রসনাবিলাস I বাংলা ভোজ
বনানীর ছায়াময় সড়কে মরিচ অ্যান্ড ম্যাংগোর নিভৃতি। বাঙালি খাবারের ঠিকানা। ছোট পরিসরে
সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় উঠতেই দেখা মিলল মরিচ অ্যান্ড ম্যাংগো। হাসিমুখের অভ্যর্থনা আর ছোট্ট করিডর পেরোলেই চমকে উঠতে হয়। প্রথমেই চোখে পড়ে সবুজে ঘেরা ছোট্ট জায়গা। বোগেনভিলিয়া, আনসিট ব্যানানা, পিনহুইল ধরনের গাছ দিয়ে ঘেরা তিনটি টেবিল। চাইলে তামাকে দুদন্ড সুখটান দেওয়া যায় এখানে বসে, চা বা কফির সঙ্গে। টি স্টল কাম কাউন্টারটাও এখানেই। লাগোয়া। এক কাপ কড়া আমেরিকানোর অর্ডার দিয়েই ফেললাম এখানে বসার লোভ সামলাতে না পেরে। তা আসতে আসতেই পুরো রেস্টুরেন্ট ভ্রমণ হয়ে গেল। করিডর পেরিয়ে হাতের বাঁ পাশে আরাম করে খাওয়ার ব্যবস্থা। সোফায় শরীর এলিয়ে এখানে আড্ডাও দেওয়া যেতে পারে। ব্যাপারটা এই শতকের প্রথম দশকে বেড়ে ওঠা টিনদের কাছে খানিকটা নস্টালজিকও ঠেকতে পারে। লাউঞ্জ কালচারের কথা ভেবে। পুরো রুম সাজানো হয়েছে নানা রকমের পেইন্টিং দিয়ে।
বাংলার শাপলা, হাঁস-পেঁচা যেমন আছে, তেমনি আছে তুরস্কের গালাতা কুলেসি, পুরান ইস্তাম্বুল, তুর্কি নকশাও। দেয়ালের সাদা রং করা পলেস্তারাহীন এবড়োথেবড়ো ইট, কাঠের ফলস সিলিং থেকে নেমে আসা ঝুলন্ত বাতি, বাইরের অবারিত আলো, ছবির বৈপরীত্য, বসার সোফা—সব মিলিয়ে পুরো পরিবেশকে আরামদায়ক করে তুলেছে। এর ঠিক পরেই কেতামাফিক আসনের ব্যবস্থা। ছোট, বড়, মাঝারি—সব ধরনের গ্রুপের বসার জন্য। এই ঘরেরও শ্রী বৃদ্ধি করেছে পেইন্টিং। আহসান মঞ্জিলের গাড়িবারান্দা, আন্টাঘর ময়দান, পুরান ঢাকা, ময়মনসিংহ রেলস্টেশনের পাশাপাশি ল্যান্ডস্কেপ রয়েছে কিছু। আর আছে তুর্কি নকশার মিনিয়েচার কার্পেট ডিজাইন। তবে দুটো রুমেই ইন্টেরিয়রে মূল মুনশিয়ানা দেখিয়েছে রঙের ব্যবহার আর আয়না। অফ হোয়াইট, ক্রিমের সঙ্গে মেহগনি কাঠের থিমে যেমন কোজিনেস এসেছে, তেমনই ছোট এই ঘরটিকে বেশ বড় করে তুলেছে আয়নাটি।
ফ্রেশলি ব্রিউড কফির স্বাদ আর গন্ধে মাতোয়ারা হতে হতেই জানা হলো এই রেস্টুরেন্টের আদ্যোপান্ত। খুব বেশি দিন হয়নি। গেল বছরের নভেম্বরের মাঝামাঝি শুরু। খুব অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এর খাবার। আড্ডা দেওয়ার চমৎকার পরিবেশও এর জন্য দায়ী। মূলত বাংলা খাবারের জন্যই এই রেস্টুরেন্ট, এপার বাংলার পাশাপাশি রয়েছে ওপার বাংলার খাবারও।
কফি শেষ হতে না-হতেই টেবিলে এলো সর্ষে আলু, কড়কড়া আলু ভাজা, আচারি বেগুন, ডাল মহারানী আর রোগান জোশ। এগুলোর সঙ্গ দিতে হাজির বাসমতী চালের ভাত আর গরম গরম ফুলকো লুচি।
বাঙালির হেঁসেলের এক অসাধারণ খাবার হলো এই লুচি। এমন ফুলকো লুচির স্বাদের কাছে পরোটা হার মানতে বাধ্য। ডাল মহারানীর সঙ্গে এর জুড়ি রীতিমতো অসাধারণ। অনেকটা ডাল মাখানির মতো হলেও স্বাদ খানিকটা ভিন্ন। অল্প আঁচে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেখে, ক্রিমি টেক্সচার না আসা পর্যন্ত জ্বাল দেওয়া হয় তা। রাতভর পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয় এই ডাল। জ্বাল দিয়ে ক্রিমি টেক্সচার এলে তাতে মসলা দিয়ে যোগ করা হয় মালাই! পাঞ্জাবি এই খাবার ওপার বাংলার হেঁসেলে স্থায়ী হয়েছে এর অসাধারণ স্বাদের কারণে। এরপর পালা আচারি বেগুন চেখে দেখার। বেগুন রান্নার এর থেকে ভালো উপায় আর কী হতে পারে! বাংলার খাবারের সাম্রাজ্যে এ পদের আগমনও পাঞ্জাব থেকে। কালোজিরা, সর্ষে, গরমমসলা, শুকনো আমের গুঁড়া আর দই দিয়ে বেগুনকে সমাদর করে রান্না করা হয়। টক-মিষ্টি-ঝাল-নোনতা, তেতো ছাড়া বাঙালির স্বাদের সবই আছে এই এক পদে। লুচির সঙ্গে মন্দ নয়। এরপর পালা রোগান জোশের। কাশ্মীরি এই খাবারও বাংলায় মোগলায়নের ফসল। ফার্সি ভাষায় রোগান অর্থ গলানো মাখন বা তেল আর জোশ অর্থ আগ্নেয় বা গরম। অর্থাৎ এই খাবারের রান্নার প্রক্রিয়া হলো প্রচন্ড তাপে তেলের সাহায্যে তৈরি সসে মাংস। তা মূলত খাসিরই হয়ে থাকে। এখানেও ব্যতিক্রম নয়। কাশ্মীরে রতন জট নামের শিকড় ব্যবহার করে লাল রং আনা হতো, এখানে পুরোটাই মসলা আর টমেটোর ক্যারিশমা। লুচিতে ঝোল মাখিয়ে মুখে নিতেই খাসির স্বাদ পাওয়া গেল। খাসির মাংসের স্বাদ ছড়িয়ে গেছে পুরো গ্রেভিতেই। এরপরে এক টুকরো মুখে দিতেই যেন গলে গেল। সুনিপুণভাবে পুরো মাংসই সেদ্ধ হয়েছে।
লুচির স্বাদ নেওয়ার পর এবার পালা ভাতের। ঝরঝরে বাসমতী চালের ভাত। প্রথম পাতেই আলু ভাজা। কুড়মুড়ে। কলকাতায় এ ধরনের আলু ভাজা প্রচলিত। ¯্রফে আলু, লবণ আর ডুবো তেলের কারসাজি। খেতে মন্দ নয়। এরপর পাতে এলো সর্ষে আলু। মাখা মাখা আলু—শর্ষে বাটায় তার স্বাদ যে এতটা খোলতাই করে, তা কে জানত! ভাত আর বেগুনের সংগত তো বাঙালির ক্ল্যাসিক খাবার। এরপর খাসির ঘন লাল গ্রেভিতে বর্ণময় হয়ে উঠল পাত। আর শেষ পাতে ডাল, খাসির মাংসে কামড়—জম্পেশ! পেটে যখন আর একটা দানাও যাওয়ার মতো নেই, তখনই টেবিলে এসে হাজির হলো ভাপা সন্দেশ। এতে ছানার স্বাদের পাশাপাশি পাওয়া যায় ডাবের স্বাদ! শেষ পাতেও চমক।
মরিচ অ্যান্ড ম্যাংগোতে স্টার্টারে রয়েছে ভেজ আর নন-ভেজ অপশন। মোচার চপ, ভেজিটেবল কাটলেট, চানা আম কাসুন্দি পাতুরি আর ঝুরি আলু ভাজা ভেজ অপশনে। আর নন-ভেজে রয়েছে কাঁকড়া চিংড়ি ভাপা, চিকেন কাটলেট আর প্রন কাটলেট। ডাল ও ভর্তার তালিকায় রয়েছে ছোলার ডাল, ডাল মহারানী, মুড়ি ঘণ্ট, আলু ভর্তা, শুঁটকি ভর্তা, মাছের ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা আর বেগুন ভর্তা। নিরামিষাশীদের জন্য মেইন ডিশে রয়েছে ভেজিটেবল কোর্মা, ভেজিটেবল লাবড়া, পটোলের দোলমা, হিং আলুর দম, আচারি বেগুন, মোচার ঘণ্ট, পালক পনির আর আম দিয়ে ভিন্ডি। মাছ মাংসে যাদের অরুচি নেই, তাদের জন্য মেইন ডিশের তালিকা বেশ লম্বা। ভেটকি মাছের পাতুরি, ডাব চিংড়ি, গন্ধরাজ ভেটকি, রূপচাঁদা ফ্রাই, লইট্টা ফ্রাই, সর্ষে ইলিশ, কাঁচা লঙ্কা ধনিয়ার মুরগি, ডাকবাংলো চিকেন, চিকেন কোর্মা, ময়মনসিংহের মুরগি ভাজা, ডিমের কোরমা, মাটন কষা, মাটন রোগান জোশ, ব্রেইন মাসালা, মাটন কোর্মা, তাওয়া আচারি বিফ আর বিফ মাসালা। এই মেইন ডিশগুলোকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য রয়েছে লাচ্ছা পরোটা, লুচি, ভেজিটেবল পোলাও, বাসমতী চালের ভাত। রায়তা আর স্যালাড তো রয়েছেই। মেইন ডিশগুলো ছাড়াও সন্ধ্যার জলখাবারের জন্য প্ল্যাটারও রয়েছে ৩ ধরনের, চায়ের সঙ্গে। তাতে আপত্তি হলে রয়েছে চিকেন রোল, এগ রোল আর আলুর চপ। সাপ্তাহিক ছুটির দুদিনে সকালের নাশতাও মেলে। চার পদের প্ল্যাটার রয়েছে এখানে। আর চাইলে চিকেন মাসালা, বিফ মাসালা, মাটন পায়া, হালুয়া, চিকেন স্যুপ, মিক্সড ভেজিটেবল আর মুগ ডাল আলাদাভাবেও নেওয়া যায়।
এই শহরে গাদাখানিক অথেনটিক বিজাতীয় খাবারের ভিড়ে এক টুকরো আশা হয়ে ইতোমধ্যেই জ্বলজ্বল করতে শুরু করেছে মরিচ অ্যান্ড ম্যাংগো।
লেখা ও ছবি: আল মারুফ রাসেল