বিশেষ ফিচার I উপমহাদেশের ভাষা সংগ্রাম
১৯৫২-এর মতোই উপমহাদেশে সংগঠিত হয়েছে আরও দুটি ভাষা আন্দোলন। প্রথমটি পশ্চিমবঙ্গের মানভূমে এবং দ্বিতীয়টি আসামের শিলচরে। এ দুটি ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে এই নিবন্ধ
বাংলা ভাগ হওয়ার পর পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা উর্দু চাপানোর চেষ্টা চালিয়েছে। ঠিক একইভাবে ’৪৭-পরবর্তী ভারতের যাত্রা শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন ও বিহারের সঙ্গে যুক্ত মানভূমের ওপর হিন্দি আধিপত্য কায়েম করার মাধ্যমে। শুধু তা-ই নয়, গোটা পশ্চিমবঙ্গকেই বিহারে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। এসব ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করতেই মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলন। ঠিক একইভাবে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিল আসামের শিলচরের বাঙালিরা। ঈশানবঙ্গের মানুষের জীবন থেকে বাংলা ভাষাকে বিযুক্ত করার চেষ্টা চলেছিল। তা রুখে দিতে বাঙালি ভাষার জন্য ফের রক্ত দিয়েছিল। ঢাকার পর বরাক উপত্যকার শিলচরে দ্বিতীয়বার বাংলা ভাষার জন্য শাহাদত বরণ করেছিল সেখানকার বাঙালি। সেই সংগ্রামে প্রথম ও একমাত্র মহিলা ভাষাশহীদ কমলা ভট্টাচার্য।
মানভূমের ভাষা আন্দোলন
একসময় বাংলা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মানভূম ও ধলভূমকে বিহার ও উড়িষ্যার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের নামে কার্যত বাংলা ভাগ করা হলে, ক্রমশই বাংলাভাষীদের এলাকা মানভূমের ওপর বিহারের প্রাদেশিক সরকার হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। হিন্দিকে বিহার রাজ্যের প্রাতিষ্ঠানিক ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং সরকারি ও বেসরকারি অনুদানপ্রাপ্ত স্কুলগুলোতে হিন্দি মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়, জেলা স্কুলগুলো থেকে বাংলা ভাষায় পঠন-পাঠন বন্ধ করে দেওয়া হয়। মনে রাখা দরকার, অনেক ভাষা ও জাতিসত্তা নিয়ে গড়ে উঠেছে ভারতবর্ষ। ১৯৪৭ সালে গঠিত ভারত মূলত, তা আসলে একটি বহুজাতিক যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সংবিধানে ভারতকে যুক্তরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণার বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়েছিল ১৯৪৭ পরবর্তী সময়ের পর থেকে ভাষাভিত্তিক রাজ্য পুনর্গঠনের চাপ থেকে। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশের ভাষাভিত্তিক প্রদেশ কমিশন নিয়োগ করেন। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরে এই কমিশন জনমত অস্বীকার করে জানিয়ে দেয় যে, শুধু ভাষাভিত্তিক প্রদেশ গঠন না করে ভারতের ঐক্যকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
১৯৪৮ সাল থেকেই তৎকালীন বিহার সরকার ওই রাজ্যের মানুষদের ওপর হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রাথমিক স্তরে ও সরকারি অনুদান যুক্ত বিদ্যালয়ে হিন্দি মাধ্যমে পড়ানোর নির্দেশ আসে, জেলা স্কুলগুলোতে বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। আদিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলের স্কুলগুলোতে শুধু হিন্দিতে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাঙালির মানভূমে তখন কায়েম করা হলো ‘হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ’। একের পর এক বাংলা স্কুলগুলো পরিণত হলো হিন্দি স্কুলে। পোস্ট অফিসসহ সব সরকারি দপ্তরে হিন্দি বাধ্যতামূলক করা হলো। এর বিরুদ্ধেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন। গর্জে ওঠে লাখ লাখ বাঙালি। শিক্ষা ও প্রশাসনিক স্তরে তাদের মাতৃভাষা স্বীকৃতির জন্য শুরু হয় আন্দোলন।
বিহার রাজ্য সরকার মানভূমে বাংলার ব্যবহার সীমিত করার জন্য কঠোর হতে শুরু করলে অতুলচন্দ্র ঘোষ, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্তসহ ৩৭ জন নেতা কংগ্রেসের জেলা কমিটি থেকে পদত্যাগ করে ‘লোক সেবক সংঘ’ গঠন করেন। সংগঠনটি বাংলা ভাষার মর্যাদার প্রশ্নে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে। বিহারের প্রচলিত নিরাপত্তা আইনের ‘নামে’ অত্যাচার শুরু হলো ভাষা আন্দোলনকারীদের উপরে। শুরু হলো ‘টুসু সত্যাগ্রহ’। মানভূমের লোকগান টুসুতে সাধারণের স্বতোৎসারিত আবেগ মিশে থাকে। তাতেও ফুটে উঠতে লাগল বাংলা ভাষার জন্য আকুলতা। ১৯৫২ সালে লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হলেন ‘লোক সেবক সংঘে’র দুজন প্রার্থী (ভজহরি মাহাতো ও চৈতন মাঝি)। বিধানসভায় জিতে এলেন সাতজন।
ভজহরি মাহাতো লিখলেন গান,
শুন বিহারী ভাই, তোরা রাখতে লারবি ডাঙ্ দেখাই
তোরা আপন তরে ভেদ বাড়ালি, বাংলা ভাষায় দিলি ছাই…
মানভূম ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা ছিল অপ্রতিরোধ্য। জননেত্রী লাবণ্যপ্রভা দেবীকে পুলিশ ও রাজনৈতিক গুন্ডারা চুলের মুঠি ধরে ঘর থেকে বের করে নির্যাতন চালায়। রেবতী ভট্টাচার্যকে পিটিয়ে জঙ্গলের মধ্যে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় বিহারি পুলিশ। জননেত্রী ভাবিনী মাহাতোর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। এই সময় বিহারের জননিরাপত্তা আইনের ধারায় লোক সেবক সংঘের কর্ণধার অতুলচন্দ্র ঘোষ, লোকসভা সদস্য ভজহরি মাহাতো, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, অশোক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরই মধ্যে শুরু হয় সীমা কমিশনের কাজ। সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের দুই মুখ্যমন্ত্রীর (বিধানচন্দ্র রায় ও শ্রীকৃষ্ণ সিংহ) তরফে বঙ্গ-বিহার যুক্ত প্রদেশ গঠন করার প্রস্তাব আসে। ইতিমধ্যে ১৪৪ ধারা জারি করে ‘টুসু সত্যাগ্রহ’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
মানভূমের ভাগ্যের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হওয়ায়, ১৯৫৬ সালের এপ্রিলে লোক সেবক সংঘের আন্দোলনকারীরা কলকাতা অভিমুখে পদযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন। ২০ এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে সাড়ে তিন শ নারীসহ হাজার দেড়েক আন্দোলনকারী দশটি বাহিনীতে ভাগ হয়ে পুঞ্চার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে পদযাত্রা শুরু করেন। ৬ই মে কলকাতায় উপস্থিত হয় সেই পদযাত্রা। ২০ এপ্রিল থেকে ৬ মে টানা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। কণ্ঠে ছিল ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে’ গান।
সমাবেশ যেন না হতে পারে, এ জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আগে থেকে ১৪৪ ধারা জারি করে রেখেছিল। তা অমান্য করার দায়ে পুলিশ ৯৬৫ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করে। বন্দিদের পাঠানো হয় কলকাতা প্রেসিডেন্সি জেল, আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ও আলিপুর স্পেশাল জেলে। বারো দিন পর তারা মুক্তি পান। একই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে প্রায় ৩,৩০০ আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়, যারা প্রধানত লোক সেবক সংঘ অথবা বামপন্থী দলগুলোর কর্মী ছিলেন।
বাধ্য হয়ে রদ করা হয় বাংলা-বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব। বঙ্গ-বিহার ভূমি হস্তান্তর আইন পাস হয়। ১৯৫৬ সালের ১৭ আগস্ট লোকসভায় ও ২৮ আগস্ট রাজ্যসভায় বাংলা-বিহার সীমান্ত নির্দেশ বিল পাস হয়। ১ সেপ্টেম্বর এতে ভারতের রাষ্ট্রপতি সই করেন।
বরাকের ভাষা আন্দোলন
বাংলা সাতচল্লিশে চিরস্থায়ীভাবে ভাগ হলেও এর আগেও ব্রিটিশদের কারসাজিতে বাংলা ভেঙেই আসাম প্রদেশের জন্ম দেওয়া হয়েছিল। বাংলা ভাষার ডায়ালেক্টের সঙ্গে স্পষ্ট কোনো পার্থক্য না থাকলে অহমিয়া আলাদা ভাষার স্বীকৃতি পেয়েছে। তা নিয়ে বাংলা ও বাঙালির কোনো অসুবিধাও ছিল না। কিন্তু ভারত স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আসামে ‘বঙাল খেদাও’ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দিল্লির প্রশ্রয়ে উগ্র অহমিয়া জাতিবাদীরা আসাম থেকে তাদের বারবার উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। তাই ১৯৬১ সালের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন আসামে বাঙালি জাতিসত্তার ভাষার অধিকারসহ সব গণতান্ত্রিক অধিকারের আখ্যান।
আমরা পেছনে ফিরে দেখে নিতে পারি, সেই সালের ১৯ মে দিনটিকে।
শিলচরের রেলস্টেশন চত্বর। বাংলা ভাষা স্বীকৃতির দাবিতে অনড় শত শত ভাষাসৈনিকের জমায়েত। ভোর ৪টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত হরতাল কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশই বজায় ছিল। বেলা ২টা বেজে ৩৫ মিনিট নাগাদ বিনা প্ররোচনায় পুলিশের গুলি চলল; ৭ মিনিট ব্যবধানে ১৭ রাউন্ড এলোপাতাড়ি গুলি। একটি গুলি মাথা ভেদ করে চলে গেল ঠিক দুদিন আগেই ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ করে এই আন্দোলনে যোগ দিতে আসা ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীর। নাম কমলা ভট্টাচার্য, ভাষা আন্দোলনে পৃথিবীর প্রথম নারী শহীদ। গুলি চালানোর জন্য পুলিশের রাইফেল নিশানা করলে ২০ বছর বয়সী দশম শ্রেণির ছাত্র শচীন্দ্র নাথ পাল জামার বোতাম খুলে খালি বুকে দাঁড়ান রাইফেলের সামনে। শহীদের মতো মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মারা যান ১৫ বছর বয়সী দশম শ্রেণির ছাত্র সুনীল সরকার। পুলিশের গুলি প্রাণ হারান আরও ছয় জন বাঙালির। এরা হলেন কানাই লাল নিয়োগী, সুকোমল পুরকায়স্থ, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হীতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস এবং তরণী দেবনাথ। ঠিক দুদিন পর স্টেশন চত্বরের পাশের পুকুর থেকে বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেবের লাশ উদ্ধার করা হলো। আসাম পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর লাঠিচার্জ, লাথি এবং বেয়নেটের আঘাতে গুরুতর আহত হন শতাধিক আন্দোলনকারী। এই দিন আহত হয়ে চব্বিশ বছর ধরে বুকে গুলি নিয়ে যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবন কাটিয়ে মারা যান কৃষ্ণকান্ত বিশ্বাস। মারমুখী প্রশাসন রেহাই দেয়নি সাত বছরের এক বালিকাকেও।
এবার একটু পেছনে ফেরা যাক। ইতিহাস থেকে তথ্য অনুসন্ধানের আগে ভৌগোলিক মানচিত্রটা জেনে নিই। বর্তমানে আসাম ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা, বরাক উপত্যকা এবং দুটি পার্বত্য জেলা নিয়ে গঠিত। কাছাড়, হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ—এই তিনটি জেলা নিয়ে তৈরি বরাক উপত্যকা। করিমগঞ্জ দেশভাগের আগে সিলেট জেলার অন্তর্গত ছিল কিন্তু ১৯৪৭ এর পর করিমগঞ্জ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং সিলেটের বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) অন্তর্গত হয়। শিলচর কাছার জেলার প্রধান প্রশাসনিক শহর। শোষণ এবং শাসন বিস্তৃত করার জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি আসামের পতিত জমিতে ‘আসাম টি কোম্পানি’ স্থাপন করে। একে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে বিপুল মানুষের আগমন ঘটে। আসামে প্রশাসনিকসহ নানা ক্ষেত্রে শিক্ষিত বাঙালিদের আধিপত্য ছিল বেশি এবং এই রাজ্যে প্রায় ৩৫ বছর ধরে শিক্ষার মাধ্যম ছিল বাংলা। ১৯৩১ সালের জনগণনা অনুযায়ী আসামের মোট জনসংখ্যার ৩১.৪ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা অসমিয়া এবং ৫৬.৭ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। স্বাধীনতার পর সিলেটের বৃহৎ অংশ পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় ধর্মীয় নিরাপত্তার জন্য অসংখ্য হিন্দু বাঙালি আসামে আসতে শুরু করে।
১৯৪৭ এর আগস্ট মাসেই ১২২৯৭ জন বাঙালি পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে আসামে আসে। বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ এই দশ বছরে ২.৬২ লাখ থেকে ৬ লাখে পৌঁছায়। এরা আসামের ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালিদের এই সংখ্যা বৃদ্ধি অসমিয়া মধ্যবিত্ত শ্রেণির মনে নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দেয়। এখান থেকে বাংলা ভাষা ও বাঙালির প্রতি বিদ্বেষের সূত্রপাত। এই অগণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদের মূল বক্তব্য ছিল, ‘আসাম কেবল অসমিয়াদের জন্যই’। এই জাতিবাদী আক্রমণের হাতিয়ার হিসেবে ভাষাকে ব্যবহার করতে শুরু করে। বাঙালিদের প্রতি অসমিয়াদের ক্ষোভ চরমপন্থী রূপ নিয়ে শুরু হয় ‘বঙাল খেদাও’। এরপর ১৯৬০ এর ২৪ অক্টোবর বিমলাপ্রসাদ চালিহার মুখ্যমন্ত্রিত্বে আসাম বিধানসভায় একক রাজ্যভাষা বিল পাস হয়ে যায়। অসমিয়া হয় আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা। এই একক রাজ্যভাষা বিল ছিল ১৯৫৬ সালের রাজ্য এই প্রস্তাবের পরিপন্থী। এই প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, যদি একটি রাজ্যে ৭০ শতাংশ মানুষ একই ভাষায় কথা বলে, তবেই সেটি একভাষী রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হবে। কিন্তু সেই সময় আসামে অসমিয়া ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫৭.১৪ শতাংশ।
এরপর বাঙালিরা আর বসে থাকেনি। আসাম সরকারের ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে শুরু আন্দোলন। বাঙালিদের ক্ষোভ অসমিয়া ভাষার ওপর ছিল না, ক্ষোভ ছিল এই অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক বিলের বিরুদ্ধে। তাই তাদের দাবি ছিল অসমিয়ার সঙ্গে বাংলাকেও স্বীকৃতি দেওয়ার।
কিন্তু ১৯ মে আসামের বাঙালিরা প্রাণ দিয়ে বাংলা ভাষা ও বাঙালির অধিকারকে খর্ব হতে না দিলেও এই মুহূর্তে সেখানকার বাঙালিরা আবার সংকটে। নাগরিকপঞ্জি থেকে বাদ গেছে আসামের ১৯ লাখ বাঙালির নাম। বাঙালিকে তার আপন ভূমিতেই বলা হচ্ছে, ‘তুমি বহিরাগত’। শুধু আসাম নয়, এই ষড়যন্ত্রের অভিমুখে আছে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাও। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানি মতাদর্শে দিল্লির শাসকেরা পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার বাঙালিদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে হিন্দি। হিন্দি সাম্রাজ্যবাদের চেহারা আজ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
অতনু সিংহ
(কৃতজ্ঞতা: অপূর্ব সাহা ও অভীক মন্ডল)
ছবি: সংগ্রহ