৩.৫ গ্রাম, শর্করা ৮.৬ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫৯ মিলিগ্রাম, চর্বি ০.১ গ্রাম, আয়রন ০.৬ মিলিগ্রাম, হজমযোগ্য আঁশ ৫ গ্রাম, ভিটামিন-বি ০.৮ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন সি ১৩ মিলিগ্রাম। পাকা কতবেলে প্রচুর পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন, থায়ামিন ও রিবোফ্ল্যাভিন থাকে। এসব উপাদান আমাদের শরীরের ভেতর-বাইরে নানাবিধ অসুখ সারাইয়ে সক্ষম। যেমন, কতবেল খেলে হৃদপিন্ড ভালো থাকে। কার্ডিওভাসকুলার সমস্যার জন্য দায়ী মন্দ কোলেস্টেরল ও উচ্চ রক্তচাপের লাগাম টেনে ধরে এ ফল। কোলেস্টেরল কমাতে কাজে আসে কতবেলের পাতার নির্যাস। এর কার্যকারিতা কোলেস্টেরল কমানোর ওষুধের সমকক্ষ। তা ছাড়া এ গাছের পাতার নির্যাস টিস্যুর লিপিড প্রোফাইল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড লেবেল ঠিক রাখে। এর মূলের চূর্ণ দিয়ে তৈরি ক্বাথ হৃদপিন্ডের ধড়ফড়ানির সমস্যা থেকে মুক্তি দেয়।
এলাচি ও মধুযোগে কাঁচা কতবেল খেলে বদহজম দূর হয়। কতবেলগাছের শাখা ও কান্ড থেকে এক প্রকার আঠা পাওয়া যায়, যার নাম ফেরোনিয়া। এ আঠা ডায়রিয়া ও আমাশয়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। উদরের বালাই সারাতে কতবেলের পাতা কাজে লাগে। দুধ ও চিনিতে পাতা মিশিয়ে খেলে পেটের ব্যথা চলে যায়। তবে এ পথ্য শিশুদের বেলায় বেশি কার্যকর। এদের পেটে কৃমি হলে কতবেল খাইয়ে দিতে পারেন। প্রাপ্তবয়স্করাও খেতে পারেন। কৃমি দূর করে কতবেলে থাকা ট্যানিন নামের উপাদান। পাইলস ও আলসারে আক্রান্ত রোগীদের কতবেল খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
ঘা-ক্ষত সারাইয়ে কতবেল দ্রুত কাজ করে। বিশেষ করে গলার ঘায়ে। আবার বাহ্যিক ত্বকের জ্বালাপোড়া কমাতে মলমের মতো ব্যবহার করা যায়। বিষাক্ত পোকামাকড় কামড়ালে ক্ষতস্থানে কতবেলের শাঁস এবং খোসার গুঁড়া মেখে দিলে সেরে যায়। ভারতে প্রাচীনকালে সাপের কামড়ের চিকিৎসায় কতবেলগাছের ছাল ব্যবহৃত হতো। ঘন ঘন হেঁচকি ওঠা কমাতেও কতবেল খাওয়া যায়।
আয়ুর্বেদশাস্ত্রে ডায়াবেটিসের মহৌষধ কতবেল। এর নির্যাস শরীরে গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে। উপরে যে ফেরোনিয়া আঠার কথা বলা হয়েছে, সেটি পেটের রোগ দূর করার পাশাপাশি সুগারের পরিমাণ কমিয়ে ইনসুলিনের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম।
কতবেলের অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান আর্থ্রাইটিস ও গেঁটেবাতের পথ্য। এ গাছের পাতা পুড়িয়ে পানিতে মিশিয়ে সেবন করলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দূর হয়। পাশাপাশি শ্বাসনালির অন্যান্য রোগের দাওয়াই হিসেবে কাজ করে। এ জন্যই সর্দি-কাশি উপশমে কতবেল খাওয়ার চল দেখা যায়।
নারী স্বাস্থ্যের দারুণ সুরক্ষা দেয় কতবেল। হরমোনের অভাব দূর করে। এটি প্রজেস্টেরন হরমোনের নিঃসরণ বাড়ায়, যা নারীর প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। স্তন ও জরায়ু ক্যানসার প্রতিরোধ করে এ ফল। সন্তান প্রসবজনিত স্বাস্থ্য সমস্যা থেকেও রেহাই দেয়। এ গাছের ছাল মাত্রাতিরিক্ত রক্তস্রাব সমস্যার প্রতিষেধক।
কতবেল রক্ত পরিষ্কারক। চিনিযোগে গরম পানিতে কতবেলের তৈরি শরবত পান করলে তা রক্তকে পরিশুদ্ধ করে। পাশাপাশি শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দেয়। রক্তস্বল্পতাও দূর করে। এ উদ্দেশ্যে কতবেল শুকিয়ে তার গুঁড়া চিনি কিংবা মিছরির সঙ্গে মিশিয়ে খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়। শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে কতবেল। স্নায়ুর শক্তি বাড়ানোর পাশাপাশি পেশিশক্তিও বাড়ায়। এর পুষ্টি উপাদানগুলো শরীরের মেটাবলিজমেরও উন্নতি ঘটায়। অবসাদ ও ক্লান্তি দূর করে।
মাড়ির রোগ, বিশেষত স্কার্ভি দূর করতে কতবেলের জুড়ি নেই। এ রোগের তীব্রতা মৃত্যুর কারণও হতে পারে। মূলত ভিটামিন সি এর অভাবে স্কার্ভি হয়। ভিটামিন সি এর আধার কতবেল খেলে এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়।
প্রাচীন ভারতে কিডনির চিকিৎসায় কতবেলের ব্যবহার ছিল। এটি খেলে কিডনির পাথর দূর হয়। এ ধরনের সমস্যা হলে চিকিৎসকেরা দৈনিক ১০০ গ্রাম করে কতবেল রোগীদের খাওয়ার পরামর্শ দেন। ফলটি লিভারের রোগীদের পথ্য হিসেবেও কাজ করে। এর গাছের ছালে হেপাটোপ্রোটেক্টিভ পটেনশিয়াল আছে, যা অক্সিডেশনজনিত কারণে লিভারের ক্ষতিরোধ করে। যকৃৎকে অ্যালকোহলজনিত ক্ষতি থেকে রক্ষা করে কতবেল।
কতবেলের বিটা ক্যারোটিন চোখের সুরক্ষা দেয়। এ ফল খেলে অনেক ক্ষেত্রে চোখের ছানি ও চোখ ওঠা অসুখ ভালো হয়ে যায়। চোখের দৃষ্টিশক্তিও বাড়ে। চোখের ছত্রাকজনিত রোগে কতবেলের পাতা কাপড়ে পুঁটলি বেঁধে হালকা গরম করে সেঁক নিলে লাল ভাব চলে যায়।
রক্তে পটাশিয়ামের পরিমাণ বেড়ে গেলে নিয়মিত কতবেল খেতে পারেন। শিশুদের পিত্তরোগ নিরাময়ে এর কচি পাতার রস, দুধ ও মিছরির মিশ্রণ ফলপ্রদ। পাতার ক্বাথ পানিতে গুলিয়ে নিয়মিত পান করলে পেপটিক আলসার ভালো হয়। এ ফল রুচি বাড়ায়। এসব ছাড়াও দীর্ঘদিনের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে, মূত্রবর্ধক হিসেবে, কানের সংক্রমণ সারাইয়ে, ম্যালেরিয়ার উপশমে এবং লিউকোমিয়া নিরাময়ে খেতে পারেন কতবেল।
দেহের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় এটি যেমন কার্যকর, তেমনি ফলপ্রদ শরীরের বাইরের অংশেও। যেমন কাঁচা কতবেলের রস মুখে মাখলে ব্রণ ও মেছতা দূর হয়। মিয়ানমারে কতবেলগাছের ছাল দিয়ে এক প্রকার পেস্ট ও পাউডার তৈরি হয়। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘থানাকা’। এটি ত্বকের জন্য অনেক ভালো। কালো দাগ দূর করতে এবং ত্বক মসৃণ রাখতে ব্যবহৃত হয় থানাকা। এটি সান ক্রিম হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অ্যাকনে দূর করে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট