এডিটরস কলাম I বই চিত্তের মহত্ত্বের জন্য
বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ, এটি আপনার প্রায় সব ধরনের ভালো অনুভূতিকে জাগিয়ে দিতে পারে। খুব বেশি যা পারে, তা হলো—এটি আমাদের চিত্তে মহত্ত্ব সঞ্চার করে, জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে, বিশ্বপ্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। কেননা এটা এমন বিপুল আর অফুরন্ত এক জগৎ, সংবেদনশীল ও জ্ঞানীরা তাদের কল্পনা ও প্রজ্ঞা দিয়ে যা গড়ে তুলেছেন
বইয়ের প্রসঙ্গ এলে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। মনে পড়ে কৈশোরের সেই দিনগুলোর কথা। তখন যা পাই, দ্রুত পড়ে ফেলি, পাছে যদি মজাটা নষ্ট হয়ে যায়! যদি গল্প বা উপন্যাসের নায়ককে হারিয়ে ফেলি! একদিন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’ হাতে এলো। কী যে আকুলতা আর বেদনা এক শ বছরের আগের সেই যুবকটির জন্য! আর খুব রাগও হলো তার প্রতি। কেন এভাবে মরে যেতে হবে? এত পাগল হয় কেউ? পরে এটা ফিল্ম হয়েছে, দেখার জন্য সিনেমা হলে গিয়েছি। ছবিটি শেষ হওয়ার পর লক্ষ করেছি, অনেকেই চোখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছেন। তখন লোকে চলচ্চিত্রকে ‘বই’ বলত। অন্যরা কী ভেবেছেন জানি না, বইটি আমাকে বিশেষ এক উপলব্ধির সন্ধান দিয়েছিল। তা এই—মানুষ কীভাবে যাপন করবে তার জীবন, সে সম্পর্কে এমন এক সিলেকশন থাকা দরকার, যা বাস্তবসম্মত। জীবনের প্রশ্নে অনুভূতিকে মাত্রাতিরিক্ত প্রাধান্য দিতে গেলে তা ব্যক্তিমানুষকে বিপন্ন করে, ধ্বংসও করে। এই শিক্ষা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আমাকে দিয়েছেন। বইয়ের প্রতি আমার অনুরাগের প্রধান কারণ কেবল বিনোদন নয়, এর থেকে পাওয়া জীবন ও সময় সম্পর্কে শিক্ষাও। ফলে, এটি আমার অপরিহার্য সঙ্গী।
আমাকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে, অন্যান্য আবশ্যকীয় জিনিসের পাশাপাশি কী আপনি সঙ্গে রাখতে চান? আমার উত্তর হবে—বই। আমি জানি, মানুষের জীবনে বহু কিছুর প্রয়োজন, সেগুলো তো মেটাতেই হয়; কিন্তু বই ছাড়া আমার চলে না। ছোটবেলা থেকেই এমন অভ্যাস গড়ে উঠেছে। তা প্রথমত পারিবারিক পরিবেশের কারণে। দ্বিতীয়ত, সহপাঠীদের মধ্যেও বই পড়ার একটা নেশা ছিল, একে অন্যেরটা ধার করেও পড়তাম। তৃতীয় কারণ, সে সময় বিনোদন এখনকার মতো গ্যাজেট বা ডিভাইসনির্ভর ছিল না, টিভিতে অত চ্যানেলও ছিল না। যদিও আমার মনে হয়, বইয়ের প্রতি ভালোবাসা যার আছে, বিনোদনের শত অপশনও তাতে ব্যাঘাত ঘটাতে পারবে না।
রূপচর্চা সম্পর্কে পরিচিতদের অনেকেই আমার কাছে জানতে চান, কোনো সমস্যা হলে সমাধান বা এ-সংক্রান্ত পরামর্শ চান। কেউ কেউ ডিপ্রেশনের কথাও বলেন। আমি করণীয় সবকিছুর সঙ্গে তাদের বই পড়তে বলি। কেননা, এটা অবসাদ, হতাশা ও দুশ্চিন্তার ভালো একটা ওষুধ। এমনকি অনিদ্রাও এতে দূর হতে পারে। ঘুমের ওষুধ না খেয়ে শোবার পর বই পড়তে থাকুন, নিদ্রা আসবেই একসময়।
বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ, এটি আপনার প্রায় সব ধরনের ভালো অনুভূতিকে জাগিয়ে দিতে পারে। খুব বেশি যা পারে, তা হলো—এটি আমাদের চিত্তে মহত্ত্ব সঞ্চার করে, জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলে, বিশ্বপ্রকৃতির অংশ হিসেবে মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়। কেননা এটা এমন বিপুল আর অফুরন্ত এক জগৎ, সংবেদনশীল ও জ্ঞানীরা তাদের কল্পনা ও প্রজ্ঞা দিয়ে যা গড়ে তুলেছেন। সেখানে সবই সুন্দর, এমনকি কাকের ডাকও; প্রতিটি বস্তুই অমূল্য, শশী ডাক্তারের কাছে আসতে গিয়ে কুসুমের পায়ে নিষ্পিষ্ট হওয়া যে ফুল, তা-ও অশেষ মূল্যবান।
একেকটা গ্রন্থ মানে একেকটা সময়। এখন যে বই পড়ছেন, আপনি অবস্থান করছেন বিধৃত সেই কালে। এক জায়গা থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার জন্য পথ দরকার, বাহনও। তেমনি একেকটি গ্রন্থ আমাদের নিয়ে যায় একেকটি সময়ে। যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চোখের বালি’ পড়ি, চলে যাই এক শতাব্দীর বেশি আগে, ঔপনিবেশিক ভারতে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত বাঙালির জীবনধারায়। আবার যখন বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে শার্ল বোদলেয়রের ‘ক্লেদজ কুসুম’ (ফরাসি ভাষায় ‘ফ্ল্যুর দু মাল’) পাঠ করি, চলে যাই উনিশ শতকের প্যারিসে, বুঝতে পারি ফ্রান্সের নগরজীবন কেমন ছিল!
অমর একুশে গ্রন্থমেলা শুরু হয়েছে। এ এক উৎসব বটে। গর্বের বিষয়, পৃথিবীর আর কোথাও কেবল বই নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এত দীর্ঘ সময়ের মেলা হয় না। প্রতিবছর আমাদের বুকশেলফ নতুন নতুন বইয়ে ভরে ওঠে। এবারও তাই হবে। জীবন কেবল প্রাত্যহিকতায় বিলীন হওয়ার জন্য নয়, এটি যাপন করতে হয়। বই তাতে প্রাণ ও সৌন্দর্য সঞ্চার করে। জীবন হয়ে ওঠে অর্থময়।
ছবি: ইন্টারনেট