skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I রেশমি উত্থানের গল্প

বিলুপ্তির শেষ ধাপে চলে যাওয়া সেই চীনা ফ্যাব্রিককে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন জার্মানির এক ডিজাইনার। আজ তারই জয়জয়কার। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

১৯৯৪ সাল। মিউনিখের মেয়ে ক্যাথরিন ফন রেচেনবার্গ ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পাড়ি জমালেন পারিতে। ভর্তি হলেন প্রাইভেট ফ্যাশন স্কুল ইকোল দে লা শ্রম্বে সিন্দিকেল দে লা কতুর পারিসিন-এ। হাই-এন্ড ফ্যাশন সম্পর্কে যাদের খুঁটিনাটি আগ্রহ আছে, তাদের কাছে এই নাম অপরিচিত নয়। ইভ স্য লরা, কার্ল লেগারফেল্ড, আলেক্সিস ম্যাবিলের মতো কিংবদন্তি ডিজাইনাররা ছিলেন এই জগদ্বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানটির অ্যালামনাই। এখানে এসে ক্যাথরিন সহপাঠী হিসেবে পান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা একঝাঁক উঠতি ডিজাইনারকে। এদের ভেতর ছিলেন তাইওয়ানিজ এক ডিজাইনার। সেই সহপাঠী বন্ধু একদিন তাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন একটি অভিজাত চীনা কাপড়ের সঙ্গে। নাম শিয়াং ইয়ুন শা। এর শাব্দিক অর্থ ফ্র্যাগরেন্ট ক্লাউড ইয়ার্ন বা সুগন্ধি মেঘের সুতা। আসলে এটি ছিল চা দিয়ে ডাই করা ফ্যাব্রিক, যা এখন সবার কাছে টি-সিল্ক নামে পরিচিত। অবাক করার বিষয় হলো, যখন ক্যাথরিন এই বিশেষ ফ্যাব্রিক সম্পর্কে জানতে পারেন, তখন এটি ছিল চীনাদের কাছে বেশ অবহেলিত। ১৯৯৬ সালে তার গ্র্যাজুয়েশনের দিন তিনি রওনা দেন তাইওয়ানে, সেই বন্ধুর ব্র্যান্ডে যোগ দিতে। সেখানে তারা এই ফ্যাব্রিক নিয়ে কিছুদিন কাজ করেন। কিন্তু তাদের সেই প্রজেক্টটি সফলতার মুখ দেখেনি।
ক্যাথরিন ফিরে আসেন প্যারিসে। কয়েক বছর কাজ করেন ক্রিশ্চিয়ঁন লাখোয়া, ক্রিশ্চিয়ঁন দিওর, জ্য লুই শেরের, শ্যানেলের মতো নামজাদা লেবেলে। কিন্তু বেশি দিন কোথাও মন টেকাতে পারেননি। এসব জায়গায় কাজ করার সময় বুঝতে পেরেছিলেন, তার আসল প্যাশন কী এবং সেটা কোথায়। প্যারিসের হাই-এন্ড ফ্যাশন ক্যারিয়ার আর বিলাসবহুল জীবনের হাতছানি পিছু ফেলে মিউনিখের মেয়ে ক্যাথরিন ঘর ছাড়লেন। গন্তব্য সেই তাইওয়ান। সেখানে গিয়ে তিনি যোগ দিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তাইওয়ানিজ ডিজাইনার সোফি হং-এর টিমে। তার সাহায্য নিয়ে ক্যাথরিন নতুন করে নেমে পড়লেন টি-সিল্কের অনুসন্ধানে। পেয়ে যান অনেক তথ্য।
শিয়াং ইয়ুন শা বা টি-সিল্কের উৎপত্তি মিং রাজবংশের আমলে। সপ্তদশ শতাব্দীর আগে। এর জন্মস্থান চীনের গুয়াংডং প্রদেশে, যা বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত ক্যান্টন নামে। এ প্রদেশের শুন্ডে বা শুন্টাক ডিস্ট্রিক্টে প্রথম টি-সিল্ক বানানো শুরু হয়। অঞ্চলটির অবস্থান বিখ্যাত মুক্তা নদীর (চুচিয়াং) তীরে। এই বিশেষ ফ্যাব্রিককে একসময় সবচেয়ে বিলাসবহুল সিল্ক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ত্রিশের দশকটি হলো টি-সিল্কের সোনালি সময়। তখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিজাত মহলে ছিল এর বিশেষ কদর। তাদের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত পণ্যটির দাম ছিল স্বর্ণের চেয়ে বেশি। আর তখন টি-সিল্ক চীনে লোকাল আইকনে পরিণত হয়েছিল। ব্যাপক চাহিদা থাকায় শুন্ডে অঞ্চল টি-সিল্ক ফ্যাক্টরিতে ভরে উঠেছিল। খুব ভালোই চলছিল এর কারিগরদের দিনকাল।
ষাটের দশকে চীনজুড়ে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে শুরু হলো সাংস্কৃতিক বিপ্লব। ইতিহাসে যা গ্রেট প্রলেতারিয়ান কালচারাল রেভল্যুশন নামে পরিচিত। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬— এই দশ বছরে পুরোনো প্রথা, সংস্কৃতি আর চেতনা ছুড়ে ফেলার হিড়িক পড়ে যায়। শিয়াং ইয়ুন শা ফ্যাব্রিক ও বাদ পড়েনি। এর বাজারটি পুঁজিবাদের প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে সমালোচনার মুখে পড়ে। কারিগরদের সমাজতন্ত্রের বিরোধী হিসেবে গণ্য করা হলো। শিয়াং ইয়ুন শাকে বলা হলো বুর্জোয়াদের কাপড়। আর নিমেষেই বন্ধ করে দেওয়া হলো পাঁচ শর বেশি টি-সিল্ক ফ্যাক্টরি। এভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে শত বছরের ঐতিহ্যময় এই শিল্প। তবু কিছু কারিগর আর তাদের বংশধরদের চেষ্টায় কোনোরকমে টিকে ছিল।
ক্যাথরিন এই ফ্যাব্রিকের সন্ধানে তাইপে থেকে চলে যান চীনে। শুন্টাকে এসে দেখলেন, এখনো সেখানে সেই পুরোনো পদ্ধতিতে বানানো হচ্ছে টি-সিল্ক। আর এটি মোটেও কোনো সহজ কাজ ছিল না। এর জন্য দরকার দক্ষ কারিগরি শৈলী, কঠোর শ্রম এবং ধৈর্য। প্রথমে ডায়াসকোরিয়া সিরোসা নামের ট্যানিন-সমৃদ্ধ একধরনের ইয়াম গুঁড়া করে পানি দিয়ে মাটির পাত্রে মেশানো হয়। এই রাস্টি-অরেঞ্জ কালারের মিশ্রণে সিল্কের কাপড় ত্রিশ থেকে চল্লিশবার ভেজাতে হয় এবং প্রতিবার ভেজানোর পর ঘাসের ওপর বিছিয়ে শুকানো হয়। এরপর মুক্তা নদীর আয়রন সমৃদ্ধ মাটিতে কাপড়গুলো আচ্ছাদিত করার পর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয়। একদম শেষে চায়ের মিশ্রণে ভিজিয়ে শুকাতে হয়। ফলে সিল্কের কাপড়ে প্রাকৃতিকভাবে চমৎকার শেড (একদিকে কালো, অন্যদিকে বাদামি-মরিচা রং) পড়ে। যত দিন যাবে টি-সিল্কের রং তত গাঢ় আর নরম হবে। এটি অসাধারণভাবে মসৃণ, তাজা, চকচকে ও ত্বকের জন্য বেশ আরামদায়ক। এ ছাড়া টি-সিল্ক জীবাণুনাশক।
এই ওভার দ্য টপ ডাইং প্রসেস দেখে ক্যাথরিন বুঝে গিয়েছিল, এই ফ্যাব্রিক নিয়ে কাজ করা সহজ হবে না। এবং এতে খুব বেশি টাকাও আসবে না। তবু তিনি দমে যাননি। কিছুদিন কাজ করে সোফিয়া হং-এর টিম ত্যাগ চলে আসেন বেইজিং। সেখানে নিজের নামে একটি ফ্যাশন স্টুডিও প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে টি-সিল্ক দিয়ে নানা রকম ফ্যাশনেবল ড্রেস বানানো শুরু করেন। পাশাপাশি এ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যান। শুরুটা অনেক কঠিন ছিল। লোকাল চায়নিজরা স্টাইলিংয়ের দিক দিয়ে ছিল বেশ পশ্চিমঘেঁষা। এটির প্রতি তেমন আগ্রহ ছিল না। তার প্রথম দিকে ক্লায়েন্টরা ছিল তাইওয়ান আর হংকংয়ের। চীনাদের কাছে টি-সিল্ক ছিল ‘মান্ধাতার আমলের’ কাপড়, যা কেবল দাদি-নানিদের মানায় এবং একঘেয়ে কারণ, এর মাত্র দুটো রং। তবে এখন বদলেছে অনেক কিছু। রুচির পরিবর্তন এসেছে। অনন্য নির্মাণশৈলীর জন্য লোকাল পণ্যের প্রতি ক্লায়েন্টদের চাহিদা বেড়েছে। ফলে প্রডাক্টের ওপরের সারিতে আছে টি-সিল্ক।
এটি চীনা সিল্ক শিল্পের এখন পর্যন্ত টিকে থাকা কারিগরি শৈলী। ২০০৮ সালে এই টি-সিল্ক চীনের ‘ন্যাশনাল ইনট্যানজিবল হেরিটেজ লিস্ট’-এ জায়গা করে নেয়।
এর পুরো কৃতিত্ব ক্যাথরিনের। কারণ, তিনি ঘরছাড়া না হলে মৃতপ্রায় এই শিল্পকে বিকশিত করা সম্ভব হতো না।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top