রসনাবিলাস I ক্লাউড কিচেন
নিজ বাড়িতে অন্যের কিচেনে তৈরি খাবারের ব্যবস্থা। অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কারণেই সম্ভব হয়েছে। অতিমারিতে এর উপযোগিতাও কাজে লাগছে। লিখেছেন সিফাত বিনতে ওয়াহিদ
অনলাইন বিজনেসের চল আগে থাকলেও রান্না-ভালোবাসার মানুষের জন্য নিউ নরমাল ডাইন হিসেবে নতুনভাবে সামনে এসেছে ‘ক্লাউড কিচেন’ বা ‘ঘোস্ট ডাইনিং’।
রান্না জানা থাকলে, রসুইঘরে যত্ন নিয়ে কাজটি করতে ভালোবাসলে ঘরে বসেই রন্ধনশিল্প হয়ে উঠতে পারে লাভজনক পেশা। সব ধরনের উদ্যোগকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে পারলে ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ কিছু করা যায়। সে রকমই এক সুযোগ ক্লাউড কিচেন। এর মাধ্যমে ঘরে বসে রান্না করে অর্থ উপার্জনও সম্ভব।
দেশি খাবারের পাশাপাশি বিদেশি খাদ্য বানানোতে দক্ষতা থাকলে ক্লাউড কিচেনের মাধ্যমে যেকোনো রেসিপি অনলাইনে বিক্রি করা যেতে পারে। অনলাইন ছাড়াও নিজের এলাকায় রান্না করা খাবার বিক্রয়ের প্রচার চালানো যায়। আবার স্থানীয় যেসব দোকানে খাবার বিক্রয় করে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে রান্না খাবার সরবরাহ সম্ভব। এসব হতে পারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগে।
অনলাইন প্ল্যাটফর্মে খাবার অর্ডার করা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ মানুষের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততায় রসুইঘরে সময় দিয়ে রান্না ক্লান্তিকর। ফলে মানুষ খুব সহজেই অনলাইনে অর্ডার করে সেরে ফেলতে পারে এক বেলার খাবার। ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরে নানা কাজের ভিড়ে অতিথি আপ্যায়নে সময় বের করে নানা পদের প্রিপারেশনও কঠিন। তাতে অতিথির সঙ্গে দুদন্ড কথা বলার ফুরসত হয়ে ওঠে না। কিন্তু আপ্যায়নে বৈচিত্র্য না থাকলেও বাঙালির মনে ভরে না।
সম্প্রতি দেখা গেছে, অতিথি আপ্যায়নেও অনলাইনে খাবার অর্ডার করা একটা ট্রেন্ড হয়ে উঠেছে। ফলে হাতে যদি অফুরন্ত সময় থাকে, তবে অন্যের রসুইঘরে তৈরি খাবার ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা অনলাইনে অর্ডার করলেই খেতে পারবে। এর জন্য রেসিপি এবং রান্না করা বিভিন্ন পদের ছবি অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে পোস্ট করতে হবে। সেগুলোর মাধ্যমেই কাক্সিক্ষত গ্রাহককে পাওয়া যাবে। আবার গ্রাহকও ছবি দেখেই খাবারের অর্ডার দেবেন।
কিন্তু ঘরে তৈরি খাবার গ্রাহক পর্যন্ত পাঠানো যায় কীভাবে? সে ব্যবস্থাও রয়েছে। যে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে আপনি নিজের খাবার বিক্রয় করছেন, তাদের নিজস্ব ডেলিভারি ম্যান এসেই আপনার খাবার গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছে দেবেন। এখন দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো এভাবেই অফিস-আদালত থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ঘরের রান্না পৌঁছে দিচ্ছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘হোমশেফ বিডি’, ‘কুকঅ্যান্টস’, ‘ফুডটং’, ‘কুকঅ্যাপস’। তা ছাড়া ‘ফুডপান্ডা’, ‘পাঠাও ফুড’ অথবা ‘উবার ইটস’ তো রয়েছেই। এ ধরনের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমেই আপনার রন্ধনশৈলী কাজে লাগিয়ে প্রতি মাসে উপার্জন করতে পারবেন ভালো অঙ্কের টাকা।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা কুকঅ্যান্টসের সিইও এবং উদ্যোক্তা মোহাম্মদ ইনজামামুল হক ইমন বলেন, ‘আমাদের দেশে গৃহকর্মে নারীদের শ্রমের আর্থিক মূল্যায়ন হয়নি কখনোই। তারা নিজেদের বাড়ির রান্নায় যে শ্রম দেন; সেখান থেকে যদি কোনোভাবে তাদের আর্থিক প্রতিদান দেওয়া যায়, তাহলে তা নারীর ক্ষমতায়নকে এগিয়ে দেবে। আমার মাকে দেখেছি, অসুস্থ থাকলেও উনি কখনো রান্না বন্ধ করেননি। সব মা-ই এমন। কিন্তু এই অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য কি মাস শেষে পরিবারের পুরুষেরা কখনো এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তাদেরকে কোনো অর্থ প্রদান করেন? আমরা সেই কাজটাই করতে চেয়েছি। আমাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে অনেক মা-বোন মাসে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্তও আয় করেন। তাদের মধ্যে কাজের প্রতি যেই প্যাশন দেখতে পাওয়া যায়, এর মূল্যায়ন অবশ্যই হওয়া উচিত।’
কুকঅ্যান্টসের সঙ্গে যুক্ত হতে চাইলে তাদের ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আবেদন করতে হয়। এরপর তাদের জন্য কুকঅ্যান্টস থেকে আয়োজন করা হয় এক দিনব্যাপী একটি কর্মশালার। এখানে প্ল্যাটফর্মটির সঙ্গে যুক্ত হতে চাওয়া আগ্রহীদের হাইজিং এবং অন্যান্য বিষয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়। নেওয়া হয় তাদের খাবারের টেস্টও। ফুড টেস্টে উত্তীর্ণরা চূড়ান্তভাবে কুকঅ্যান্টসের সঙ্গে কাজ করার ছাড়পত্র পান। এই প্রতিষ্ঠানের আছে নিজস্ব ডেলিভারি ম্যান। খাবার গ্রাহকের দ্বার পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে পৌঁছে দিতে দুটি স্লটে নিরলস কাজ করে যান তারা। খাবার ডেলিভারিতে এ জন্য কোনো বাড়তি চার্জও নেওয়া হয় না।
হোমশেফবিডির উদ্যোক্তা আয়েশা আমিনা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ঘরে তৈরি খাবার দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি অন্য নারীদেরও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত করেন, যারা ঘরে বসেই রান্না খাবার বিক্রি করতে চান। প্ল্যাটফর্মটির ক্রেতা মূলত অফিসসহ নানা প্রতিষ্ঠান। তবে আয়েশা আমিনা জানান, এখন অনেক বাসাতেও দুপুরে নিয়মিত খাবার পাঠাচ্ছেন তিনি। চাকরিজীবীরা বাসায় থাকা সদস্যদের জন্য দুপুরের খাবার বাইরে থেকেই অর্ডার করে থাকেন। হোমশেফবিডির কোনো নিজস্ব ডেলিভারি পারসন নেই। পাঠাওসহ নানা অনলাইন ডেলিভারি সার্ভিস ব্যবহার করে গ্রাহকদের কাছে খাবার পৌঁছানো হয়। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ঘরে বসে আয় করার জন্য ক্লাউড কিচেন খুবই কার্যকর একটি মাধ্যম। তিনি নারীদেরকে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।
ক্লাউড কিচেনের মাধ্যমে আয়ের এই সুযোগের কথা জানতে পেরে যারা রান্না জানেন না, তাদের হয়তো আফসোস হতে পারে। তবে একটু বুদ্ধি খাটালে এই প্ল্যাটফর্ম কাজে লাগাতে পারবেন তারাও। রান্না ছাড়া শুধু রেসিপি বিক্রি করেও ‘আপওয়ার্ক’, ‘ইটসি’ বা ‘ফিভর’র মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে অংশ নেওয়া যায়। একটি সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে বিভিন্ন রেসিপি বিক্রির মাধ্যমে ভালো উপার্জন করা সম্ভব। শুধু রেসিপি সেলের জন্য রয়েছে আরও অনেক সাইট, যেমন ‘টেস্ট অব হোম’, ‘কুজিন অ্যাট হোম’, ‘কুকিং ফর ইঞ্জিনিয়ারস’ এবং ‘বেটার রেসিপি’র সাইটগুলো রান্না ছাড়াই ভিন্নমাত্রার রেসিপিগুলো কিনে নিতে পারে আকর্ষণীয় মূল্যে।
এই অনলাইন মাধ্যমগুলোতে রেসিপিপ্রতি ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। মাসে ৩-৫টা রেসিপি অথবা খাবার বিক্রয় করলেই গড়ে ১৫-২০ হাজার টাকা আয় করা যায়। কেউ কেউ এর চেয়ে বেশিও আয় করে থাকেন। ক্লাউড কিচেনের মূল উদ্দেশ্য ঘরে বসে থাকা নারীদেরকে নিজেদের কাজের মাধ্যমে মূল্যায়ন করা। ঘর-সংসারের কাজ সেরে, ফ্যামিলিকে প্রায়োরিটিতে রেখেও যে কেউ এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হয়ে বাড়তি অর্থলগ্নি ছাড়াও নিজেকে খুব সহজেই স্বাবলম্বী করে তুলতে পারেন।
ছবি: সংগ্রহ