ফুড বেনিফিটস I তেঁতুল
খুব স্বাস্থ্যকর। কিছু জটিল রোগের পথ্যও বটে। খনিজ ও ভিটামিনে ভরপুর। কাঁচা ও পাকা– উভয় অবস্থাতেই সুস্বাদু
সারা বছরই পাওয়া যায় তেঁতুল। আমাদের দেশে সস্তা হলেও দক্ষিণ আফ্রিকায় এর দাম চড়া। ফলটির আঁতুড়ঘর সম্ভবত ভারতবর্ষে। ফার্সি ভাষায় তেঁতুলকে ‘তামর-ই-হিন্দ’ বলে। এর বাংলা অর্থ ‘ভারতের খেজুর’। যদিও তা টক এবং খাদ্যগুণে ফলটি যথেষ্ট এগিয়ে। ১০০ গ্রাম কাঁচা তেঁতুলে ক্যালসিয়াম আছে ২৪ মিলিগ্রাম, আয়রন ১ মিলিগ্রাম, শর্করা ১৩.৯ গ্রাম, আমিষ ১.১ গ্রাম, চর্বি ০.২ গ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.০১ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০২ গ্রাম, ভিটামিন সি ৬ মিলিগ্রাম, খনিজ লবণ ১.২ গ্রাম এবং খাদ্যশক্তি ৬২ কিলোক্যালরি। পাকা তেঁতুলের পুষ্টিমান কাঁচা অবস্থার চেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম পাকা ফলে ২৩৯ ক্যালরি পাওয়া যায়। এ ছাড়া প্রোটিন আছে ২.৮ গ্রাম, শর্করা ৬২.৫ গ্রাম, ফাইবার ৫.১ গ্রাম, চর্বি ০.৬ গ্রাম, ফসফরাস ১১৩ মিলিগ্রাম, লৌহ ২.৮২ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৭৪ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ২ মিলিগ্রাম, খনিজ পদার্থ ২.৯ গ্রাম, ক্যারোটিন ৬০ মাইক্রোগ্রাম, ভিটামিন বি ০.৩৪ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৬২৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন ই ০.১ মিলিগ্রাম, সেলেনিয়াম ১.৩ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেশিয়াম ৯২ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম, দস্তা ০.১২ মিলিগ্রাম এবং তামা ০.৮৬ মিলিগ্রাম। এসব উপাদান মানুষের শরীরের নানা রোগ সারায়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ কমায়। যদিও এটি একটি প্রচলিত বিশ্বাস মাত্র। হঠাৎ ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেলে এই ফল খাওয়াতে বলেন অনেকে। ধারণা করা হয়, পানিতে তেঁতুল মিশিয়ে নিয়মিত পান করলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। সে ক্ষেত্রে বীজ ছাড়িয়ে আঁশসহ এই ফলের ২৫ গ্রাম গুলিয়ে প্রতিদিন খেতে হয়। তাতে লবণ বা চিনি যোগ করা হয় না। টারটারিক অ্যাসিড থাকায় হজমশক্তি বৃদ্ধিতে কাজে লাগে তেঁতুল। এর ডায়াটারি ফাইবার পরিপাক সহায়ক অ্যাসিডের ক্ষরণ নিশ্চিত করে। তেঁতুলের বিলিয়াস সাবস্টেন্স বদহজমের আশঙ্কা হটায়। ক্রনিক কনস্টিপেশন সারায়। পেট ফেঁপে থাকলে এক কাপ পানিতে সামান্য লবণ ও গুড়যোগে পুরোনো তেঁতুল গুলে খেলে উপকার পাওয়া যায়। আয়ুর্বেদ চিকিৎসা পদ্ধতিতে এর পাতা ডায়রিয়া সারাতে ব্যবহৃত হয়। সেটির রস বের করে খেলে সর্দি, প্র¯্রাবের যন্ত্রণা ও পাইলস সারে। কৃমি দূর হয়। তেঁতুল পাতার রস কাশি সারাতেও সক্ষম। এ উদ্দেশ্যে পানিতে লবণ ও গুড়যোগে পুরোনো তেঁতুল গুলে নিয়মিত খাওয়া যেতে পারে। এমনকি উচ্চমাত্রায় মদ্যপানের ফলে লিভারে যে ক্ষতি হয়, তা-ও সারাতে পারে এর পাতার রস। তেঁতুলগাছের ছাল ও শিকড় পেটের ব্যথায় ওষুধ হিসেবে কাজ করে। পাতা ও বাকল—উভয়েই অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল। তাই সেগুলো শরীরের ক্ষত সারাতে পারে।
তেঁতুলে আয়রন থাকায় তা শরীরের লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ বাড়িয়ে রক্তস্বল্পতা দূর করে। এতে প্রচুর ভিটামিন বি কমপ্লেক্স থাকে; যা মগজের উন্নতি করে স্নায়ুকোষের শক্তি বাড়ায়। ফলে কগনেটিভ ফাংশন ভালো থাকে। এ কারণে তেঁতুল খেলে বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি বাড়ে। মরণব্যাধি ক্যানসারও রোধ করতে পারে ফলটি। তেঁতুলে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এই প্রতিরোধ গড়ে তোলে; যা কিডনি ফেইলিউর ও ক্যানসারের আশঙ্কা কমায়। পাকা তেঁতুল হৃদ্্রোগ প্রতিরোধ করে। নিয়মিত হাঁটার পাশাপাশি এ ফল রোজ ২০-৩০ গ্রাম করে খেলে হার্ট ব্লক হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তেঁতুলের সঙ্গে রসুন মিশিয়ে খাওয়া হলে খারাপ কোলেস্টেরল কমে এবং ভালোটি বাড়ে। কাজটি করে এর ফ্ল্যাভনয়েড উপাদান। এ ফলের পটাশিয়াম, টারটারিক ও ম্যালিক অ্যাসিড কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। তেঁতুল ও রসুন একসঙ্গে খেলে শরীরের চর্বি কমে। ফলটির রস শরীরে হাইড্রোক্সিসিট্রিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়ায়। ফলে অতিরিক্ত চর্বি কমে। ফ্যাট বেরিয়ে গেলে যৌনশক্তি বাড়ে। অর্থাৎ, প্রজনন স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে তেঁতুল। এটি জ্বরেরও পথ্য। ম্যালেরিয়া কমাতে তেঁতুল পাতার চা পান করা যেতে পারে। হাইড্রোক্সিসিট্রিক অ্যাসিড অতিরিক্ত চর্বি কমিয়ে শরীরের ওজন কমায়। তা ছাড়া তেঁতুল আঁশজাতীয় খাবার হওয়ায় এটি খেলে ক্ষুধা দমে যায়। এর প্রভাব শরীরে পড়ে এবং স্থূলতা কমে। নিয়মিত তেঁতুল খাওয়ালে প্যারালাইসিস রোগীর অনুভূতি ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। হাত-পা জ্বালা করার সমস্যা থাকলে রাতে পাকা তেঁতুল ভিজিয়ে রেখে সকালে শুধু পানিটুকু পান করলে উপকার পাওয়া যায়। ধুতরা, কচু ও অ্যালকোহলের বিষক্রিয়া নিরাময়ে ফলটি খাওয়া যেতে পারে। তেঁতুল খেলে চোখের জ্বালাপোড়া দূর হয়, চোখ ওঠা সমস্যা থেকে রেহাই মেলে। এটি গর্ভকালীন বমিভাব থেকে পরিত্রাণ দেয়। শরীরের কোথাও আঘাত পেলে কাঁচা তেঁতুল গরম করে ক্ষতস্থানে প্রয়োগ করলে ব্যথা কমে। মুখে ঘা হলে ফলটি পানিতে গুলে কুলি করলে আরামবোধ হয়। এটি অ্যালার্জি প্রতিরোধকও। স্কেলিটাল ফ্রুরোসিস রোগের প্রকোপ কমাতে তেঁতুল কাজে লাগে। এ ছাড়া বুক ধড়ফড় করা, মাথা ঘোরানো, আমাশয়, ক্ষুধামান্দ্য, হাঁপানি ও দাঁতব্যথা সারিয়ে তুলতে তেঁতুল খাওয়া যেতে পারে।
তেঁতুলের বীজও বিভিন্ন রোগের পথ্য। তাতে আলফা অ্যামিলেস অ্যানজাইম থাকে; যা রক্তে চিনির পরিমাণ কমায়। ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে। বীজ ছাড়া তেঁতুল খেলেও বহুমূত্র রোগে উপকার পাওয়া যায়। ফলটি শরীরে কার্বোহাইড্রেটের শোষণমাত্রা কমায়। এতে ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কমে। সে ক্ষেত্রে বীজ ছাড়িয়ে আঁশসহ এই ফলের ২৫ গ্রাম গুলিয়ে নিয়মিত খেতে হয়। তেঁতুলের বীজের আরও একটি গুণ হচ্ছে, তা গুঁড়া করে খেলে আলসার সারে। বিশেষ করে পেপটিক। এই ফলের পলিফেনলিক কম্পাউন্ড আলসার প্রতিরোধ ও প্রতিকার করে।
ত্বকচর্চায়ও তেঁতুল উপকারী। এটি খেলে ক্ষতিকর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে চামড়া সুরক্ষিত থাকে। অ্যাকনে দূর করতেও তেঁতুল উপকারী। এ ফলের হাইড্রোক্সি অ্যাসিড ত্বকের এক্সফোলিয়েশনে সাহায্য করে। ফলে মরাকোষ দূর হয়। এতে ত্বক উজ্জ্বল দেখায়। ব্রণ দূর করতে ব্যবহার করা যেতে পারে তেঁতুলের বীজের গুঁড়া। এই চূর্ণের মধ্যে টক দই ও হলুদগুঁড়া মেশালে যে প্যাক তৈরি হয়, তা আক্রান্ত স্থানে মেখে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। তারপর কুসুম গরম পানিতে ধুয়ে ফেললে ধীরে ধীরে ব্রণ চলে যায়। গলার কালো দাগ দূর করতেও কাজে লাগে তেঁতুলের বীজের গুঁড়া। তাতে গোলাপজল ও মধু মেশালে একটি প্যাক তৈরি হয়। সেটি গলায় ২০ মিনিট মেখে রাখার পর ধুয়ে ফেলতে হবে। নিয়মিত এ কাজ করলে খুব অল্প সময়েই কালো দাগ মিলিয়ে যায়।
তেঁতুলের খাদ্যগুণ বহুমাত্রিক। তবু এটি খাওয়ার বেলায় কিছুটা সতর্কতা প্রয়োজন। নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো সেবনকালীন তেঁতুল খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। ফলটি নিয়মিত বেশি বেশি খাওয়ার ফলে রক্তের সিরাম গ্লুকোজ কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়। তা থেকে অ্যালার্জি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তেঁতুলে উচ্চমাত্রার অ্যাসিড থাকে। যা দাঁতের এনামেল নষ্ট করে দিতে পারে। অতিরিক্ত তেঁতুল খাওয়ার ফলে পিত্তপাথর হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। অ্যাসিডিক হওয়ায় ফলটি পাকস্থলীতে অম্লের মাত্রা বাড়িয়ে অসুস্থ করে দিতে পারে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট