রূপরসদ I বায়োটিকের প্রো-প্রি-পোস্ট
ত্বকচর্চায় রাসায়নিক সামগ্রীর ব্যবহার কমে আসছে। ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাকৃতিক উপাদান। সেসবেও যোগ হচ্ছে নতুনত্ব। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
স্কিনকেয়ারের দুনিয়ায় নতুন সংযোজন মাইক্রোবায়োম। গত কয়েক বছর বেশ কটি স্বাধীন স্কিনকেয়ার লাইন একচেটিয়া মাইক্রোবায়োম ব্যবহার করে নানা রকমের ত্বকবান্ধব প্রডাক্ট বানিয়েছে। এমনকি ডিওর আর ল্যাকমের মতো নামজাদা ব্র্যান্ডগুলোও ঝুঁকেছে এই দিকে।
পরিপাকতন্ত্রে যেমন লাখ লাখ ব্যাকটেরিয়া খাবার হজমে সাহায্য করে, তেমনি ত্বকেও রয়েছে এমন অনেক অণুজীব বা মাইক্রোবায়োম। এগুলোর মধ্যে আছে প্রায় এক হাজার প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া এবং প্রায় আশি প্রজাতির ফাঙ্গাস। এ ছাড়া কিছু ভাইরাসও থাকে। এই মাইক্রোবায়োম ‘স্কিন ফ্লোরা’ নামেও পরিচিত। এগুলোর বেশির ভাগই ত্বকের জন্য বিশেষ উপকারী। মাইক্রোবায়োমের রয়েছে নিজস্ব ইকোসিস্টেম বা বাস্তুসংস্থান, যা ত্বককে সুস্থ ও ভালো রাখতে সহায়তা করে।
মাইক্রোবায়োম নিয়ে হাজারো গবেষণা হয়েছে। দেখা গেছে, ত্বকের উপরিপৃষ্ঠে এমন কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে, যা ত্বককে বাইরের পরিবেশের খারাপ প্রভাব থেকে রক্ষা করে। কিছু ব্যাকটেরিয়া প্যাথোজেনের (যেসব ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ সৃষ্টি করে) বিরুদ্ধে লড়াই করে। যেমন স্ট্যাফিলোককাস এপিডারমাটাইস। এটি সিক্রেট অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এজেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা বাইরের খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে স্কিন থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম। এটি ত্বকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে। স্ট্যাফিলোককাস এপিডারমাটাইস কিছু রাসায়নিক পদার্থ উৎপন্নের মাধ্যমে শক্তিশালী ঢাল গঠন করে ত্বকের শারীরিক অখন্ডতা রক্ষায় সহায়ক হয়। আরও আছে কিউটিব্যাকটেরিয়াম অ্যাকনে। ত্বকে সিবেসিয়াস গ্ল্যান্ড থেকে নিঃসৃত তেল হজম করে একটা অ্যাসিডিক পরিবেশ তৈরি করে। এই পরিবেশে প্যাথোজেন উপনিবেশ সৃষ্টি করতে পারে না।
মাইক্রোবায়োম ত্বককে বিভিন্ন রকমের ইনফ্ল্যামেশন ও সংক্রমণ এমনকি ক্যানসারের হাত থেকে সুরক্ষা দেয়। এ ছাড়া ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখে। কিছু ব্যাকটেরিয়া আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে।
মাইক্রোবায়োমের এই অভাবনীয় সব গুণাগুণ স্কিনকেয়ার প্রযুক্তিতে রীতিমতো বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ডগুলো বায়োটেকনোলজি ব্যবহারে তৈরি করছে মাইক্রোবায়োম ইনফিউসড বিউটি প্রডাক্ট। মাইক্রোবায়োম স্কিনকেয়ারকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রোবায়োটিক, প্রিবায়োটিক এবং পোস্টবায়োটিক।
প্রোবায়োটিক
এটি স্বাস্থ্যকর ব্যাকটেরিয়াকে সমর্থন করে। ইদানীং অনেককেই প্রোবায়োটিক ডায়েট করতে দেখা যাচ্ছে। এতে হজমের উন্নতি হয়। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং ত্বক ভেতর থেকে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এই প্রোবায়োটিক ত্বকে ভালো ব্যাকটেরিয়া উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে বিভিন্ন কারণে ত্বকের ভালো মাইক্রোবায়োমগুলো নষ্ট হয়ে যায়। যেমন- পরিবেশদূষণ, সূর্যের ইউভি রশ্মি, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত বা ভুল ব্যবহার, অতিরিক্ত রুক্ষ কেমিক্যাল যুক্ত স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট (ফেসওয়াশ, এক্সফোলিয়েটর) ব্যবহার ইত্যাদি। এ জন্য ডারমাটোলজিস্টরা প্রোবায়োটিকের সাপ্লিমেন্ট এবং টপিক্যাল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন। এখন প্রোবায়োটিক অনেক স্কিনকেয়ার প্রডাক্টেরই প্রধান উপাদান।
এটি ত্বকের যেকোনো ধরনের সমস্যা সমাধানের প্রধান দাওয়াই হতে পারে। রোজেশিয়া, একজিমা, সিস্টিক অ্যাকনে, সোরাইসিস ইত্যাদি চর্মরোগের চিকিৎসায় প্রোবায়োটিক ম্যাজিকের মতো কাজ করে। টপিক্যাল প্রোবায়োটিক কোলাজেন বৃদ্ধি করে ফাইন লাইনস, রিংকেল ইত্যাদি কমাতে পারে। আর্দ্রতা ধরে রাখতেও সহায়ক। এমনকি প্রোবায়োটিক ত্বকের সেনসিটিভিটি দূর করার ক্ষমতা রাখে। এটি সব ধরনের ত্বকেও জুতসই। এ জন্য বিউটি রুটিনে যোগ করা যেতে পারে প্রোবায়োটিক ইনফিউসড ময়শ্চারাইজার ক্রিম বা জেল, সাবান, ফেসওয়াশ, সেরাম, ইমালশন, অ্যাম্পুল, এসেন্স ইত্যাদি। প্রোবায়োটিক প্রডাক্টে বিফিডোব্যাকটেরিয়াম, ল্যাকটোব্যাসিলাস, ভিট্রোসিসিলা, ব্যাসিলাস কোগুলানস, স্টেফিলোককাস হোমিনিস, স্টেফিলোককাস এপিডারমাটাইস এবং স্ট্রেপ্টোকোকাস থার্মোফিলাস- এই ব্যাকটেরিয়া বেশি দেখা যায়।
আমাদের সবচেয়ে পরিচিত প্রোবায়োটিক হচ্ছে দই। বহু বছর ধরে আয়ুর্বেদিক রূপচর্চায় এর ব্যবহার হয়ে আসছে। দই একই সঙ্গে ত্বককে গভীর থেকে পরিষ্কার করে এবং আর্দ্রতা ধরে রাখে। এসব করে দইয়ের ভেতর থাকা ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলো। তাই প্রাকৃতিক উপায়ে ত্বকের যত্ন নিতে চাইলে মুখে দইয়ের প্যাক লাগানো যেতে পারে।
প্রিবায়োটিক
এটিকে ভালো ব্যাকটেরিয়ার ‘সার’ বলা যেতে পারে। এটি হজম অযোগ্য ডায়েটারি ফাইবার, যা উপকারী মাইক্রোবায়োমের খাদ্য হিসেবে কাজ করে, খারাপ ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধি হ্রাস করে এবং ত্বকে প্রোবায়োটিকের ব্যালান্স ধরে রাখে। এটি যে সব ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের জন্য রোজেশিয়া, অ্যাকনে, অ্যাটোপিক ডারমাটাইটিস হয়, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে ভালো ব্যাকটেরিয়াকে শক্তি জুগিয়ে থাকে। কিছু প্রিবায়োটিক আছে যারা ত্বকের পিএইচ ব্যালান্স বজায় রাখাসহ স্কিন ব্যারিয়ার ফাংশন ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ত্বকে বয়সের গতি কমাতেও বিশেষভাবে কার্যকর এটি।
প্রিবায়োটিক মূলত প্ল্যান্ট বেসড এবং কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট। রসুন, পেঁয়াজ, ওটস, হুইট ব্রান, অ্যাপারাগাস, কলা, তিসি, জেরুজালেম আরটিচোক, চিকোরি রুট, লিকস, বার্লি ইত্যাদি প্রিবায়োটিক সমৃদ্ধ খাবার। অনেক প্রিবায়োটিক স্কিনকেয়ার প্রডাক্টে এখন এসব সবজি আর শস্যের নির্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে।
এটি সব ত্বকের জন্যই সমানভাবে উপকারী। তবে সেনসিটিভ ত্বকের জন্য একটু বেশি ভালো। অ্যাকনেপ্রবণ ত্বকে নির্দ্বিধায় প্রিবায়োটিক যুক্ত স্কিনকেয়ার প্রডাক্ট যেমন, ময়শ্চারাইজার ক্রিম, জেল, লোশন, সেরাম, অ্যাম্পুল ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।
পোস্টবায়োটিক
এটি ফারমেনটেশন বাইপ্রডাক্ট। ভালো ব্যাকটেরিয়ার পুষ্টি জোগাতে সহায়তা করে। এতে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং হাইড্রেটিং ইফেক্ট। কোরিয়ান বিউটিতে পোস্টবায়োটিক স্কিনকেয়ার প্রডাক্টের অনেক বেশি ব্যবহার হতে দেখা যায়।
ত্বকের মাইক্রোবায়োম বৃদ্ধি এবং এদের শক্তিশালী করতে এটি অবদান রাখে। এ ছাড়া তারা এপিডার্মিসের মধ্য দিয়ে যেতে পারে এবং ত্বকের কোষ দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে তাদের জৈবিক ক্রিয়াকলাপ ত্বরান্বিত করতে পারে। পোস্টবায়োটিক উপাদানগুলো স্কিন ব্যারিয়ার ফাংশনের শক্তি বৃদ্ধি এবং যেকোনো ধরনের ইরিটেশন কমায়। এর জন্যই ত্বকের মাইক্রোবায়োমগুলো ফ্রি র্যাডিক্যালস, ইউভি রেডিয়েশন এবং দূষণের মতো পরিবেশগত কারণগুলোর বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে কাজ করতে সক্ষম।
পোস্টবায়োটিক উপাদানগুলোর মধ্যে আছে শর্ট চেইন্ড ফ্যাটি অ্যাসিডস, অরগানিক অ্যাসিড (ল্যাকটিক অ্যাসিড), পেপটাইডস, এনজাইম, পলিস্যাকারাইডস, পেপটিডোগ্লাক্যানস ইত্যাদি। মাস্ক, ক্রিম, সেরাম ইত্যাদিতে এর ব্যবহার করা হয়। প্রোবায়োটিক আর প্রিবায়োটিকের মতো পোস্টবায়োটিকও সব ধরনের ত্বকের জন্য উপযোগী।
মডেল: আনসা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: জিয়া উদ্দিন