skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I ভেগান ফ্যাশন

প্রাণী বাঁচানোর অভিপ্রায় থেকে এই ফ্যাশনের উদ্ভব। বিভিন্ন উদ্ভিদ, ফল ও সবজি এর উৎস। প্রাণবান্ধব ও প্রকৃতিনিষ্ঠ এই ধারার পোশাক এবং অনুষঙ্গের কদর বাড়ছে দিন দিন। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

‘ভেগান’ কথাটি শুনলেই সবার প্রথমে মাথায় আসে এমন একটি খাদ্যাভ্যাস, যেখানে সব রকমের আমিষ বাদ দিতে হয়। এমনকি দুধ, মধু, ডিমও। গত কয়েক দশকে এই ডায়েটের জনপ্রিয়তা বেড়েছে, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে ভেগানের সংখ্যা। তবে শব্দটি শুধু ডায়েটে সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি লাইফস্টাইলও বটে। আর এতে নেই কোনো প্রাণিজ পণ্যের অস্তিত্ব। কারণ, ভেগানরা প্রাণী রক্ষার অধিকারে বিশ্বাসী। প্রাণীদের আঘাত করে মানুষের কাজে লাগানোর পক্ষে নন তারা। সেটি খাবার থেকে শুরু করে পোশাক, ওষুধ, বিউটি প্রডাক্ট, বিনোদন, গবেষণা- যেখানেই হোক না কেন। ভেগানের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ডায়েটের মতো এখন ফ্যাশন ট্রেন্ডেও এর আধিপত্য বেড়েছে লক্ষণীয় হারে। শুধু ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের ভেতরেই ভেগান ফ্যাশন পণ্যের উৎপাদন বেড়েছে ১১৬ শতাংশ। সামনের দিনগুলোতে এই সংখ্যা আরও বেশি বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভেগান ১০১
এই ফ্যাশনে প্রাণীর ক্ষতি এড়িয়ে পোশাক ও আনুষঙ্গিক উৎপাদন এবং কেনা হয়। ভেগান কাপড় প্রাণী থেকে প্রাপ্ত উপকরণ, যেমন- চামড়া, পশম, উল, রেশম ইত্যাদি মুক্ত। অনেক জায়গায় ফ্যাশন বা বিউটি পণ্যে ব্যবহৃত অনুষঙ্গের মান এবং সম্ভাব্য ক্ষতির হার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন প্রাণীর উপর পরীক্ষা বা গবেষণা করা হয়। ভেগান ফ্যাশনে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
একে ‘নিষ্ঠুরতা-মুক্ত’ ফ্যাশনও বলা হয়। এর মূল লক্ষ্য হলো প্রাণীর প্রতি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির কারণে সৃষ্ট নিষ্ঠুরতা বন্ধ করা। কিন্তু ফ্যাশন আইটেম এবং স্টাইলিস্ট অ্যাকসেসরিজের ব্যবহৃত কিছু উপাদান প্রাণী থেকে আসে। বিভিন্ন জ্যাকেট, বুট, নানা ডিজাইনের জুতা বানাতে যে চামড়ার ব্যবহার করা হয়, তা আসে শূকর, গরু এমনকি কুমিরের মতো বন্য প্রাণী থেকে। বিভার, কাইয়োটি, মেষশাবক, খরগোশ ও শিয়াল থেকে সংগৃহীত হয় পশম। এই চামড়া ও পশম সংগ্রহ করতে প্রাণীগুলোকে হত্যা করা হয়। চোরাশিকারির হাতে প্রাণ হারায় বন্য প্রাণী। এ কারণে অনেক বন্য প্রাণী বিলুপ্তির পথে। ভেগান ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রাণীদের প্রতি এজাতীয় আচরণ বন্ধ করে এই উপকরণগুলোর জন্য নিষ্ঠুরতা-মুক্ত ভেগান বিকল্পের প্রচার ও প্রসার বাড়ানো। অনেক ব্র্যান্ড এখন এই পথেই হাঁটছে এবং তাদের গ্রাহকদের জন্য নৃশংসতা-মুক্ত ভেগান ফ্যাশন প্রডাক্ট তৈরি করছে।
ফ্যাশন বৃহত্তম কনজ্যুমার ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে গ্রাহককে সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ভেগান ফ্যাশনে ব্যবহৃত বেশির ভাগ উপকরণ প্রাকৃতিক উদ্ভিদতন্তু থেকে আসে। এখানে বিভিন্ন ফ্যাব্রিকের উৎস অর্গানিক কটন, বাঁশ, পাট, হেম্প ইত্যাদি। এগুলো একই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই। যারা এ ধরনের ফ্যাশন আইটেম পরতে চান, তাদের জন্য ভেগান ফ্যাব্রিক খুব ভালো অপশন। নন-ভেগান ফ্যাব্রিক যেমন চামড়া, পশম সংগ্রহ করতে যে কসাইখানা ব্যবহার করা হয়, সেগুলো গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, যা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান কারণ। এ জন্য পরিবেশবাদীরা সবাইকে ভেগান ফ্যাশন অনুসরণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে ভেগান ফ্যাশন সব সময় যে টেকসই এবং ভালো, তা কিন্তু নয়। এমন অনেক বিকল্প আছে, যা আনসাসটেইনেবল। যেমন চামড়ার বিকল্প হিসেবে অনেক জায়গায় প্লাস্টিক ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে এখন অনেক ব্র্যান্ড প্ল্যান্ট-বেসড ভেগান লেদার বানাচ্ছে। এগুলোর প্রধান উপকরণ আসছে আনারসের পাতা, মাশরুম, আপেল ইত্যাদি থেকে। আবার কিছু ব্র্যান্ড রিসাইকেল প্লাস্টিক ব্যবহার করছে বিভিন্ন রকমের ফ্যাশন পণ্য বানাতে, যেগুলো একই সঙ্গে ভেগান, টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব।
ভিন্নধারার ফ্যাশন
অনেক মানুষ ভেগান লাইফস্টাইল বেছে নিয়েছেন। তারা মনে করেন, এটিই পরিবেশ রক্ষার সবচেয়ে ভালো উপায়। পরিবেশগত পরিস্থিতি ও প্রাণী বিলুপ্তিকরণ রোধের জন্য ভেগান ফ্যাশন অনেক বড় একটি ভূমিকা পালন করতে পারে। তার মানে এই নয় যে পশম, উল, চামড়া থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হবে। এসব প্রাণিজাত উপকরণের এখন অনেক উদ্ভিজ্জ বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে।
ভেগান চামড়া
ফ্যাশনে চামড়ার ব্যবহার আদিকাল থেকে। এখনো চামড়ার পণ্য যেমন- জ্যাকেট, প্যান্ট, জুতা, ব্যাগ, বেল্টের চাহিদা অনেক বেশি। এর প্রয়োজন মেটাতে হত্যা করা হয় লাখ লাখ প্রাণীকে। এসবের ভেতর আছে কুমির, ঘড়িয়াল, গন্ডার, সাপ, গিরগিটির মতো বন্য প্রাণী। এগুলো হত্যা এবং চামড়া প্রক্রিয়াজাতের ফলে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে। চামড়াশিল্প অত্যন্ত আনসাসটেইনেবল ও আনএথিক্যাল। ফ্যাশন প্রডাক্টের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হয় গরুর চামড়া। এই প্রাণী প্রচুর গ্রিনহাউস গ্যাস ও বর্জ্য উৎপাদন করে। তা ছাড়া চামড়া ট্যানিংয়ের সময় যে বর্জ্য নিঃসৃত হয় এবং যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়- দুটিই শুধু পরিবেশের জন্যই নয়, এখানকার শ্রমিকদের শরীরের পক্ষেও সমানভাবে ক্ষতিকর। তবে আশার কথা, এর বিকল্প হিসেবে আছে বেশ ভালো মানের কিছু ভেগান অপশন। শুরুতে ভেগান চামড়া হিসেবে পিভিসি প্লাস্টিক বেশি দেখা যেত। এটি খুবই সস্তা এবং নিম্নমানের প্লাস্টিক। এর থেকে ভালো ভেগান চামড়া হচ্ছে পিইউ লেদার। অর্থাৎ পলিইউরোথিন। এটি সিনথেটিক ম্যাটেরিয়াল, দেখতে একদম চামড়ার মতো। তবে এর থেকে ভালো মানের ভেগান চামড়া আছে, যা সম্পূর্ণ প্ল্যান্ট বেসড। এসবের ভেতর সবচেয়ে বেশি নাম করেছে পিনাটেক্স এবং মাস্কিন। পিনাটেক্স আনারসের পাতা এবং মাস্কিন মাশরুম থেকে তৈরি। এ ছাড়া আছে আপেল লেদার। আসল চামড়া বা প্লাস্টিকের থেকে খুব নরম উপাদানে তৈরি হলেও এগুলো অনেক বেশি টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী। সবচেয়ে বড় কথা, এগুলো পরিবেশবান্ধব।
ফো ফার
পশমের ভেগান বিকল্পকে বলা হয় ‘ফো ফার’। এটি তৈরি হয় পলিয়েস্টার এবং সিনথেটিক ম্যাটেরিয়াল দিয়ে। যদিও ফো ফার আসল পশমের মতো নরম নয়। তবে এর থেকে ভালো বিকল্পও আর নেই।
ভেগান উল
ভেড়া, ক্যাশমেয়ার ছাগল, আলপাকা, অ্যাংগোরা খরগোশের লোম থেকে আসে বিভিন্ন ধরনের উল। এটি পেতে এসব প্রাণী চাষ করা হয়। ফলে গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ ঘটে। উলের বিকল্প হলো কটন। তবে তা সোয়েটার উলের মতো নরম এবং বেশি গরম অনুভূত হয় না। কটন কাপড় উলের মতো চুলকানি থেকে মুক্ত। এ জন্য এটি সেনসিটিভ স্কিনের জন্য বেশ ভালো।
বিকল্প সিল্ক: রেয়ন ও মডাল
ভেগান ফ্যাশনে সিল্কের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিকল্প হচ্ছে রেয়ন। এটি সিল্কের চেয়ে সস্তা, কিন্তু বেশি দীর্ঘস্থায়ী। রেয়ন ফ্যাব্রিকের কাপড়ের যত্ন নেওয়া সিল্কের মতোই কঠিন। তবে এর চেয়ে ভালো হচ্ছে মডাল। এটি রেয়নের মতোই কাঠের পাল্প থেকে তৈরি এবং অপেক্ষাকৃত পরিবেশবান্ধব। মডালকে সিল্ক বা রেয়নের চেয়েও ভালো ফ্যাব্রিক বলা যায়।
ভেগান ফেদার
জ্যাকেট এবং পোশাক ও অন্যান্য আনুষঙ্গিকের এমবেলিশমেন্ট হিসেবে বিভিন্ন পাখি বা নানা জাতের হাঁসের পালক ব্যবহার করা হয়। এর বদলে এখন বিভিন্ন ভেগান ব্র্যান্ড রিসাইকেল প্লাস্টিক ব্যবহার করছে।
আরও কিছু
গয়না হিসেবে মুক্তা অথবা পোশাকের আনুষঙ্গিক বানাতে প্রাণী থেকে পাওয়া গ্লু, রঙ (জেলাটিন), বোতাম (শামুক, ঝিনুকের খোল, পশুর শিং) ব্যবহার করাও ভেগানবিরোধী। এ ছাড়া এগুলো ব্যয়বহুল। এদের বিকল্প হিসেবে আছে টেকসই এবং সহজলভ্য ভেগান অপশন।
এথিক্যাল ব্র্যান্ড
বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন ধীরে ধীরে ১০০ ভাগ ভেগান ব্র্যান্ডের প্রসার বাড়ছে। এই ব্র্যান্ডের সবচেয়ে বেশি দোকান আছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানিতে। ভেগান পণ্যের বাজারে এই চারটি দেশের বিনিয়োগ অন্যান্য রাষ্ট্রের তুলনায় উল্লেখযোগ্য। এসব দেশের ভেগান ফ্যাশন ব্র্যান্ডের মধ্যে বিখ্যাত মাশু, অশোকা, উইল’স ভেগান স্টোর, নোইজ, ভিন অমি, হেম্প টেইলর, জেক্কে, বিড অ্যান্ড রিল, বিয়ন্ড স্কিন ইত্যাদি।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top