আলাপন I সহজভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করি – ফ্লোরা সরকার
ফ্লোরা সরকার। অভিনেত্রী, লেখক, শিক্ষক। তার জীবনের অভিজ্ঞতা এবং সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ক্যানভাসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহমুদ সালেহীন খান
ক্যানভাস : কেমন আছেন?
ফ্লোরা সরকার : খুব ভালো থাকি। সত্যি ভালো আছি। আমার ছাত্ররা যখন বলে, ম্যাডাম, কেমন আছেন? আমি সব সময়ই বলি, ভালো আছি। ভালো থাকাটা বানানো নয়। আমাদের চারপাশে যে অবস্থা, তারপরও ভালো আছি। হাসিখুশি থাকি। তা না হলে জীবনকে উপভোগ করা যাবে না। স্বপ্ন দেখা যাবে না।
ক্যানভাস : সব সময় এই ভালো থাকার রহস্য কী?
ফ্লোরা সরকার : ভালো থাকার মজাটা এখানেই। এটি উপলব্ধির বিষয়। মানুষের জীবনে সুখ আসবে, দুঃখ আসবে, নানা রকম সংকটের মধ্য দিয়ে জীবন চলবে। উত্থান-পতনের মধ্যে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এখন হয়তো খারাপ সময় যাচ্ছে, সামনে ভালো সময় আসবে। টেনশন ডিপ্রেশনকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। ইতিবাচক এবং সহজ জীবন যাপন করতে পারলেই আপনিও বলতে পারবেন- ভালো আছি। দুঃখের সময়টাকে খুব লম্বা মনে হয়। আর সুখের সময়টা খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়। দুঃখের লম্বা সময়টাতেই ভালো থাকতে পারার মজাটাই অন্য রকম।
ক্যানভাস : এই লম্বা সময় পার করার টনিক কী হতে পারে বলে মনে করেন?
ফ্লোরা সরকার : অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকা। ভালো বই পড়া, টিভি অনুষ্ঠান দেখা। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা। অনেক কাজ আছে, যেগুলোর মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায়।
ক্যানভাস : বর্তমান প্রজন্ম নানা রকমের ডিপ্রেশনে ভুগছে। এদের উদ্দেশে কী বলবেন?
ফ্লোরা সরকার : আসলে তারা জানে না কী করতে হবে। সঠিক গাইডলাইন পাচ্ছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখনকার প্রজন্ম প্রযুক্তিতে ভয়ানকভাবে আসক্ত। এই যে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইউটিউবে বুঁদ হয়ে থাকছে তারা। আমি ফেসবুককে বলি জঙ্গল। বন নয় কিন্তু। বন অনেক সুন্দর। ফেসবুক নামক জঙ্গল থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে প্রজন্মের অস্থিরতা, অপরাধ, ডিপ্রেশন- কিছুই কমবে না। এন্টারটেইনমেন্ট এত বেশি হয়ে যাচ্ছে, তারা নিজেরাও কনফিউসড হয়ে গেছে। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গুরুজনদের কথা মানতে হবে। এখনকার জেনারেশন স্থির নয়। তারা অল্প জেনে অল্প কাজ করে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চায়।
ক্যানভাস : বর্তমান জেনারেশনকে সঠিক পথে আনতে আপনাদের প্রজন্মের দায়িত্ব কতটুকু?
ফ্লোরা সরকার : আমরা তো ব্যর্থ। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কারণ, আমরা যা সন্তানদের করতে মানা করি, সেটাই আমরা করি। তাহলে তারা আমাদের মানবে কেন? সন্তান যেন বিপথে না যায়, তার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে অভিভাবকের। পদে পদে লেগে থাকতে হবে। আমরা অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা তৈরি করতে পারি না। ফলে তারা অনেক কিছু আমাদের থেকে লুকায়। নতুন প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়টা ধরতে হবে। তাহলে তারা কী করছে, আমরা তা বুঝতে পারব। মা-বাবার এমনভাবে ছেলেমেয়েকে নজরদারিতে রাখতে হবে, যাতে তারা না বোঝে। শিক্ষকেরও বড় দায়িত্ব রয়েছে ছেলেমেয়েদেরকে সঠিক পথ দেখানোর ক্ষেত্রে। আমি যেহেতু শিক্ষকতা করেছি দীর্ঘ সময়, দেখেছি। যখন ক্লাস করাতাম, তখন দেখেছি ছাত্ররা আমার ক্লাস করত বেশি। শিক্ষকদের শুধু পাঠ্যবই পড়ালেই হবে না। আমার বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। আমি যখন ক্লাসে পড়াতাম, তখন অর্থনীতির সঙ্গে সিনেমার বিষয় নিয়ে আসতাম। বই পড়ার সঙ্গে, নিজের মেধাবিকাশের সঙ্গেও যে অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এই বিষয়গুলো নিয়েও বলতাম। ফলে আমার ক্লাসে ছাত্রদের উপস্থিতি বেশি থাকত। একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আমাকে শিক্ষকের জায়গাতে পড়ালে হবে না। ছাত্রের জায়গায় বসে তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝে পড়াতে হবে।
ক্যানভাস : বেশ কয়েক বছর ধরে ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কিন্তু মধুর যাচ্ছে না। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
ফ্লোরা সরকার : আসলে শিক্ষকেরাও এখন অস্থির সময়ের মধ্যে আছে। শিক্ষকদের দ্বারাও ছাত্রীরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। কী ভয়ংকর ব্যাপার! শিক্ষকেরা রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করছে। তাদের নিজেদের যে নৈতিকতাবোধ থাকার কথা, সেটি এখন আর নেই। এর অন্যতম কারণ হতে পারে অর্থনীতি। হতে পারে ক্ষমতার দাপট। শিক্ষক যখন ছাত্রের হাতে কলমের পরিবর্তে অস্ত্র তুলে দেওয়াকে নীরবে সমর্থন করবেন, তখন কেন ছাত্র শিক্ষককে মানবে? শিক্ষক যখন ছাত্রীকে ধর্ষণ করবেন, নানা রকমের যৌন হয়রানি করবেন, তখন কেন তারা শিক্ষককে মানবে? এসব হচ্ছে সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়ের কারণে।
ক্যানভাস : সামাজিক অবক্ষয় কীভাবে রোধ করা যাবে বলে মনে করেন?
ফ্লোরা সরকার : আমাদের দেশে অনেক মেধাবী ছেলেমেয়ে রয়েছে, তারা নতুন নতুন আইডিয়া শেয়ার করে পরিচিতি পেয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকেই আছে, তারা অর্থনৈতিক কারণে কিছু করতে পারছে না। সামাজিক অবক্ষয় রোধ করতে হলে সাংস্কৃতিক বিপ্লব হতে হবে। পারিবারিক বন্ধন নেই বললেই চলে। যন্ত্র আমাদেরকে খেয়ে ফেলছে। ভালো বই পড়তে হবে। সিনেমা দেখতে হবে। গান শুনতে হবে। নির্মল আড্ডায় বসতে হবে। জ্ঞানের বিনিময় থাকতে হবে। দেখবেন, মানুষের মধ্যে এখন নৈতিকতা, মমত্ববোধ হারিয়ে গেছে। এগুলো ফিরিয়ে আনতে পারলে সমাজ সুন্দর হতে পারে।
ক্যানভাস : আপনার শৈশব-কৈশোরের গল্প শুনতে চাই।
ফ্লোরা সরকার : শহরে বাস করেও যে এত সুন্দর শৈশব পার করা যায়, তা আসলে মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনিতে না থাকলে বোঝা যেত না। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ওখানে থাকতাম। আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় কী রান্না হতো, ওপরে থেকেও আমরা তা জানতাম। আবার ওপরে কী রান্না হতো, নিচে বাস করে আমরা তা টের পেতাম। যখন মন চেয়েছে যে কারও বাসায় খেতে চলে যেতাম। উঁচু-নিচু লেভেলের কোনো পার্থক্য ছিল না। পড়াশোনার বাইরে কলোনির ছেলেমেয়েরা আড্ডা খেলাধুলায় মেতে থাকতাম। পুরো কলোনিই যেন একটি পরিবার ছিল। সবাই সবাইকে চিনত। বিপদে এগিয়ে আসত। শহরের মধ্যে যেন এটি এক টুকরো গ্রাম।
এই পরিবেশ এখন কল্পনাও করা যায় না। পাশের ফ্ল্যাটে কী হচ্ছে, তা-ও আমরা জানি না।
ক্যানভাস : আপনার জীবনের মূল দর্শন কী?
ফ্লোরা সরকার : সহজ-সরল জীবন যাপন করা। আমি যা, সেভাবেই নিজেকে প্রকাশ করতে পছন্দ করি। ভান করে আসলে কিছু হয় না।
ক্যানভাস : আপনার লেখক হয়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই।
ফ্লোরা সরকার : আসলে আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন পত্রিকার প্রবন্ধ বা কলাম পড়ার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল। প্রবন্ধ পড়তে পড়তেই লেখার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেল। এখনো লিখছি। আমি প্রবন্ধ, বিশ্লেষণমূলক লেখা বেশি লিখি। চলচ্চিত্র নিয়ে লিখতে আমি পছন্দ করি।
ক্যানভাস : আপনাকে এখন আর নাটক, চলচ্চিত্রে দেখা যাচ্ছে না কেন?
ফ্লোরা সরকার : অনেক তো হলো। বয়স হয়েছে। এখন লেখালেখি নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছি। আর মিডিয়ার অবস্থা ভালো নয়। নাটক, সিনেমায় চরিত্র নেই। গল্পের কোনো বৈচিত্র্য নেই। তাই এখন আর ইচ্ছা হয় না।
ক্যানভাস : বাংলা চলচ্চিত্রের খুব দুঃসময় যাচ্ছে। এর থেকে উত্তরণের পথ কী বলে মনে করেন?
ফ্লোরা সরকার : আমাদের সময় গল্পনির্ভর সিনেমা ছিল। আর এখন গল্পের থেকে গ্ল্যামারকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। কবরী, ববিতাও কিন্তু স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছে ছবিতে। সেই সময় গ্ল্যামারের সঙ্গে ভালো গল্পের সিনেমা হতো। দর্শক ছবি দেখতে হলে যেত। এখন তো হলও বন্ধ করে দিচ্ছে মালিকেরা। তবে আমাদের চলচ্চিত্রে অনেক তরুণ আসছে। তারা চেষ্টা করছে ভালো কিছু করার। কিন্তু ভালো কিছু করতে হলে ভালো বিনিয়োগকারী লাগবে। সুস্থ পরিবেশ লাগবে। আমি সব সময় আশাবাদী, চলচ্চিত্রের এই সংকট বেশি দিন থাকবে না।
ছবি: মোঃ রাকিবুল হাসান