সাক্ষাৎকার I নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প
একুশ শতকে এসেও নারীকে প্রতিদিন নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আটকে যাচ্ছে স্বপ্ন। কিন্তু বাধা জয় করেও অনেক নারী সাফল্যের দেখা পেয়েছেন। দেশ-বিদেশে নিজের নাম উজ্জ্বল করেছেন। এ রকম কয়েকজন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ ও মাহমুদ সালেহীন খান
ছবি: সংগৃহীত
তনিমা তাসনিম অনন্যা
জ্যোতির্বিদ
নরসিংদীতে জন্ম। বাবার চাকরির সুবাদে শৈশব কেটেছে ঢাকায়। মা গৃহিণী। পাঁচ বছর বয়সী তনিমাকে গল্পের ছলে মঙ্গল গ্রহে মহাকাশযান অবতরণ সম্পর্কে বলতেন মা। সেসব গল্প শুনে মহাকাশ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন তনিমা। জ্যোতির্বিদ্যায় পড়াশোনার চিন্তা ভর করে তার মাথায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বিষয়ে পড়তে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ‘আমাদের দেশে এ ধরনের সুযোগ ছিল না বললেই চলে। এ জন্য আমাকে পরিবার ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমাতে হয়’- জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে নিজের আগ্রহের কথা এভাবেই বললেন অনন্যা।
আগ্রহ আর ইচ্ছাশক্তি কাজে লাগিয়ে অনন্যা হয়ে উঠেছেন সম্ভাবনাময় একজন জ্যোতির্বিদ। ২৯ বছর বয়সেই বিশ্বসেরা ১০ বিজ্ঞানীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন। রহস্যঘেরা ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরের বেড়ে ওঠা এবং পরিবেশের ওপর এর প্রভাব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ চিত্র এঁকে দেখিয়েছেন তিনি। তাতেই এসেছে সাফল্য।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক সায়েন্স নিউজ অনন্যার এ সাফল্যের খবর প্রকাশ করেছে। গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘এসএন টেন: সায়েন্টিস্ট টু ওয়াচ’-এর তালিকার শুরুতেই অনন্যাকে স্থান দিয়েছে বিজ্ঞানভিত্তিক জনপ্রিয় গণমাধ্যমটি। যেখানে তার কাজকে ‘অসাধারণ গবেষণা’ বলে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশি অনন্যা সবচেয়ে ভারী কৃষ্ণগহ্বর আঁকতে সক্ষম হয়েছেন। সচিত্র গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, মহাবিশ্বের কোথায় কীভাবে কৃষ্ণগহ্বর বেড়ে উঠছে এবং কীভাবে তা পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে এটি সম্পন্ন করেছেন।
২০০৬ সালে ১৫ বছর বয়সে ইন্টারন্যাশনাল জেনারেল সার্টিফিকেট অব সেকেন্ডারি অ্যাডুকেশন কোর্স শুরু করেন তিনি। লক্ষ্য ছিল ইংরেজিতে দক্ষতা অর্জন করে বিদেশে পাড়ি জমানোর। সেই মিশনেও বাজিমাত করেন অনন্যা। এতে প্রথম হন তিনি। ফলে সহজেই স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সুযোগ মেলে। এরপরই ভিজিটিং স্টুডেন্ট হিসেবে যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে যান। ২০১৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার ব্রায়ান মাওর কলেজ থেকে স্নাতক করেন তিনি। পরে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পিএইচডি করেন। তনিমা বর্তমানে ডার্টমাউথ কলেজের একটি পোস্টডক্টরালের গবেষণা সহযোগী।
গবেষণার পাশাপাশি তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী নারী শিক্ষার্থীদের জন্য পরামর্শদাতা নেটওয়ার্ক ‘ওয়াই-স্টেম’ এর সহ-প্রতিষ্ঠা হিসেবে কাজ করছেন।
সমসাময়িক নারীদের নিয়ে তার রয়েছে অনেক স্বপ্ন। বললেন, ‘নারীরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করেছে। অনেক পরিবারে মেয়েদের নিজেদের উৎসাহে বাধা দেয়। আমার বেলাতেও তাই হয়েছিল। কিন্তু পরিবারকে আমার ইচ্ছাশক্তির কথা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। নিজের ভেতরে সততা আর ইচ্ছাশক্তি না থাকলে কোনো নারী তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে না। সবার আগে কথা বলতে হবে। বোঝাতে হবে, আমি কী চাই। বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। তাহলে পরিবার থেকে কোনো বাধা আসবে না।’
পরিবারকে দেওয়া কথা তিনি রাখতে পেরেছেন। জানালেন, ‘বাবা-মাকে প্রতিজ্ঞা করে এসেছিলাম- বিদেশে গিয়ে কোনো পার্টিতে যাব না এবং মদপানও করব না। পরিবারের পক্ষ থেকে আমাকে অল-উইমেন স্কুলে ভর্তি হওয়ার শর্তজুড়ে দেওয়া হয়। আমি সব মেনে দেশ ছেড়ে আসি। শুধু পড়াশোনা ও গবেষণার চিন্তায় মগ্ন থাকতাম। এখনো আমার অনেক পথ বাকি।’
বিশ্বজুড়ে আদৌ কি খুব ভালো আছেন নারীরা? প্রশ্নটা উঠছে বিভিন্ন দিক থেকে। উত্তরে অনন্যা বলেন, ‘অধিকার আসলে কেউ দেয় না। লড়াই করেই আদায় করতে হয়। কোনো প্রতিবন্ধকতাই বাধা হয়ে দাঁড়াবে না, যতক্ষণ না আপনি লড়াই করতে শিখবেন। নিজেকে আবিষ্কার করতে পারবেন। আমি মনে করি, নারীরা এই জায়গাতেই পিছিয়ে আছে। তারা মুখ খুলতে চায় না। লড়াই করতে ভয় পান। বেগম রোকেয়া কিংবা প্রীতিলতা এক দিনে গড়ে ওঠেননি। তারাও যুগের সঙ্গে লড়াই করেছেন। সাফল্য এসেছে। আমার আজকের অবস্থান কিন্তু লড়াইয়ের কারণে সম্ভব হয়েছে।’
আপনার প্রজন্মের নারীদের উদ্দেশে কী বার্তা দেবেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি বলব, প্রথমে লক্ষ্য ঠিক করুন, তারপর তা পূরণে মানসিক দৃঢ়তা আনুন। দেখবেন সাফল্য আসবে।’
সেঁজুতি সাহা
অণুজীববিজ্ঞানী
ভোরের সূর্য দেখেই নাকি দিনের আন্দাজ পাওয়া যায়। তৃতীয় শ্রেণিতে স্কুলের বিজ্ঞানমেলায় রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের প্রজেক্ট বানিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল মেয়েটি। বাবা-মায়ের সহযোগিতায় বানানো সেই প্রজেক্ট ব্যবহার করে একজন শিক্ষকের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছিলেন তিনি। রক্ত সংগ্রহ করার সেই ছবি আজও নিজের টেবিলে রেখে দিয়েছেন আজকের দেশব্যাপী সাড়া ফেলে দেওয়া তরুণ বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করা গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন সেঁজুতি সাহা। বাবা বিখ্যাত অণুজীববিজ্ঞানী ও গবেষক ড. সমীর কুমার সাহা, মা আরেক অণুজীববিজ্ঞানী ও গবেষক ড. সেতারুন্নাহার। সেঁজুতি বর্তমানে কর্মরত আছেন বাবার প্রতিষ্ঠিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ)।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশে যেখানে অসংখ্য মেয়েকে বাল্যবিবাহ দেওয়া হয় এবং নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেই পরিবেশে থেকেও বিজ্ঞানী হয়েছেন সেঁজুতি। আলোচিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে। যাকে নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়েছে বিল গেটস জার্নালে।
অণুজীববিজ্ঞানী বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান সেঁজুতির জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা-মা দুজনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। পরে তারা ভারত থেকে অণুজীববিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। সেঁজুতির একমাত্র ছোট ভাইও একজন অণুজীববিজ্ঞানী। টুয়েলভে পড়ার সময় তিনি ঠিক করেন, দেশের বাইরে পড়তে যাবেন। কিন্তু তার পরিবারের কেউ কখনো এত অল্প বয়সে বিদেশে পড়তে যায়নি। বাবা-মা ভারত থেকে পড়ে এলেও আমেরিকা বা কানাডায় কখনো যাননি। তাই ২০০৪ সালেও বিদেশে পড়ার কথা বলতেই প্রথম বাধা আসে পরিবার থেকে। সেঁজুতি বাবা-মাকে রাজি করিয়ে ফেললেও আপত্তি আসে সম্পূর্ণ নতুন দিক থেকে। বাবা-মা নিমরাজি হতে না হতেই আত্মীয়-পড়শিদের ফোন আসতে থাকে বাসায়, ‘মেয়েকে একা বিদেশে পাঠাবেন? আর কিন্তু ফিরে আসবে না। এই গেল হাতছাড়া হয়ে।’
নারী পারিবারিক ও সামাজিক এই বাধা অতিক্রম করতে পারে না অনেক ক্ষেত্রে। এ প্রসঙ্গে সেঁজুতি বলেন, ‘আমার দিক থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। আমার কাছে বিষয়টা ছিল, আমি এটা করতে চাই তো চাই-ই। কে কী বলছে, অত ভাবিনি কখনো। যা চেয়েছি তা করেই ছেড়েছি।’
ইতিমধ্যে বাবা সমীর কুমার সাহার পাশাপাশি মেয়ের নাম উচ্চারিত হতে শুরু করেছে। ভবিষ্যৎ স্বপ্ন কী তার? বাবার মতো মেয়েও শিশুমৃত্যুর হার কমানো নিয়ে কাজ করেন। ভবিষ্যতেও শিশুদের নানা রকম সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করতে চান। চেষ্টা করবেন এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। ছেলেবেলা থেকেই বাবা-মা শিখিয়েছেন, বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগাতে হবে।
নারীদের কাজে পুরুষের সহযোগিতার বিষয়ে আপনি কী ভাবেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নারীর নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য প্রতিদিনই সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এর মানে এই নয় যে, নারীরা পুরুষের সহযোগিতা ছাড়া এগোতেই পারবে না। আবার এমনও নয় যে, পুরুষের সহযোগিতা ছাড়াই তারা এককভাবে এগিয়ে যাবে। একজন পুরুষের উন্নতির পেছনে যেমনভাবে নারীর সহযোগিতা থাকে, তেমনি একজন নারীর উন্নয়নের পথেও পুরুষের সহযোগিতা প্রয়োজন। সেটা হতে পারে বাবা, ভাই, বন্ধু, সহকর্মী বা অন্য যে কেউ।’
নারীর অগ্রগতি সম্পর্কে সেঁজুতি সাহা বলেন, ‘চারপাশে আমি অনেক নারীকেই দেখছি, যারা বড় পর্যায়ে কাজ করছেন। এখন ভালো ফলসহ অনেক মেয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করছে। ফলে অনেক কোম্পানির সিইও, সিএফও থেকে শুরু করে বোর্ড অব ডিরেক্টরেও নারীরা রয়েছেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, নারীরা চ্যালেঞ্জটা নিতে পারছেন, তারা জ্যেষ্ঠ পদগুলোতে যেতে পারছেন। তবে এটা ঠিক, বিয়ের পর বা সন্তান নেওয়ার পর অনেক নারীই নিজের কাজ একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রেখে দেন, যাতে তারা পরিবারে আরও একটু বেশি সময় দিতে পারেন। অনেক ক্ষেত্রে তারা চাকরিও ছেড়ে দিচ্ছেন। অবশ্য অবস্থানগত কারণে নিজস্ব পছন্দেরও একটি ব্যাপার থাকে। পড়ালেখার ব্যাপারেও আমাদের দেশের মেয়েরা এখন অনেক বেশি সচেতন, তারা অনেক উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছে। নিজেদের এই পরিশ্রম বেশির ভাগ মেয়েই কাজে লাগাচ্ছে, সেটি চাকরি করেই হোক কিংবা নিজের স্বাধীন ব্যবসার ক্ষেত্রে।’
আলপনা হাবিব
রন্ধনশিল্পী
ছোটবেলায় খেলার ছলে শিখেছেন রান্না। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়েই আলপনা হাবিবের রান্নায় হাতেখড়ি। জিতেছেন গোরমন্ড ওয়ার্ল্ড কুকবুক অ্যাওয়ার্ড। এই পুরস্কারকে অস্কার অব গ্যাস্ট্রোনমিও বলা হয়ে থাকে। ১৯৯৫ থেকে প্রতিবছর রান্নার বইয়ের ওপরে এই অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়।
তিনি জানালেন, ‘রান্নাবান্নায় সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করেছে বাংলাদেশের জননন্দিত রন্ধনশিল্পী অধ্যাপক সিদ্দিকা কবীর। এ বিদ্যায় আমার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও সিদ্দিকা কবীরের কাছ থেকেই যতটুকু শেখার শিখেছি।’
আলপনা হাবিব ২০১২ সালে নিজের একটি ইউটিউব চ্যানেল করেন। সেখানেই তিনি নতুন নতুন রান্নার রেসিপি দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া স্যাটেলাইট চ্যানেলে বিভিন্ন রান্নার অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণ করেন। বিচারক হিসেবে অংশ নেন দুরন্ত টিভির ‘তীর লিটল শেফ’ অনুষ্ঠানে। ২০১৭ সালে তিনি উইমেন ইন লিডারশিপ ও ব্র্যান্ড ফোরাম কর্তৃক ‘ইন্সপায়ারিং উইমেন ইন কুলিনারি আর্ট’ নির্বাচিত হন। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষায় প্রকাশিত ৫৫০ পৃষ্ঠার রঙিন ‘আলপনা’জ কুকিং’ বই প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালের ১৩ মে।
আলপনা হাবিব দেশের নারীসমাজ ও রন্ধনশিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে চান। নিজের কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ইচ্ছা নেই। কিন্তু কেউ যদি তাকে এ কাজে ডাকেন, তাহলে সবার জন্যই তার দরজা খোলা থাকবে। প্রয়োজনে দেশের নারীদের বিনা পারিশ্রমিকে রান্নাবিষয়ক শিক্ষা হাতেকলমে শেখাবেন বলে জানান।
তার জন্ম বিলেতের সলিহাল শহরে। ছোটবেলা থেকেই রান্নায় আগ্রহ। রন্ধনশিল্পী হিসেবে যাত্রা শুরু অতি অল্প বয়সে আত্মীয়স্বজনের জন্য রান্নার মাধ্যমে। বড় হতে হতে তার এই গুণের কথা ছড়িয়ে পড়ে। আলপনা বাড়িতেই রান্নার ক্লাস শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন।
নারীর কাজে পুরুষের সহায়তা বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। কবিতার মতো নারী-পুরুষ একে অন্যের পরিপূরক। তবে এ পূর্ণতাকেই নানাভাবে অপূর্ণতায় রাখা হয়। নারীর জন্য প্রতিটি দিনই লড়াইয়ের। নিজেকে সবার মাঝে সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য এই লড়াই। নারীরা আজ থেমে নেই কোথাও। ঘরে কিংবা বাইরে- সব জায়গায়ই নারীর পদচারণ রয়েছে পুরুষের পাশাপাশি। নারী হিসেবে নিজেকে নিয়ে আমি গর্বিত।’
আলপনা হাবিব বলেন, ‘একটা সময় পর্যন্ত ঘরের বাইরে নারীদের জগৎ বলতে কিছু ছিল না। তবে সেই ঘরের চার দেয়ালকেও নিজের কর্মস্থল হিসেবে তৈরি করা সম্ভব। একসময় পর্যন্ত রান্না ছিল কেবল একটি ঘরের কাজের মধ্যে আবদ্ধ। তবে সময়ের পরিবর্তনে এখন তা আয়ের প্রধান উৎসে পরিণত। নানা ধরনের মজার খাবার তৈরি করে যেমন পরিবারের মানুষের মন জয় করা সম্ভব, তেমনি তা আয়ের উৎস হতে পারে খুব সহজে। সে ক্ষেত্রে সহযোগিতার মাধ্যম হতে পারে ইন্টারনেট, ইউটিউব চ্যানেল কিংবা নিজের একটি ফেসবুক পেজ। এসব জায়গায় কাজ করতে যেমন ঘরের বাইরে যেতে হয় না, তেমনি পরিবারকেও সময় দেওয়া যায় এবং খুব সহজে বাইরে খাবার ডেলিভারি করা বা গ্রাহকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘সব ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতা থাকে। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় নারীকে। তাই স্বাবলম্বী হওয়াটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অনেকেই ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করার সম্মতি পান না। তাদের জন্য রান্না হতে পারে একটি আয়ের উৎস।’
সাজিয়া সুলতানা পুতুল
কণ্ঠশিল্পী
নতুন প্রজন্মের জনপ্রিয় গায়িকা। সাজিয়া সুলতানা পুতুল একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক। উপস্থাপক হিসেবেও তার নাম আছে বেশ। যাত্রা শুরু হয়েছিল ক্লোজআপ ওয়ান প্রতিযোগিতার মাধ্যমে। যদিও ছোটবেলা থেকেই গানে অনবদ্য অবদানের জন্য বেশ কিছু জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। তবে এ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই পেশাগত শিল্পী হিসেবে আবির্ভাব। শুরুতে যাত্রাটা ছিল বেশ মসৃণ। ক্রমেই মঞ্চ, টিভি লাইভ, অ্যালবাম নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। শুধু গান নয়, লেখালেখিও করেন। বইমেলায় তার কিছু বইও প্রকাশ পেয়েছে। দুই মাধ্যমেই নিজেকে তুলে ধরতে নিরন্তর ছুটে চলছেন পুতুল। সাম্প্রতিক ব্যস্ততা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘আমার দুটি সত্তা- গান আর লেখালেখি। সামনের বইমেলায় নতুন উপন্যাস আসবে। এটি নিয়ে একটু ব্যস্ত। নিজস্ব একটি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে, সে জন্য প্রতি সপ্তাহেই গান রেকর্ডিং এবং ভিডিও ধারণ করতে হচ্ছে।’
তার প্রথম বই ‘পুতুল কাব্য উপক্রমণিকা’। কাব্যগ্রন্থ। বইটির প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। নতুন উপন্যাসের গল্প সম্পর্কে পুতুল বলেন, ‘এটি একজন শিল্পীর আত্মজীবনী। অনেকে প্রশ্ন করছেন, এটি আমার জীবনী কি না। হতে পারে এটা আমার, আবার অন্য কেউ যখন পড়বে, তখন হয়তো মনে হবে এটা তার জীবন। আমি আসলে নারীর মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন নিয়ে লিখি। একজন নারী জীবনের বিভিন্ন সময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। এ ক্ষেত্রে যখন সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়; দেখা যায়, ওই কারণে পরবর্তী জীবনে তাকে অনেক ভুগতে হয়। এগুলোই হচ্ছে আমার লেখার মূল বিষয়।’
তিনি বলেন, ‘যে সমাজে নারীকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করা হয় তুমি নারী, তুমি সবকিছু স্বাধীনভাবে করতে পারবে না, যেখানে নারী প্রতিদিন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে নানান নির্যাতনের শিকার হয়; সেখানে নারীর অগ্রযাত্রায় অনেক বাধা সৃষ্টি হয়। তাই নারীকে প্রতিদিনই লড়াই করে সামনে আগাতে হচ্ছে। সমাজ-রাষ্ট্র এ বিষয়ে কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারছে না।’
নারী হিসেবে আপনি কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ‘হ্যাঁ, অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এখনো নানা সমস্যায় পড়তে হয়। কিন্তু আমি খুব আত্মবিশ্বাসী এবং জেদি। এ কারণে সব বাধাকে অতিক্রম করার চেষ্টা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের নানি, মা-খালাদের সময়ও তারা এসব প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছিল। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। যুগ পাল্টাচ্ছে, আমরা বলছি আধুনিক হচ্ছি। কিন্তু এই সময়ে একজন নারী তার ইচ্ছেমতো পোশাক পরে বের হতে পারে না। তাকে আরও বেশি পণ্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। সোশ্যাল মিডিয়াতেও নারীরা বিভিন্নভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছে। ব্যক্তিগত ইনবক্সে নানান আপত্তিকর কথা বলা ও ছবি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। নারী মানেই ভোগের বিষয়- এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে নারীর অগ্রযাত্রা এবং স্বাধীনতার প্রতিটি সেক্টরেই বাধার সম্মুখীন হবে।’
পরবর্তী নারী প্রজন্মের উদ্দেশে কোনো বার্তা আছে কি না, এ বিষয়ে পুতুল অকপটে বললেন, ‘প্রথমে নারীর খোলস থেকে বের হয়ে আসতে হবে। নারী একজন মানুষ। তার মধ্যে আত্মবিশ্বাস আর জেদ থাকতে হবে। সে যেটা করতে চায়, যত বাধা আসুক, তা সে করতে পারবে- এই মানসিকতা থাকতে হবে।’
মেঘ অদিতি
কবি, সংগঠক
জামালপুরের জল-হাওয়ায় শৈশব, কৈশোর, তারুণ্যের দিনগুলো কাটলেও পরে পড়াশোনার জন্য ঢাকায় চলে আসেন কবি ও সংগঠক মেঘ অদিতি। এখন স্থায়ীভাবে ঢাকাতেই বসবাস। গদ্য, গল্পও লেখেন। ছবি আঁকতে ভালোবাসেন। বর্তমানে ঐহিক বাংলাদেশ-এর সংগঠক এবং ঐহিক বাংলাদেশ নামে ছোট কাগজের সম্পাদনা করছেন। তার মতে, ‘জীবন আদতে এক ভ্রমণ। সেই শৈশবের মতো আজও নানা রকম কাজে তাই নিজেকে ব্যস্ত রাখি। ইচ্ছেডানায় এভাবেই নিজেকে মেলে ধরেছি। মুক্তি দিয়েছি নিজেকে।’
নারী-পুরুষের যে সংকট-বৈষম্য, এ সম্পর্কে মেঘ অদিতি বলেন, ‘পুরুষ বা নারী পরস্পরের পরিপূরক। একে-অন্যকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি বিশ্বাস করি, খুব অল্পসংখ্যক পুরুষ সে রকম বৈষম্য বহন করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে সক্ষম হয়েছে। ধরে নিই, আমি বা আমার মতো অন্য লেখকদের পরিবারেও পুরুষেরা একই রকমভাবে প্রগতিশীল। কিন্তু তা গোটা সমাজের ছবি নয়। হলে এ নিয়ে এত কথা বলতেই হতো না। জীবন যেহেতু বেনীআসহকলার সব রং নিয়েই চলমান, তাই বলব, পুরুষ! আসুন, হাত ধরুন, আদম আর ইভের মতোই আমরা আবার এক বৈষম্যহীন সমাজের জন্ম দিই।’
মেঘ অদিতি বলেন, ‘নারীর প্রতি নির্যাতন কেন, একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে। সমানে সমানে বেরাদরি হয়, চাইলে ঝগড়া বা মারামারিও। তাহলে একতরফা নির্যাতন কখন হয়? কার প্রতি হয়? যখন অন্যপক্ষ তুলনামূলকভাবে দুর্বল হয়। এখানে দুর্বল প্রতিপন্ন করা হচ্ছে নারীকে। ফলে নানা রকম নির্যাতন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। সমানাধিকার, সমমর্যাদা থাকলে এসবের কোনোটা নিয়েই কথা বলার দরকার হতো না।’
তিনি মনে করেন, ‘সামাজিক, পারিবারিক বা যেকোনো অবস্থানেই মর্যাদা পেতে গেলে আগে প্রয়োজন আর্থিক স্বাধীনতা। সেটাই আসল স্বাধীনতা। ইন্দ্রা নুয়ি, কমলা হ্যারিস, গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী- এরা কি নির্যাতনের শিকার হন? হবেন না কখনোই। নারী প্রগতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি যুক্ত যে বিষয়, তা হলো আর্থিক স্বাধীনতা। সেটা না থাকলে কেউই সম্মান দেবে না।
আরও একটি বিষয়ে না বললেই নয়। প্রান্তিক শ্রমিক শ্রেণির দিকে তাকালে দেখা যায়, পুরুষের সমান শ্রম দেওয়ার পরও দিন শেষে নারী বলেই তার মজুরি কম হয়। আমাদের সমাজব্যবস্থায়, গৃহ পরিচারিকাটির বেতন, যেকোনো পুরুষ কেয়ারটেকার বা ড্রাইভারের চেয়ে আমরা অনেক কম নির্ধারণ করি। তাহলে কেবল অর্থনৈতিক মুক্তিকে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট না ভেবে এর পাশাপাশি সমাজ এবং পরিবারে সঠিক শিক্ষা ও বিবেচনাবোধ, মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করা যাবে না।’
সব শেষে তিনি স্বপ্ন দেখছেন নতুন প্রজন্ম নিয়ে। বলেন, ‘নতুন প্রজন্মের নারীদের মধ্যে বিস্ময়কর প্রাণ ও অকুতোভয় মানসিকতার ওম পাই, যা আমাকে উষ্ণতা দেয়। মেধার ডানায় ভর করে মুক্ত আকাশে এ প্রজন্ম উড্ডীয়মান থাক। সারা দুনিয়া তাদের হাতের মুঠোয় আসুক। তাদের হাত ধরেই সমস্ত প্রতিবন্ধকতা যেন আমরা টপকে যেতে পারি। যা আমরা পারিনি, তারা পারুক- সেটাই চাই।’
সামিনা লুৎফা নিত্রা
নাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, অধ্যাপক
নাট্যাঙ্গনের সুপরিচিত মুখ। মঞ্চে অভিনয় দিয়েই শুরু। নাট্যকার হিসেবেও খ্যাতি পেয়েছেন। শিক্ষকতা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহে।
তিনি বলেন, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থাকতাম এবং যে স্কুলে পড়তাম, সেখানে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড বেশিই ছিল। নিয়মিত বার্ষিক অনুষ্ঠানগুলো হতো। বিভিন্ন দিবস উদ্্যাপনও। ঢাকা থেকে বিভিন্ন নাট্যদল যেত। ছোটবেলা থেকেই মা-বাবা শিখিয়েছেন কবিতা আবৃত্তি, নাচসহ অনেক কিছু। তখনই মঞ্চের প্রতি আমার আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, স্কুলের ছেলেমেয়েরা মিলেই নাটক করতাম। ঢাকা থেকে যাওয়া বিভিন্ন দলের নাটক দেখা হতো। স্কুলের এবং ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক আমাদের নৃত্যনাট্য এবং নাটকে অভিনয়ে সহযোগিতা করতেন, শেখাতেন। সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী ফাহমিদা খাতুনের কথা বলতেই হবে। আমি তার কাছে গান শিখতাম। তারা প্রতিবছর একটা নৃত্যনাট্য করতেন। ওখানে সন্জীদা খাতুন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা যেতেন। তাদের গান শুনতাম। এগুলোর প্রভাব আছে আমার জীবনে।
পরিবার থেকে কার অনুপ্রেরণা বেশি ছিল? এ প্রশ্নের জবাবে নিত্রা জানান, মা সব সময় চাইতেন আমরা দুই বোন সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে থাকি। বাবা অতটা চাইতেন না। কিন্তু মা চাইতেন বলেই বাসায় একটা পরিবেশ গড়ে উঠেছিল।
সামিনা লুৎফা নিত্রা পড়াশোনা করেছেন সমাজবিজ্ঞানে। নাটকের প্রতি ভালোবাসা ছিল। কিন্তু নাটক নিয়ে পড়ার ইচ্ছে কি ছিল? বললেন, আসলে নাটক নিয়ে পড়াশোনার বিষয়টা মাথায় ছিল না। আমার কাছে মনে হয়েছে নাটকে কাজ করা একটা স্বাধীন নেশার মতো। যদিও আমি বাংলা সাহিত্যে পড়তে চেয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় আমি ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। পরিবার থেকে তখন বলা হয়েছিল অর্থনীতি নিয়ে পড়তে। আমি তা পড়তে চাইনি বলেই সমাজবিজ্ঞানে ভর্তি হই। ধারণা ছিল সমাজবিজ্ঞানে কম পড়তে হবে এবং আমি থিয়েটারে সময় দিতে পারব। পরে বুঝেছি, অধ্যবসায়ের বিকল্প নেই। মা চাইতেন, আমি সংস্কৃতিকচর্চা করি। কিন্তু চাইতেন না এই করে জীবন নির্বাহ করি। তারা আমাকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল না। তাই এসএসসি পাস করার পর সায়েন্স ছেড়ে দিই।
নাটক লেখা শুরুর কথা জানালেন তিনি, বললেন, আমার বরাবরই ইচ্ছা ছিল অভিনয়ের। নাটক লেখার চিন্তাই ছিল না। কীভাবে নাটক লিখতে হয়, সেটাও জানতাম না। প্রথমে ইংরেজি নাটকের বাংলা অনুবাদ করি। দলের প্রয়োজনে শেকসপিয়ারের ‘টুয়েলফ নাইট’ অনুবাদ করতে হয়। পরে মামুনুর রশীদের উৎসাহে লিখি ‘তীর্থংকর’। তারপরে ‘খনা’। তখন আমি ‘সুবচন নাট্য সংসদে’ ছিলাম। ১৯৯৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সুবচনে থাকতে অনেকগুলো নাটক লিখেছি। আমরা ২৫ জন মিলে বটতলা শুরু করি। ২০০৮ সালেই।
নারীদের মধ্যে যারা নাটকে আগ্রহী হচ্ছেন, অভিনয়ে আসছেন, কিন্তু নিত্রা মনে করেন, নারীর জন্য কিছুই কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সবখানে টিকে থাকতে হয় লড়াই করে। তিনি বলেন, একটা সময় শুধুই উচ্চ মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের নারীরা থিয়েটারে আসতেন। বলছি ৫০-৬০-এর দশকের কথা। এমনকি ৭০-এর দশকেও। তখন থিয়েটার করা সম্মানের ব্যাপার ছিল। এখন সব জায়গায় যেমন নারীরা ছড়িয়ে গেছেন, তেমনি থিয়েটারেও কাজ করছেন। তবে আমার মনে হয়, আগের চেয়ে পরিস্থিতি এখন আরও জটিল। নারীকে এখন কেবল পুরুষদের সঙ্গে নয়, নারীদের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়। কখনো কখনো নিজের সঙ্গেও।
নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই প্রসঙ্গে বলেন, বুঝতে হবে নারী হিসেবে বিশেষ কোনো সুবিধা পেতে চাই কি না? এই প্রশ্ন নিজের সঙ্গে। লেখক হিসেবে নারী-পুরুষের বিভাজন থাকতে পারে না। আমি যদি নারী নাট্যকার হিসেবে বিভাজিত হই, তখন কিন্তু বিষয়টা ম্যাটার করে। অনেকে মনে করেন- স্বামী, ভাই কিংবা বাবার জন্য নারী স্বীকৃতি পায়। এটা একটা সাধারণ ধারণা। যে কারণে নারীর পথচলাটা সহজ নয়। কঠিন। একে-অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বও আছে। সে জন্য সবাইকে অনেক প্রতিযোগিতার মধ্যে কাজ করতে হয়।
সাধনা আহমেদ
নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী
নাট্যকার ও লেখক। টিভি ও মঞ্চনাটক লিখে সমানভাবে খ্যাতি পেয়েছেন একসময়ের এই মঞ্চাভিনেত্রী। নাটক ও আখ্যান নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। এখন নির্মীয়মাণ বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকের চিত্রনাট্য বাংলা রূপান্তরের কাজ করছেন। চলচ্চিত্রটির কাজের সুবাদে আছেন ভারতে। দূরালাপনীতে বলেছেন জীবন ও কাজের গল্প।
নাট্যকার হওয়ার বিষয়ে শুনতে চাইলে তিনি বলেন, কখনো ভাবিনি লেখক বা নাট্যকার হবো। নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্যাকেজ নাটক নামে একটি বিষয় এলো। একদিন একটা প্যাকেজ নাটক দেখতে দেখতে হঠাৎ মনে হলো, আরও ভালোভাবে সেটা লেখা যেত। ওই নাটকটি আমার ভালো লাগেনি। তারপর একটা নাটক লিখলাম।
তিনি আরও বলেন, সে সময় বিজ্ঞাপন নির্মাণ ও প্রেস মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নাটকটি লিখে পরিচিত একজন নির্দেশককে দিলাম। তখন বিটিভিতে চিত্রনাট্য পাস করা হতো। লেখাটি জমা দিলেন। সেটি পাস হলো। ‘নীরবে নিভৃতে’। নাটকটি হলো। লিখেছিলাম ১৯৯৬ সালে। পরের বছর আরেকটি টেলিফিল্ম লিখলাম। ‘চরসুবর্ণ’। ১৯৯৮ সালে সেটার শুটিং হলো। কায়েস চৌধুরী নাটকটা করেছিলেন। সৌম্য চৌধুরী, রীতি, বিজরী, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ড. এনামুল হক, আরমান পারভেজ মুরাদ অভিনয় করেছিল। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় চিত্রনাট্য হাতে নিয়ে পড়তে পড়তে বললেন, আরেকটু পরিশ্রম করলে এটা মঞ্চের উপযোগী হবে। ১৯৯৫ সালে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হলাম। থিয়েটার আরামবাগ। অভিনয়ের জন্যই গিয়েছিলাম।
সাধনা আহমেদ জানান, টেলিভিশনের জন্য আরও লিখেছি। মঞ্চের জন্য লিখিনি। মঞ্চে অভিনয় করতাম। টেলিভিশনে নিজের লেখা নাটক নির্দেশনা দিতে শুরু করলাম। ২০০৭ সালে মঞ্চের জন্য লেখা শুরু করি। প্রথম নাটক ছিল ‘দমের মাদার’। এরপর থেকে টেলিভিশন ও মঞ্চের জন্য নাটক লেখা অব্যাহত রেখেছি। সঙ্গে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও।
কবি ও গল্পকার হিসেবেও তার পরিচিতি রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলেন, কবিতা আমি খুব বেশি সচেতনভাবে লিখেছি তা নয়। তবে নাট্যকার তো কবিই। একসময় তাদের কবিই বলা হতো। নাটক সাহিত্যের অনেক পুরোনো ধারা। উপন্যাস অনেক পরে এসেছে। নাটকে সব শিল্প এসে একীভূত হয়ে যায়। সেখানে কবিতা, ভাস্কর্য, কাহিনি, সংগীত ও নৃত্য- সবই আছে। আবার তা প্রায়োগিক শিল্পও বটে। নাট্যকারকে এসব বিষয় মাথা রাখতে হয়। নাটককে কবিতায়, মননে ও ভাস্কর্যে উত্তীর্ণ হতে হয়।
নতুন কাজ সম্পর্কে সাধনা আহমেদ জানালেন, আমার ‘গাঙকুমারী’ আখ্যানটি নিয়ে চলচ্চিত্র হচ্ছে। এখন শুটিং চলছে। এটা আখ্যানরূপে লিখেছিলাম। মঞ্চের জন্যই। বই প্রকাশ হয়ে গেছে। যেহেতু আমরা যে নাটক লিখি, বাংলা বর্ণনাত্মক রীতিতে। নাটকে সাহিত্যমান আগে তৈরি করি। সে জন্য আমি কয়েক বছরে ধরে চিন্তা করেছি।
বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে কাজ করার জন্য সাধনা আহমেদ এখন নয়াদিল্লিতে আছেন। এতে কোন বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নির্মীয়মাণ বায়োপিকে আমরা আছি বাংলা রূপান্তরের দায়িত্বে। ছবিটির পরিচালক শ্যাম বেনেগাল। মূল চিত্রনাট্য লিখেছেন অতুল তিওয়ারি ও শামা জায়েদি। তারা মুম্বাইয়ের। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ প্রযোজনায় এটি নির্মিত হচ্ছে। প্রধান আর্টিস্ট বাংলাদেশের। দুই দেশেই শুটিং হবে। চারজন বাংলা রূপান্তরের কাজ করছি- আমি, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, শিহাব শাহীন এবং অনম বিশ্বাস। আমাদের রাইটার্স প্যানেলের উপদেষ্টা ছিলেন আসাদুজ্জামান নূর। আমাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে চিত্রনাট্য সুপারভিশনের জন্য। বাংলা রূপান্তরের কাজ হচ্ছে এখানে।
বর্তমান সমাজ ও পরিবারকাঠামোতে নারীর কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা বা মুক্তি কতটা অর্জিত হয়েছে বলে মনে করেন? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা এখনো পিতৃতান্ত্রিক পরিবারকাঠামোতে বাস করছি। এখনো আমাদের মানসিকতার উন্নয়ন অতটা হয়নি। যদিও অনেকটা এগিয়েছে। পিছিয়েও আছে অনেক বেশি। মানসিকতার জায়গায় আমি মনে করি প্রত্যেকেই মানুষ। লিঙ্গ একটি সেকেন্ডারি বিষয়। পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে আমাদের যে মানসিকতা তৈরি হয়েছে, তাতে কন্যাশিশু এবং ছেলেশিশুকে যে মানসিকতা দিয়ে তৈরি করা হয়, এই জায়গা থেকে আমাদের পরিবারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এটা নারীর একার কাজ নয়। রাষ্ট্রকাঠামোর ভেতর থেকে কাজটা করতে হবে। ভেতরের কাজটা করতে হবে পরিবার থেকে, মানুষের নিজেকে। সেটা নারী-পুরুষনির্বিশেষে। আলাদা করে দেখলে চলবে না। অখন্ডভাবে দেখতে হবে- পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র- সবকিছু মানুষের জন্য।
প্রমা অবন্তী
নৃত্যশিল্পী
ওডিশি নৃত্যশিল্পী। প্রবাদপ্রতিম পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের শিষ্য তিনি। গুরু পৌষালী মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে নৃত্য শিখেছেন। এখনো তা চলছে। বিশুদ্ধ নৃত্য ছড়িয়ে দেওয়ার অভিপ্রায়ে চট্টগ্রামে তার প্রতিষ্ঠিত ‘ওডিশি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার’ ২১ বছর পার করেছে।
নৃত্যের প্রতি আগ্রহের কথা জানতে চাইলে প্রমা অবন্তী জানালেন, পাঁচ বছর বয়স থেকে নৃত্যচর্চা করছি। এটা আমার মামা বাড়ি থেকে পাওয়া। মামাতো বোনেরা খুব নাচ করত। ওদের নাচ দেখে দেখে শিখেছি। শুরুতে ভালোবাসা বা ভালো লাগা থেকে নৃত্যচর্চা করিনি। আমার প্রথম হাতেখড়ি হয় আলাউদ্দিন ললিতকলায় একুশে পদকপ্রাপ্ত গুরু রুনু বিশ্বাসের কাছে। তখন আমার বয়স পাঁচ বছর।
নৃত্যশিল্প হিসেবে গড়ে ওঠার পেছনে অনুপ্রেরণা বেশি ছিল মায়ের। তিনি বলেন, আমি যাতে ভালো থাকি, খুশি থাকি, মা সেই জায়গাটি ধরলেন। তার আগ্রহেই প্রথম নৃত্যচর্চা শুরু করি। মা একসময় গান করতেন। পরে বাবাও দেখলেন, মেয়েটা আনন্দ পাচ্ছে, তাই সুযোগ করে দিলেন। নব্বইয়ের দশকে বৃত্তি নিয়ে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। তত দিনে নৃত্যের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। আমি চাচ্ছিলাম এমন জায়গায় পড়ব, যেখানে পড়াশোনার পাশাপাশি নাচের চর্চা করতে পারব।
ওডিশি নৃত্যের প্রতি ঝোঁক তৈরি হলো কীভাবে? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি জানালেন, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে সব ধ্রুপদি নৃত্যই করানো হতো প্রি-ডিগ্রিতে। যেকোনো একটি বিষয় নিতে হয় অনার্সে। ধ্রুপদি নৃত্যের ভাগগুলো হচ্ছে কত্থক, ভরতনাট্যম, মণিপুরি, ওডিশি, কুচিপুডি, কথাকলি, সত্রীয়া, মোহিনীঅট্টম। গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের নৃত্য পরিবেশন দেখে আমি বিমোহিত হলাম। নাচে এত রসের সঞ্চার, এত সুন্দর কাব্যিকতা! খুব সুন্দর অনুভূতি প্রকাশ করে। এ কারণে অনার্সে ওডিশি বেছে নিলাম।
গুরু পৌষালী মুখার্জির তত্ত্বাবধায়নে নাচ শিখেছেন প্রমা। তিনি বলেন, প্রি-ডিগ্রিতে ভর্তি হওয়ার পর কলকাতায় গুরু পৌষালী মুখার্জির তত্ত্বাবধায়নে আমার শোখা শুরু হয়। আগ্রহ দেখে পদ্মবিভূষণ গুরু কেলুচরণ মহাপাত্রের কাছে পদাতিকে আমায় নিয়ে যান। কারণ, বড় পরিসরে আমি যেন জানতে পারি, শিখতে পারি।
বাংলাদেশে ওডিশি নৃত্যচর্চা মূল্যায়নে তার অভিমত, এখন কেবল শুরু হচ্ছে, কিন্তু আরও একটু পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ভালো হতো। কাজ এবং চিন্তার পরিধি বাড়ানো যেত। এমনিতেই একুশ বছর ধরে আমার সংগঠন করে যাচ্ছি। সভাপতির দায়িত্বে আছেন অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। ওডিশি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টারের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি সভাপতি।
নৃত্যশিল্পী হওয়ার কী ধরনের সাধনা বা প্রস্তুতি থাকা দরকার বলে আপনি মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভালো নৃত্যশিল্পী বা সংগীতশিল্পী হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া খুব দরকার। মানবিক ও কুসংস্কারবিরোধী মানুষ। শিল্প সৃষ্টি করতে হলে চর্চার কোনো বিকল্প নেই। আমি এখনো নিয়মিত কলকাতার গুরু পৌষালী মুখার্জির তত্ত্বাবধায়নে চর্চা করে যাচ্ছি। প্রতিনিয়তই শিখছি। আমার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে বিশুদ্ধ নৃত্যটা ছড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি যে কেবল ওডিশি করি তা নয়, বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনৃত্য চর্চা করা এবং করানোর চেষ্টা করছি।
এখন তিনি বছরে দুটি ওডিশি নৃত্যসন্ধ্যা করছেন। তিনি বলেন, আমার ইচ্ছে প্রডাকশন করার। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যগুলো, নজরুলের কোলাজধর্মী নৃত্যনাট্যগুলো, যেমন প্রকৃতির নজরুল, বিদ্রোহী নজরুল, ভালোবাসার নজরুল- এগুলো নিয়ে কোলাজধর্মী কাজ করছি। এগুলো নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে করে যাচ্ছি। আমার প্রায় চার শ ছাত্র-ছাত্রী আছে। তাদের দিয়ে রবীন্দ্রনৃত্য, ছড়ানৃত্যগুলো করে যাচ্ছি।
বাংলাদেশের নৃত্যশিল্প নিয়ে তিনি জানালেন, আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাবা-মায়েরা খুব সচেতন। নাচ, গান ও চিত্রকলা তাদের সন্তানদের শেখাচ্ছেন। এ ব্যাপারে আমার ভাবনা খুবই ইতিবাচক। কোনো অপসংস্কৃতি যেন আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে না যায়। আমাদের সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। কী নেই আমাদের- বাউল, জারি, সারি- সবই আছে। চর্যাপদও আমাদের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। রাঙামাটিতে কী নেই- বাঁশ নৃত্য, ছাতা নৃত্য, রাখাইনদের নাচ, ত্রিপুরাদের নাচ। আদিবাসী সংস্কৃতিও অনেক সমৃদ্ধ। স্বচ্ছ নৃত্যের পাশাপাশি আদিবাসী সংস্কৃতি, নিজের সংস্কৃতিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরাই লক্ষ্য। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি এবং ভবিষ্যতেও করব।
তৌহিদা সুলতানা রুনু
উদ্যোক্তা
কাজ করছেন রিয়েল এস্টেট সেক্টরে। পাশাপাশি তৌহিদা সুলতানা রুনু একজন প্রযোজক। এগিয়ে চলার গল্পে বারবার পা পিছলে গেছেন, উঠে দাঁড়িয়েছেন। পেছন থেকে কেউ টেনে ধরতে চেয়েছে, তিনি পাত্তা দেননি। হতাশ হননি। দৃঢ় মনোবল আর কঠিন পরিশ্রমের জন্য আজ তিনি সফল একজন নারী উদ্যোক্তা।
সৈয়দপুরে কনসার্ন বাংলাদেশ নামে আয়ারল্যান্ডভিত্তিক একটি এনজিওতে তার কর্মজীবন শুরু। ছিন্নমূল নারীদের স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষ্যে তিনি কাজ করতেন। ১৯৮৯-৯০-এর দিকে উদ্যোক্তা হিসেবে তিনি নিজেই গড়ে তোলেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। এটিও নারীকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যেই যাত্রা শুরু। নারীর অগ্রযাত্রায় পারিবারিক সহযোগিতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে তিনি মনে করেন। তিনি জানান, আমার পরিবারের বাবা-মা ছাড়া আর কেউ ভালো চোখে দেখত না। ভাবনা ছিল, আমার প্রডাক্টগুলো কীভাবে দেশের বাইরে পাঠানো যায়। এ সময় অনেকের সহযোগিতা পেয়েছি, তেমনি স্বামীর বাড়ি থেকে বাধাও পেয়েছি। স্বামী আমাকে দুটি অপশন দেয়- হয় বিজনেস, নয়তো পরিবার। পারিবারিক অন্যান্য বাধা সত্ত্বেও থেমে থাকিনি। কাজ করেছি। এখনো করছি। আজকে আমার সঙ্গে অনেক মানুষ যুক্ত।
আপনি নিজের কোন পরিচয়টি বেশি উপলব্ধি করেন? সফল মা, সফল স্ত্রী নাকি সফল ব্যবসায়ী? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সবার আগে আমি সফল একজন মা, তারপর আমি একজন নারী উদ্যোক্তা। হয়তো আমি একসময় থাকব না, কিন্তু আমার দেখিয়ে দেওয়া পথেই কেউ না কেউ থাকবে, সেই সুযোগটা সৃষ্টি করে দেওয়ার যে প্রয়াস, এটাকে আমি অনেক এনজয় করি। স্বামীকে অনেক ধন্যবাদ। তিনি আমাকে সব কাজে সাহস জুগিয়েছেন। তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী? যে কাজটা করবে, যে কাজে হাত দেবে, সেটি সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা নিয়ে কাজটা শুরু করবে। আর কারও ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাজ শুরু করা ঠিক নয়। কারণ, অতিরিক্ত নির্ভরশীল হতে হলে হোঁচট খেতেই হবে।
তিনি মনে করেন, নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে কাজ করছে। আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার- সবাই নারী। তবে নারীকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে এগিয়ে যাবার জন্য সহযোগিতা করা উচিত।
তিনি আরও বলেন, নারীকে নারী না ভেবে মানুষ ভাবতে হবে, তাহলেই দেখবেন সমাজ থেকে নারী নির্যাতন কমে গেছে। একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে যতটা না কেয়ার করছে, অফিসের নারী কলিগ বা বসের প্রতি দায়িত্ববান হবার চেষ্টা করে। আবার দেখেন, একজন বাবা তার ছেলেসন্তান যখন অফিস থেকে রাত ১০টায় বাসায় আসছে, তখন কিছু বলছেন না, কিন্তু কন্যাসন্তান অফিস শেষ করে একটু দেরি করে এলেই নানা ধরনের কথা শুনতে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গিগুলো পরিবর্তন করতে হবে। নারীকে মানুষ ভাবতে হবে। তাহলেই সব বৈষম্য আর সংকট দূর হয়ে যাবে।
শায়লা আবেদীন
ব্যাংকার
একজন সফল নারী। ঘরে ও বাইরে সমানভাবে সবকিছু মেইনটেইন করে নিজের কাজকে উপভোগ করছেন। প্রতিমুহূর্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটাতে হয় তাকে। তিনি মনে করেন, ব্যস্ততা আছে বলেই নতুন কিছু উপভোগ করতে পারেন, জানতে ও শিখতে পারেন।
তিনি মনে করেন, পুরুষ বা নারী উভয়ই মানুষ। পৃথিবীর উন্নয়নে, সমাজের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা ও অবদানকে উৎসাহিত করার জন্য সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। নারী যেন অনুপ্রাণিত হন, এগিয়ে চলার শক্তি পান। সে বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
নারী নির্যাতন শুধু আমাদের দেশেই হচ্ছে না, পৃথিবীর অন্য দেশেও হচ্ছে। নারী নির্যাতনকে তিনি দুভাগে ভাগ করে দেখতে চান- শারীরিক ও মানসিক। অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের চেয়ে নারীর ওপর যে মানসিক নির্যাতন হয়, তা অনেক বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে আমাদের পরিবারে, সমাজে ও রাষ্ট্রে। নারীর উভয় ধরনের নির্যাতনকে প্রতিরোধ করা সম্ভব, যদি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টায়।
নারীর সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন, এর জন্য প্রথমেই নারীকে মনোবল দৃঢ় করতে হবে বলে তিনি মনে করেন। শায়লা আবেদীন দৃপ্তকণ্ঠে বলেন, নানা কথা আসবে, বাধা আসবে- সবকিছু এড়িয়ে যেতে হবে। আমি পারি। আমি এটা করবই। এগিয়ে যাবই। তাহলে দেখবেন, কোনো প্রতিবন্ধকতাই আর বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
তিনি আরও বলেন, নারীর সাফল্যে পরিবারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নারীর আসলে দুটি পরিবার। প্রথমটি হচ্ছে তার বাবার আর দ্বিতীয় পরিবার হচ্ছে স্বামীর। বাবার বাড়ির দায়িত্ব হলো তাদের কন্যাসন্তানের মেধাবিকাশে আত্মবিশ্বাসী করে তোলা এবং স্বামীর পরিবারের দায়িত্ব হলো, তার প্রতিভা বিকাশের সুযোগকে বাধা না দেওয়া, অনুকূল পরিবেশ করে দেওয়া। এতে করে শুধু নারী নয়, স্বামীর পরিবারও উপকৃত হবে, সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন ঘটবে। সে ক্ষেত্রে দুটি পরিবারের একটি বিরাট রোল রয়েছে। অনেক পরিবার আছে, একটা বউ এলে তার ওপর নানা ধরনের মানসিক নির্যাতন শুরু করে দেয়। পছন্দমতো ক্যারিয়ার তৈরিতে বাধা দেয়, তাদের ধারণা, বউ শুধু বাচ্চা লালন-পালন করবে আর সংসারের কাজ করবে। এ ধরনের মানসিকতায় আমরা পিছিয়ে থাকি, যা পরিবর্তন হওয়া খুব দরকার। এ ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, নারীর অগ্রযাত্রায় নারীই বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
শায়লা আবেদীন মনে করেন, প্রতিটি প্রজন্মের চিন্তাভাবনা আলাদা। বেগম রোকেয়া থেকে নারীর প্রতিটি প্রজন্মই কিন্তু একটু একটু করে উন্নতি করেছে। এগিয়ে গেছে। আমার পরবর্তী নারী প্রজন্মের উদ্দেশে বলব, যে কাজটি করবে, সুন্দর করে গুছিয়ে করবে। তোমার যা করতে ইচ্ছে করবে। রাগারাগি না করে পরিবারের সদস্যদের বুঝিয়ে আদায় করা হলে দেখবে, প্রতিবন্ধকতাও অনেকটা কমে এসেছে। নিজেকে আত্মবিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
শায়লা আবেদীন মনে করেন, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তার বড় কারণ হচ্ছে, এই পরিবর্তনের ফলে নারী তার উন্নয়নে অনেক স্পেস পাচ্ছে। সহযোগিতা পাচ্ছে। আমি আশা করব, নারীর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অনেক পুরুষ আরও সহযোগিতাপরায়ণ হয়ে উঠবে। যতটুকু বৈষম্য রয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করবে।
তৈয়বা বেগম লিপি
চিত্রশিল্পী
ড্রইং, পেইন্টিং, ভাস্কর্য এবং ভিডিও আর্ট নিয়ে কাজ করছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রদর্শিত হয়েছে তার শিল্পকর্ম। শিল্পপ্রতিষ্ঠান বৃত্ত আর্ট ট্রাস্টের অন্যতম উদ্যোক্তা।
তিনি বলেন, গাইবান্ধায় তখন মফস্বলের পরিবারগুলোতে সংস্কৃতিচর্চা কমবেশি ছিল। আমাদের পরিবারেও ছিল। তবে পেইন্টিংস নিয়ে পড়াশোনা করার বিষয়ে প্রথমে কারও মত ছিল না। বড় ভাই তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র। পরিবারের ভাবটা ছিল এমন, একজন তো হলোই, তোমার আবার দরকার কী? অন্য কিছু নিয়ে পড়ো। যে কারণে চারুকলায় ভর্তি হওয়াটা বৈরীই ছিল আমার জন্য।
তিনি জানান, উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকায় এলাম। এখানে আমার আরেক বড় ভাইয়ের বাসায় উঠি। একদিন তিনি চারুকলায় ভর্তির একটা বিজ্ঞপ্তি দেখালেন। বললেন, একবার চেষ্টা করবি নাকি? বললাম, হ্যাঁ, করা যায়। তিনিই চারুকলায় ভর্তির বিষয়ে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেন। প্রথম দিন চারুকলায় গিয়ে মুগ্ধ হলাম। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আর কোথাও পরীক্ষা দেব না। পরে চান্স পেলাম। ভর্তিও হলাম। ছয় মাস বাড়ির অন্য কেউ এটা জানতেন না। ঢাকায় আমার দু-ভাইবোন জানতেন। পরে ভাই বাবাকে জানালেন।
শিল্পের যে মাধ্যমটি ব্যবহার করে মনের ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন- সে বিষয়ে তিনি বলেন, এটি আমার অস্থিমজ্জায় চলে গেছে। যদি চিত্রকলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতাম, জানি না কতটা নিজেকে প্রকাশ করতে পারতাম। যেহেতু অনেকগুলো মাধ্যম ব্যবহার করি- ভাস্কর্য, ভিডিও, পেইন্টিং, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি, তাই যা ফুটিয়ে তুলতে চাই, সেই বিষয় মাথায় রেখে মাধ্যম নির্ধারণ করি।
তার প্রথম শিল্পকর্মের যাত্রা নেপালে। এরশাদ সরকারের সময়ে, ১৯৮৬ সালে ভর্তি হন। ৯০ সালে এরশাদের পতন হলো। আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। চারুকলা প্রায়ই বন্ধ থাকত। এরশাদ পতনের পরও দীর্ঘ একটা সময় ক্লাস হতো না। পরীক্ষার জন্য কয়েকটি ব্যাচ একসঙ্গে জড়ো হয়ে যেত। স্নাতক থেকে স্নাতকোত্তরের মাঝে অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। তিনি বলেন, চারুকলায় থাকতে থাকতেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছিলাম। ১৯৯৩ সালে স্নাতক করার পর দেখলাম, অনেকগুলো ব্যাচ পড়ে আছে। বুঝলাম, ক্লাস শুরু এবং শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। তখন বন্ধুবান্ধব সবাই মিলে কিছু করার সিদ্ধান্ত নিলাম। নব্বইয়ের দিকে দেশে গ্যালারিও খুব বেশি ছিল না। সেখানে কাজ করতেন সিনিয়র আর্টিস্টরা। আমরা তখন ছাত্র। চিন্তা করলাম সাউথ এশিয়ায় ভ্রমণ করব। পরে ভারত হয়ে নেপালে যাই। সেখানে আমাদের শিল্পকর্মের প্রদর্শনী ভালো হয়েছিল। ফিরে এসে ভুটান ও কলকাতায় প্রদর্শনী করি।
তাার জীবনসঙ্গী মাহবুবুর রহমানও একজন শিল্পী। তিনি বরেন, আসলে আমাদের সবটাই শিল্পীজীবন। একসঙ্গে দুজনে পড়াশোনা করেছি। বন্ধুর মতো বড় হয়েছি। চারুকলায় পড়ার সময় মাহবুব আমার মেন্টরের মতো ছিল। আমাদের বাসাটা সব সময়ই বন্ধু-শিল্পের জন্য খোলা ছিল। সবাইকে নিয়েই ছিল আমাদের জীবন। এখন আমাদের বাড়িতে একটা স্টুডিও আছে, শোবার ঘরটা সব থেকে ছোট। দুজনই শিল্পের মানুষ হওয়ায় আমাদের বোঝাপড়াটা সহজ হয়েছে। তা না হলে আমি একা পারতাম না।
আপনার শিল্পকর্মগুলো সমাজে পরিবর্তনে কতটা প্রভাব ফেলছে বলে মনে করেন? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যে যার জায়গা থেকে কাজগুলো করে যাই। এগুলো কতটা সমাজে প্রভাব ফেলছে, এটা আসলে বলা কঠিন। বলব না যে, এটা সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। তবে ছোট ছোট অনুষঙ্গ মিলেই তো বড় কিছু হয়। কোনো একটা বিষয় যখন ভাবায়, তখন কীভাবে সেটাকে উপস্থাপন করব, সেটা নিয়ে চিন্তা করি। কাজ করি। অনেকের হয়তো সেটার সঙ্গে সংযোগ হয়। অনেকে হয়তো পারেন না।
তিনি মনে করেন, চিত্রকলা বা ভাস্কর্যশিল্পে নারীরা অনেকেই অনেক কাজ করছেন। এখন আসলে বিভিন্ন দ্বার খোলা। সেই তুলনায় মেয়েরা আসলে কিছু কাজ করছে না। প্রতিবছর চারুকলা থেকে যত মেয়ে শিল্পী হয়ে বের হচ্ছে, তাদের সবাই তো কাজ করছে না। অনেকের পরিবার হয়তো তাকে কিছু করতে দিচ্ছে না। মনে হয়, যদি ইচ্ছা থাকে, তাহলে উপায় হয়। কেউ আপনার হাত আটকে রাখতে পারবে না।