ফিচার I চিকনকারি
বস্ত্রপটের এই শিল্পকলা লক্ষ্ণৌ শহরটিকে ঐশ্বর্যময় করলেও এর সূচনা ঘটেছিল ঢাকাতেই। আজ তা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। লিখেছেন মোহাম্মদ মাহবুবুর নূর
ডিসেম্বর ২০১৭। মোগল রাজধানী দিল্লি ভ্রমণ সাঙ্গ করে ছুটছি ভারতের জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌর দিকে। অঞ্চলটি এখন বিখ্যাত চিকনকারির জন্য। এটি এমব্রয়ডারি সুতার কাজের একটি ধরন। এখানকার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেরও একটি। শুরু হয়েছিল নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায়। ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে অযোধ্যার চতুর্থ নবাব আসাফুদ্দৌল্লার হাত ধরেই রাজধানী হিসেবে লক্ষ্ণৌর যাত্রা। নবাবদের উদার মানসিকতা এবং শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ শহরটিকে এনে দিয়েছিল ভিন্নমাত্রা। সমগ্র ভারত থেকে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, কলাকুশলীরা এসে জড়ো হয়েছিলেন এখানে। ঠুমরি, কত্থক, চিকনকারি, জারদৌসি- সবই এই শহরের নিজস্ব সৃষ্টি। ফলে অঞ্চলটি পরিণত হয়েছিল ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানীতে। বর্তমানে চিকনকারির খ্যাতি ভারতের বাইরেও নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এর সৌন্দর্য এবং নিপুণতার কারণে। নবাব পরিবার এই শিল্পের বিকাশে যথার্থ ভূমিকা রেখেছিল।
লক্ষ্ণৌ ভ্রমণে শহরের সর্বত্রই চিকনকারির দোকানের দেখা মেলে। কোথাও যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি, অটো বা রিকশা ডাকলেই চালকদের প্রথম প্রস্তাবই থাকে গন্তব্যে পৌঁছানোর আগে বিনা ভাড়ায় চিকনকারির দোকান দেখার। আমিনাবাদ এলাকাটি লক্ষ্ণৌর বাজার অঞ্চল, অনেকটা ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের মতো, যেখানে বেশির ভাগই চিকনকারির দোকান। চক হলো পাইকারি মার্কেট এবং অভিজাত শোরুমগুলো হযরতগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত, যেগুলো অনেকটাই ঢাকার বেইলি রোডের মতো। লক্ষ্ণৌ শহরের মধ্যে অল্প দূরত্বে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে রয়েছে রিকশা।
চিকনকারির জন্য লক্ষ্ণৌ বিখ্যাত হলেও সেলাইয়ের এই ধরন মোগলরা পারস্য থেকে এনেছিল। এটির সূচনা হয় ঢাকাতেই। বাংলার মসলিন তখন বিশ্বসেরা। ১৬১৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির মসনদে বসেন সম্রাট জাহাঙ্গীর। তিনি সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের ভগ্নিপতি ইব্রাহিম খানকে ঢাকায় তৃতীয় সুবেদার নিয়োগ করেছিলেন। তার সময়েই মসলিন রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে এবং এর প্রভূত উন্নতি হয়। তিনি এই শিল্পের উন্নয়ন ও বাণিজ্যের তদারকির জন্য আলাদা বিভাগ তৈরি করেছিলেন। উন্নত মানের মসলিন সম্রাট, সুবাদার এবং তাদের পরিবারের জন্য কেনা হতো। এই শিল্পের উন্নতি ও এর ওপর নকশা তৈরিতে সম্রাজ্ঞী নূরজাহান যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি নতুন নতুন ঢং বা ফ্যাশনের সূচনা করেন। মোগল স্থাপত্যে শ্বেতপাথরের ব্যবহার এবং তার ওপর নকশার প্রবর্তনও করেন এই সম্রাজ্ঞী। তার প্রবর্তিত নকশায় সুতার কাজ সেই সময়েই ঢাকায় বিকশিত হয়েছিল। এখান থেকে রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরের সঙ্গে সঙ্গে সুতার কাজের এই ধারা সেখানে চলে যায়।
নবাব ওয়াজিদ আলী শাহর প্রাসাদে তার স্ত্রীদের মধ্যে তাকে খুশি করার এক প্রচ্ছন্ন প্রতিযোগিতা ছিল। বেগমদের একজন ছিলেন মুর্শিদাবাদের। তিনি নবাবকে খুশি করতে সাদা মসলিন কাপড়ের ওপর সাদা সুতার নকশায় বোনা একটি টুপি উপহার দিয়েছিলেন। তিনি এটি পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলেন এবং বেগমকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ফলে প্রাসাদে অন্য বেগমদের মধ্যেও নবাবকে খুশি করার জন্য এই সূচিকর্মের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। প্রথম পর্যায়ে কাজটি অভিজাতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর এই ধারণা সাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবেই লক্ষ্ণৌতে চিকনকারির বিকাশ ঘটে।
চিকনকারি বিকাশের আরেকটি ধারণা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত। তা হলো, ওস্তাদ মোহাম্মদ শের খান ছিলেন গরিব চাষি। তিনি এই বিদ্যা আয়ত্ত করেছিলেন একজন মুসাফিরের কাছ থেকে। বিদায়ী উপহার হিসেবে মুসাফির এটি তাকে শিখিয়েছিলেন। প্রচলিত গল্পটি এই : গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে গ্রামের পথ ধরে যাচ্ছিলেন মুসাফির। তৃষ্ণার্ত অবস্থায় তিনি শের খানের কাছে পানি চাইলেন। শের খান তাকে বাড়িতে ডেকে আপ্যায়ন ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বিদায়ের সময় মুসাফির শের খানকে চিকনকারির কাজের বিদ্যাটি শিখিয়ে বলেছিলেন, এটি তাকে কখনো অভুক্ত রাখবে না। ওস্তাদ শের খান এবং তার শিষ্যদের মাধ্যমে এই কলা আরও সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্ণৌতে বিকশিত হয়েছিল। এখন লক্ষ্ণৌ এবং এর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড এই চিকনকারি। সেখানে এই শিল্প বিকশিত হওয়ার একটি ভৌগোলিক কারণও রয়েছে। উত্তর প্রদেশে প্রচণ্ড গরমে মসলিনের ওপর চিকনকারির সুতার কাজের পোশাক বেশ আরামদায়ক। নবাবি সংস্কৃতিতে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বস্ত্রশিল্পের নতুন এই ধারার যাত্রা শুরু হয়েছিল। ধবধবে মিহি সাদা মসলিনের ওপর নিপুণ হাতে সাদা সুতায় অপূর্ব কারুকাজ সৃষ্টি করলেন শিল্পীরা। নকশার সূক্ষ্মতা বোঝাবার জন্য চিকন (মসৃণ) শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এ কারণে অভিজাতদের সাদা কাপড়ের ওপর সূক্ষ্ম সুতার কাজের এই পোশাক বিশেষ পছন্দের। এখন মসলিনের স্থলে বিভিন্ন কৃত্রিম কাপড়ও ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এটি সর্বসাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। চিকনকারি নামটি এসেছে ফারসি শব্দ ছিকিন, সিকেন বা সিকোইনের অপভ্রংশ থেকে, যার অর্থ সূচিকর্মবিশিষ্ট কাপড়। শুরু থেকে এখনো এই কাজে প্রধানত মহিলারাই যুক্ত।
চিকনকারিতে বত্রিশ ধরনের সূচিকর্মের ব্যবহার রয়েছে। এগুলোকে ছয়টি প্রধান প্রকরণে ভাগ করা যায়। তাইপচি (taipchi), সর্বাপেক্ষা সরল সূচিকর্ম, যা একটি নকশার রূপরেখা তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। বাখিয়া (Bakhia), কাপড়ের সামনের দিকে সুতার খুব কম অংশই দৃশ্যমান থাকে। কাপড়ের উল্টো দিকে ক্রিস-ক্রসিং সেলাইয়ের দ্বারা আলো-ছায়া তৈরির মাধ্যমে একটি নকশার অবয়ব সৃষ্টি হয়। খাতাও (Khatao), বাখিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তবে এটি আরও সূক্ষ্ম এবং মার্জিত। ফান্ডা (Phanda) ও মুড়ি (Murri), সুতার কাজের এই ধরন দুটি চিকনকারির প্রাণ। যেকোনো নকশা চিত্রিত করা হয় এই দুটি পদ্ধতিতে। ফান্ডা মানে বাজরার আকার, অন্যদিকে মুড়ি হলো চালের আকার। ধরন দুটি এতটাই কাছাকাছি যে পার্থক্য করা সাধারণের পক্ষে সম্ভব হয় না। জালি (Jaali), কাপড় বুননের সুতার মধ্যে সুচ-সুতা দ্বারা আবৃত করে ছোট ছোট ছিদ্র তৈরির মাধ্যমে জালি বোনা হয়।
চিকনকারির আরও একটি অনন্য ধরন ‘আনোখি বুটি’ নামে পরিচিত। মির্জা হাসান এটি সংযোজন করেন। এই নকশা মোগল স্থাপত্য, যেমন ‘তাজমহল’, ‘ফতেহপুর সিক্রি’সহ নবাবি স্থাপনা যেমন ‘রুমি দরজা’, ‘গ্রেট ইমামবাড়া’র কারুকাজ দ্বারা অনুপ্রাণিত। সাদা কাপড়ে নকশার মাধ্যমে এটির সূচনা হলেও এখন বিভিন্ন রঙের কাপড়ে ব্যবহৃত হয়। একটি কাপড় ডিজাইন করতে পনেরো দিন থেকে ছয় মাস পর্যন্ত সময় লাগে। লক্ষ্ণৌ এবং সংলগ্ন এলাকাগুলোতে এর প্রচুর কারখানা গড়ে উঠেছে। লক্ষ্ণৌ ভ্রমণে মেট্রোরেল, এয়ারপোর্টসহ বিভিন্ন জায়গায় অলংকরণে চিকনকারির ব্যবহার দেখা যায়। পুস্তক বিপণিতে রয়েছে এ-সম্পর্কিত বইয়ের সম্ভার। উল্লেখ্য, এই শিল্পের যাত্রা ঢাকাতে হলেও সেই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বাংলাদেশের জামদানি, যশোর স্টিচ প্রভৃতিকে যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপনের মাধ্যমে বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে একটি ‘মার্ক অব আইডেন্টিটি’ তথা স্বতন্ত্র পরিচয় প্রতিষ্ঠার এখনই সময়।
ছবি: লেখক
মডেল: সনিয়া ও স্মৃতি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: কোরাল ক্লসেট বাই রূপো শামস
ছবি: ফারাবী তমাল