ফিচার I ফুড for ফরচুন
ভাগ্যে আস্থাশীল মানুষ খাদ্যকেও জড়িয়ে নিয়েছে ভবিষ্যতের সঙ্গে। আকাক্সক্ষা- আগামী দিনগুলো সুখে কাটুক। এটিই পরিণত হয় বিশ্বাসে। তা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে খাদ্যসংস্কৃতিতে
সংস্কৃতির অংশ খাবার। এর সঙ্গে লোকাচারের সম্পর্ক নিবিড়। আছে বিশ্বাসের ঘনিষ্ঠতাও। বছর শুরুর দিনে ভালো কিছু খেলে বারো মাসই দামি খাবার জুটবে- এমন বিশ্বাস বাঙালির লোকজীবনেও টিকে আছে। কিছু জাতিতে নির্দিষ্ট কিছু খাদ্যকে সৌভাগ্যের বাহক গণ্য করা হয়। খাদ্যসংস্কৃতির মধ্যে ভালোমন্দের বোধ বিশেষভাবে জড়িত। এসবের বেশির ভাগের ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে কিছুর পেছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য আছে। যেমন কিউবা, ডেনমার্ক, স্পেন ও পর্তুগালে বছর শুরুর দিনে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য ১২টি করে আঙুর খায়। যত নম্বর ফলটি খেতে টক হবে, তত নম্বর মাসটি খারাপ কাটবে বলে বিশ্বাস করা হয়। আসলে এটি ছিল একটি রটনা, যার মূলে ছিল আঙুর বিক্রেতাদের মুনাফা বাড়ানো। পরে তা রীতিতে পরিণত হয়। ১৯০৯ সালে এর আনুষ্ঠানিক সূচনা। ফিলিপাইনেও ১২টি ফল খেয়ে নতুন বছর যাচাইয়ের প্রথা আছে। তবে তা আঙুরই হতে হবে, এমন নয়।
সৌভাগ্যের খাবার হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিবেচিত হয় ফল। বিশেষ করে গোলাকৃতিরগুলো। বৃত্তের সঙ্গে বর্ষচক্রের কাল্পনিক সাদৃশ্য করে গোল ফলের সঙ্গে লোকাচার যুক্ত হয়েছে। চীনে নববর্ষের প্রথম দিনে সপরিবারে কমলালেবু খাওয়া হয়। এ ফলের আকার ও রঙ- উভয়কেই সৌভাগ্যের বাহক ভাবা হয় সে দেশে। সম্পদ ও প্রাচুর্যের প্রতীক হিসেবেও এটি বিবেচ্য। ভিয়েতনামে সৌভাগ্যের প্রতীক গণ্য হয় লাল। তাই তরমুজ খেয়ে বছর শুরু করে তারা। গ্রিক মিথেও ফলের উপস্থিতি আছে। বছর শুরুর মধ্যরাতে তারা একটি ডালিম বা বেদানার উপর সজোরে আঘাত করে। অথবা মেঝেতে ছুড়ে ফাটায়। বিশ্বাস করা হয়, ফলের দানা ঘরজুড়ে যত ছড়াবে, ভাগ্য ততই সুপ্রসন্ন হবে। তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলেও ডালিম সৌভাগ্যের প্রতীক। শুধু ফলই নয়, বিশ্বের কিছু দেশে গোলাকৃতির অন্যান্য খাবারকেও সুপ্রসন্ন ভাগ্যের নির্ধারক মানা হয়। বিশেষ করে রুটি, কুকিজ, কেক ও পিৎজা। পৃথিবীর দক্ষিণাংশে অবস্থিত দেশগুলোর সংস্কৃতিতে গোল্ডেন কর্ন ব্রেড খেয়ে বছর শুরু করার প্রথা আছে। অতি সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় কেউ কেউ এই রুটিতে বেশি করে ভুট্টার দানা যোগ করেন। অনেকে আবার টপিংয়ে মধু বা মাখন দেন। তাদের ধারণা, রুটি যত সোনালি হবে, নতুন বছরে ভাগ্য তত সুপ্রসন্ন হবে। গ্রিক ঐতিহ্যে খাওয়া হয় ভ্যাসিলোপিটাও। এটি মিষ্টি স্বাদের রুটি। ভেতরে কয়েন পুরে তৈরি এ খাবার অন্ধকার ঘরে কাটা হয়। রুটি ভাগ করার দায়িত্বে থাকেন গৃহকর্তা। খাওয়ার সময় যিনি কয়েনটি পান, তাকে সৌভাগ্যবান ভাবা হয়। এই লোকবিশ্বাস আছে ফ্রান্সেও। সে দেশের মানুষ কিংস নামের একটি কেকের মাধ্যমে ভাগ্য নির্ণয় করে।
বছর শুরুর মধ্যরাতে ভুনা মুরগি বা পাখির একটি হাড়ের প্রান্ত ধরে টানেন দুজন। অস্থিটি মাঝ বরাবর ভাঙলে উভয় ব্যক্তির ভাগ্যই সুপ্রসন্ন। না হলে, যার ভাগে বড় অংশ যাবে, তিনি সৌভাগ্যবান। বছরব্যাপী তার ইচ্ছাই পূরণ হবে। এটি রোমে প্রচলিত বিশ্বাস। প্রাচীনকাল থেকে। মাটির নিচের উৎপাদিত সবজিগুলোকেও সৌভাগ্যের প্রতীক মানা হয়। বিশেষ করে আলু, গাজর, মুলা, পেঁয়াজ, শালগম, রসুন, আদা- এসব রূপান্তরিত কান্ডকে। যুক্তি হলো, উদ্ভিদের গোড়া মাটির নিচে থাকে। ধারণা করা হয়, তা খেলে জীবনের ভিত্তি মজবুত হবে। জার্মানি ও ডেনমার্কে এই লোকাচার প্রচলিত। রূপান্তরিত খাদ্য ছাড়াও সৌভাগ্যের প্রত্যাশায় সরিষা শাক খায় তারা। জার্মানি, আয়ারল্যান্ড ও আমেরিকার কিছু অঞ্চলে বাঁধাকপিকে আর্থিক প্রাচুর্যের সঙ্গে তুলনা করা হয়। পেনসিলভানিয়া ও নেদারল্যান্ডসের মানুষেরা দীর্ঘায়ু কামনা করে খায় সবজি। তারাও এটিকে অর্থ আনয়নকারী ভাবেন। বছরের শুরুতে খান।
এ ছাড়া পালংশাক খাওয়া হয়। সবুজ যেকোনো শাককেই নগদ অর্থের প্রতীক হিসেবে গণ্য করে বিশ্বের বেশ কিছু সংস্কৃতি। বিশ্বাস করা হয় সেগুলো খেয়ে বছর শুরু করলে ‘ক্যাশ মানি’ পকেটে আসতে থাকবে বছরভর। বাদ যায় না শস্যদানাও। বিশেষ করে যেগুলো রান্নার পর ফুলে ওঠে। যেমন ভাত, বার্লি, ব্ল্যাক আইড পি ইত্যাদি। ভারতীয় মিথলজি অনুসারে, ভাত অশুভ শক্তি বিনাশী। তাই কিছু কিছু সংস্কৃতিতে বছর শুরুর মধ্যরাতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ভাত খাওয়ার রেওয়াজ আছে। ব্ল্যাক আইড পির সঙ্গেও এমন বিশ্বাস জড়িত। এটি একধরনের মটরদানা। বীজের একটুখানি অংশ কালো হওয়ায় এই নামকরণ। রান্নার পর ফুলে ওঠে বীজটি। তাই পুয়ের্তোরিকো, ব্রাজিল, হাঙ্গেরি ও জাপানে এটি সৌভাগ্যের খাবার হিসেবে বিবেচ্য। একই বিশ্বাসে একধরনের সবুজ দানা খাওয়া হয় ইতালিতে। এ ছাড়া সেই দেশের বাসিন্দারা মসুর ডালকে কয়েনের সঙ্গে তুলনা করেন। আর্থিক সমৃদ্ধির আশায় বছরের শুরুর দিনে এই ডাল খাওয়া হয়। সৌভাগ্যের খাবারের তালিকায় আছে নুডলসও। বছর শুরুতে জাপানিরা তা খায়।
নুডলস খেলে আয়ু বাড়ে- এই বিশ্বাস এশিয়ার অনেক দেশেই প্রচলিত। চীনের মানুষেরা দীর্ঘায়ু কামনা করে এ খাবার বিশেষভাবে রাঁধে ও খায়। এমনভাবে রান্না হয় যাতে নুডলস ভেঙে না যায়। খাওয়ার সময়ও না চিবিয়েই খেয়ে ফেলে। তাতেই নাকি ভাগ্য খোলে।
স্রোত কেটে এগিয়ে চলে মাছ। এ ছাড়া প্রাণীটি একসঙ্গে অনেক ডিম দেয়। এই দুই বৈশিষ্ট্য মাছকে করেছে সৌভাগ্যের প্রতীক। জলজ এ প্রাণীর এগিয়ে যাওয়ার গতিকে মানুষের জীবনের সম্ভাবনা ও সমৃদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করে বছরের শুরুতে তা খাওয়া হয়। ইউরোপিয়ান ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ানদের মধ্যে এ বিশ্বাস প্রচলিত। কিন্তু চিংড়ি বা কাঁকড়া খাওয়া হয় না। কারণ, এগুলো পেছনেও চলতে পারে। জার্মানিদের কেউ কেউ বছরের শুরুর দিন থেকেই মাছের আঁশ মানিব্যাগে নিয়ে ঘোরেন। সারা বছর নগদ অর্থে পকেট ভরপুর থাকার প্রত্যাশায় এটি করেন তারা। এ ছাড়া মাছ খেয়ে বছর শুরু করলে যেকোনো বিপদ খুব সহজেই মোকাবিলা করা যায় বলে বিশ্বাস করা হয়।
ভারতীয়দের অনেকেই বছর শুরু করেন দই খেয়ে। এটি খেলে সারা বছর শক্তিসামর্থ্য বজায় থাকবে বলে বিশ্বাস করা হয়। পাশাপাশি সৌভাগ্য তো আছেই। খাবার ছাড়াও পানীয়র সঙ্গে সৌভাগ্য জড়িয়ে থাকার মিথও মানেন অনেকে। যেমন শ্যাম্পেইন। বছরের শুরুতে তিন গ্লাস শ্যাম্পেইন মাথার উপর দিয়ে পেছনে ছুড়ে ফেলার রীতি পালন করা হয় কিছু সংস্কৃতিতে। এতে মনের ঋণাত্মকভাব দূর হয় বলে বিশ্বাস করা হয়।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট