ফিচার I জৈব বাসনকোসন
গাছগাছালির বিভিন্ন পরিত্যক্ত অংশ থেকেও যে বাসনকোসন তৈরি হচ্ছে, তা কি আমরা জানি? অথচ এর চেয়ে পরিবেশবান্ধব সামগ্রী আর হতে পারে না
মাটি, কাঁসা, পিতল, তামা, সিরামিক বা শক্ত কাঠের বিকল্প হিসেবে নানা রকম উদ্ভিজ্জ উপকরণেও তৈরি হতে পারে তৈজসপত্র। বাঁশ বা বেতে গড়া ডালা, কুলা, ফার্নিচার ইত্যাদি অনেক আগে থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সেসবের কদরও কম নয়। যদিও দামে সস্তা ও সহজলভ্য প্লাস্টিক পণ্যের কারণে এসব জৈব উপকরণ অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। তবে সুপারিগাছের খোল, আনারস বা কলাগাছের আঁশ থেকে দৈনন্দিন ব্যবহার্য বাসনকোসনসহ অন্যান্য জিনিসপত্রও প্রস্তুত করা যায়। এ যেন ধান গাছের তক্তা- এমনই অবাস্তব কল্পনা। কিন্তু এই অসম্ভবও এখন বাস্তব রূপ নিয়েছে।
গ্রামের রাস্তায় বা বসত বাড়ির বাগানে সুপারিগাছ বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকায় দেখা যায়। এই উদ্ভিদের খোল কুড়িয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে নারীরা। এটিকে টেনে নিয়ে যাওয়া গাড়ি বানিয়েও শিশু-কিশোরদের খেলতে দেখা যেত। হয়তো সেসবের প্রচলন এখনো গ্রামীণ পরিবেশে রয়েছে। এ ছাড়া কলাগাছ দেশের সব অঞ্চলেই প্রচুর জন্মায়। আনারস উৎপাদনের জন্য বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমৃদ্ধ জমি দরকার। কিছুটা উঁচু অঞ্চলে, যেমন টাঙ্গাইলের মধুপুর বা পার্বত্য এলাকায় এই ফলের চাষ ভালো হয়। ফল সংগ্রহের পর কলাগাছ অথবা আনারসে ছাল ও পাতা আবর্জনা হিসেবেই ফেলে দেওয়ার চল। কিন্তু এসব ফেলনা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা যায় মূল্যবান তৈজসপত্র। এগুলো পরিবেশবান্ধব এবং দৃষ্টিনন্দন। কোনো রকম রাসায়নিক দ্রব্য এসবে ব্যবহারের দরকার হয় না। ফলে এসব পণ্য প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়। বাংলাদেশে লক্ষ্মীপুর, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা অঞ্চলে সুপারিগাছের ঝরে পড়া পাতার খোল দিয়ে তৈজসপত্র তৈরির কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব এলাকায় এই শিল্প বিকাশের কারণ হলো, মাটির বৈশিষ্ট্য, যেখানে সুপারিগাছ ভালো জন্মে। টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় অঞ্চল কলা ও আনারসের জন্য বিখ্যাত। এই এলাকায় গড়ে উঠেছে কলাগাছের আঁশ এবং আনারসের পাতার তন্তু থেকে তৈজসপত্র ও অন্য দ্রব্যাদি তৈরির কারখানা।
থালা, বাটি, ট্রে ইত্যাদি ক্রোকারিজ ছাড়াও ঘড়ি, ফটোফ্রেম, ওয়ালম্যাট, জুতা তৈরি করা যায় সুপারিগাছের খোলের জৈব উপকরণে। কলাগাছের ছাল অথবা আনারসের পাতার তন্তু থেকেও প্রস্তুত করা যেতে পারে নানা রকম ক্রোকারিজ। মধুপুর গড় অঞ্চলে কলাগাছের বাকল ও আনারসের ফেলে দেওয়া পাতা সংগ্রহের পর প্রথমে সোনালি আঁশ [জুট] উৎপাদন করা হয়। পরে সেসব তন্তু প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে বানানো হয় উন্নত মানের ফুলদানিসহ নানা রকম শৌখিন ও মূল্যবান তৈজসপত্র, কার্পেট, পাপোস, রশি, টিস্যু বক্স, ডেস্ক অর্গানাইজার, নেট, পর্দা, ওয়াল হ্যাঙ্গার, চাবির রিং ইত্যাদি।
অন্যান্য দেশেও এখন এসব পণ্যের চাহিদা তৈরি হয়েছে। জাপানে গড়ে উঠেছে এ ধরনের তৈজসপত্রের বাজার। শৌখিন ও দৃষ্টিনন্দন এসব তৈজসপত্র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।
অন্যদিকে প্লাস্টিক পণ্য প্রকৃতিবিরোধী। এগুলোতে জীবাণু আটকে থাকতে পারে। ভাঙা টুকরো পচনশীল নয়, অর্থাৎ মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। ফলে সেসব জমির স্বাভাবিক উর্বরতা নষ্ট করে। মাটির হিউমাসের গঠন ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ জন্য পরিবেশ-গবেষকেরা বলছেন, যত বেশি প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা যাবে, পৃথিবীকে ততটাই বাসযোগ্য করে তোলা সম্ভব হবে। অন্যদিকে ধরণীকে সবুজায়ন করার বিষয়েও তারা মত দিয়েছেন। অর্থাৎ গাছ কাটার বদলে রোপণ করা জরুরি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে- বাঁশ, বেত বা অন্যান্য উদ্ভিজ্জ উপকরণ দিয়ে তৈজসপত্র তৈরির ফলে প্রকৃতি বিনষ্ট হবে কি না? বিষয়টি আগেই বলা হয়েছে, যেসব জৈব উপাদানে এই জিনিসপত্র বানানো হচ্ছে তার প্রায় অধিকাংশই ফেলনা বা ঝরে যাওয়া। তবে বাঁশ অথবা বেতের শিল্পের ক্ষেত্রে এর কারিগরেরা লক্ষ রাখেন যেন উৎস ধ্বংস না হয়। যদিও আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেতের ঝোপ যতটা দেখা যেত, এখন তা নেই বললেই চলে। এর কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ, রাস্তা সম্প্রসারণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষিজমি কমে যাওয়া, জলাশয় ভরাট করে ফেলা, বনভূমি উজাড় হওয়া ইত্যাদি। ফলে কেবল বেত ঝোপ উজাড় হওয়ার সঙ্গে এই শিল্পও সংকুচিত হতে বসেছে। সংশ্লিষ্টদের মত, এসব জৈব উৎসের সঠিক পরিচর্যা করলে একদিকে যেমন পরিবেশ বাসযোগ্য হবে, অন্যদিকে দৈনন্দিন ব্যবহার্য, শৌখিন তৈজসপত্রসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ আমাদের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: সংগ্রহ