এডিটরস কলাম I বৃষ্টিমুখর দিনে
বৃষ্টির দিনে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। আমার মনের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে শৈশব-কৈশোর। যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, প্রকৃতি সেখানে ছিল বৈচিত্র্যে ভরা
এখন বর্ষাকাল। প্রায় প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো দিন ভোর থেকে রাত অবধি। বাংলার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের এটি একটি অংশ বটে। একে আমরা উদযাপন করি বিভিন্নভাবে। এমন সময় বৃষ্টির গান শুনতে কার না ভালো লাগে। বর্ষার কবিতাও রচিত হয়ে আসছে বাংলা সাহিত্যের শুরু থেকেই। সময়-সুযোগ এলে বর্ষণে উপচে পড়া খাল, বিল, হাওর-বাঁওড়ে ভ্রমণ করি আমরা। বৃষ্টির কারণে বায়ুদূষণ কমে। ফলে আবহাওয়া তখন থাকে শরীরের অনুকূল। প্রকৃতিও স্নিগ্ধ ও সজীব হয়ে ওঠে। এ সময় শহর থেকে দূরে কোথাও কয়েক দিনের অবসর যাপনও দৈহিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। মোট কথা হলো, মৌসুমটি আমাদের চিত্তবিনোদনের বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করে দেয়। শুধু তা-ই নয়, এটি অনুভূতিকে জাগায়, ইন্দ্রিয়কে সুখী করে।
দুই
বৃষ্টির দিনে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। আমার মনের পর্দায় জীবন্ত হয়ে ওঠে শৈশব-কৈশোর। যেখানে আমি বেড়ে উঠেছি, প্রকৃতি সেখানে ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। বৃষ্টির দিনগুলো তা অন্যতর সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত হতো। পাহাড়, সমতল আর সমুদ্রের মেলবন্ধন ছিল সেখানে। বর্ষায় লোকালয় আর পাহাড়ের সবুজ আরও স্নিগ্ধ দেখাত। গান শুনে, বই পড়ে, আড্ডায় গল্প করে দিন কাটত। মা আমাদের জন্য কত রকমের খাবারই না তৈরি করতেন। বেলা শেষে আমরা অপেক্ষা করতাম বাবার জন্য। তিনি এলে কত কথা আর গল্প বর্ষার জলধারার মতো উপচে পড়ত। সবকিছুই তখন সুখকর ছিল। এখন কি আছে সে রকম জীবন? প্রশ্ন জাগে। বিনোদনের মধ্যে যে প্রকৃতির একটা ভাগ ছিল, তা কি আছে আজকাল? আমাদের জীবনধারায় নতুন নতুন কত কিছুই তো যুক্ত হয়ে গেল!
তিন
বাংলাদেশে খাদ্যের যে সংস্কৃতি, তার মধ্যে প্রকৃতির একটা প্রভাব নিশ্চয় আছে। নইলে বৃষ্টির দিনগুলোতে খাবারের কথা উঠলেই কেন খিচুড়ির প্রসঙ্গ স্বাভাবিক হয়ে ওঠে? সঙ্গে ইলিশ ভাজা, নানা রকম ভর্তা, বেগুন ভাজা, আচার, শুকনা মরিচ পোড়া, পেঁয়াজকুচি, স্যালাড ইত্যাদি তো থাকেই। বিকেল হলে আচারের তেল দিয়ে মুড়ি মাখানো, চিড়া ভাজা, চানাচুর- এসব ঝালযুক্ত মুখরোচক খাবার চায়ের সঙ্গে প্রিয় হয়ে ওঠে। যেহেতু ফলের মৌসুম, বিশেষত আম ও কাঁঠাল, জামরুল, লটকন, আমড়া, জাম্বুরা, ডেউয়া, কামরাঙা, গাব ইত্যাদিও খাওয়া হয়ে থাকে, সহজলভ্য বলে। অন্যদিকে বর্ষায় মাছের কমতি থাকে না। বিভিন্ন ধরনের মৎস্য আমাদের পুষ্টি জোগায়। নানান শাকসবজিও পাওয়া যায় এই ঋতুতে। সবকিছু মিলেই এটা আমাদের প্রায় ‘সব পেয়েছি’র মৌসুম।
চার
এত কিছু আমরা পাই, কিন্তু এসবের সঙ্গে নাগরিক জীবনে দুর্ভোগও কম নিয়ে আসে না এই দিনগুলো। জলাবদ্ধতার কথা বলছি। এটা তো এই ঋতুর নিত্যনৈমিত্তিক সমস্যা। বিশেষত শহরে। সেখানকার অলিগলি ও প্রধান রাস্তায় একটু বৃষ্টিতেই জল জমে বিপর্যস্ত করে তোলে জনজীবন। কোথাও কোথাও সেই জল সহজে সরে না, সপ্তাহের বেশি লেগে যায়। এই বদ্ধ পানি রোগব্যাধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বর্ষাকালে ত্বকের নানা সমস্যা দেখা দেয়। স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ জমে থাকা জলের সংস্পর্শ এর প্রধান কারণ। বৃষ্টির দিনগুলোতে আবহাওয়া বেশ শীতল থাকে, ফলে অনেকেই নিয়মিত গোসল করতে চান না। কিন্তু এটা একদমই ঠিক নয়। বছরের সব সময়ই দিনে অন্তত একবার গোসল প্রয়োজন। আর বৃষ্টির মধ্যে বাইরে গেলে বাড়িতে এসে অবশ্যই ভালো করে হাত-পা-মুখ ধুয়ে নেওয়া জরুরি। ময়শ্চারাইজিংও দরকার।
পাঁচ
শহরের কথা তো বলা হলো। বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল, বিশেষত নদী সন্নিহিত লোকালয় এবং কৃষিজমি এ সময়ে বন্যাজনিত দুর্যোগের মধ্যে পড়ে। উত্তরের উজান থেকে আসা ঢলে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়। মানুষের দুর্ভোগের সীমা থাকে না। গৃহহীন হয়ে পড়ে, খাদ্যাভাব দেখা দেয়, পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। গবাদিপশু ও গৃহপালিত প্রাণীর প্রাণহানি ঘটে ব্যাপকভাবে। এখন আবার বজ্রপাতে মৃত্যুর হারও বেড়েছে দেশে। এসব সমস্যা মানুষ কাটিয়ে উঠতে পারে, যদি আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই। প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে তাদের কাছে যাই। শুধু নাগরিক সমাজের এই তৎপরতা যথেষ্ট নয়, সরকারেরও দায়বদ্ধতা আছে।
ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু