রসনাবিলাস I সিনেক্যাফে
ছায়াছবির আবহে আনন্দে সময় কাটানোর নানা ব্যবস্থা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই ক্যাফে। তাতে কেবল কফির বিশেষত্ব নয়, রয়েছে মজাদার খাবারের সম্ভার
সিনে ক্যাফে। নামের মধ্যেই চলচ্চিত্র এবং কফির মেলবন্ধন। ধানমন্ডির সীমান্ত স্কয়ারের পাশে আহমেদ অ্যান্ড কাজী টাওয়ারের দোতলার এই রেস্তোরাঁ। এর দরজা অপ্রশস্ত বটে; তবে অন্দর তা নয়। ২৪০০ বর্গফুটের তুলনায় খোলামেলা রেস্তোরাঁ। হাতের ডানে একটি বুকশেলফ। বিনয় মজুমদারের কবিতার বই ছাড়াও বিখ্যাত সাহিত্যিকদের বেশ কিছু উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ তাতে ঠাঁই পেয়েছে। পাশেই দেশীয় মৃৎশিল্পের গ্যালারি। সেখানে মাটির তৈরি বাহারি কারুপণ্য। পেছনে কমলা রঙের দেয়ালে পাখির ওড়াউড়ির ছবি। মনে হয়, গোধূলিতে নিস্তেজ সূর্যের কোমল আলোর বিপরীত দিক থেকে দেখা পাখিদের নীড়ে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য।
রেস্তোরাঁর এক অংশে দেখা গেল ফেলুদা কর্নার। দেয়ালে সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা চরিত্র ফেলুদার বিভিন্ন পর্বের ছবি। ফ্রেমে আঁটা। এ ছাড়া রয়েছে ত্রিমাত্রিক কিছু ছবি, যেগুলো জীবন্ত মনে হয়। ব্যাংককে এসব ছবির কদর আছে। ‘সিনে ক্যাফে’-এর নামের প্রথম অংশের রহস্য উদ্ঘাটিত হলো ঘাড় উঁচু করে। ছাদ ছুঁয়ে আছে সিনেমার রিলের ধাতব বাক্সের আদলে তৈরি গোটা কয়েক গোলাকৃতির চাকতি। সেগুলোর মধ্যে ফিতাসদৃশ সংযোগ। তাতে দেশি-বিদেশি কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পীদের ছবি; সাদাকালো ও রঙিন। হঠাৎ যা চোখে পড়ে, তা হচ্ছে ক্ষুদ্র পরিসরে একটি মিউজিক স্টেজ। মিউজিক্যাল চেয়ার, ইনস্ট্রুমেন্ট, প্রজেক্টর, পর্দা- সব মিলিয়ে ওই অংশে বিদ্যমান সুরেলা আবহ। সেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটায় আসেন দেশীয় বিভিন্ন কণ্ঠশিল্পী কিংবা ব্যান্ড। গান করেন রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত। কিছুদিন আগে এখানে গান পরিবেশন করে গেছেন প্রতীক হাসান। গানের মানুষ ছাড়াও এ রেস্তোরাঁয় আসেন নাট্যজন, চলচ্চিত্র এবং ক্রীড়াঙ্গনের তারকারাও। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের বোলার তাসকিন আহমেদ, অভিনেত্রী পপি এসেছিলেন। স্টেজের পেছনের যে পর্দা, সেখানে সপ্তাহান্তে একটি করে পুরোনো দিনের চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়।
সিনে ক্যাফের এই আবহের মধ্যেই সাজানো আছে সোফা। এমন ইন্টেরিয়রের নেপথ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র পরিচালক সজল আহমেদ। অভিনেত্রী মিষ্টি জান্নাতের উদ্যোগে নির্মিত এ রেস্তোরাঁর ইন্টেরিয়র করেছেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন চলচ্চিত্রাঙ্গনের শিয়াব আহমেদ ও সুদীপ্ত। এত সাজসজ্জার পরও তারা ৩০০ বর্গফুট জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন রসুইঘরের জন্য। সেখানে কাজ করেন অভিজ্ঞ ও শিক্ষানবিশ মিলে ১৮ জন শেফ। একজিকিউটিভ শেফ রয়েছেন দুজন। তারা ভারতীয়। সুতরাং সিনে ক্যাফের মেন্যুতে ভারতীয় কুজিনের উপস্থিতি অবধারিত। রেস্তোরাঁর হেড অব অপারেশনস জনি আহমেদ রাজুর সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ভারতীয় ছাড়াও থাই, চায়নিজ, ইতালিয়ান, মেক্সিকান কুজিনও তারা পরিবেশন করেন। মোদ্দা কথা, মাল্টিকুজিন বৈশিষ্ট্যেই এগিয়ে যাচ্ছে সিনে ক্যাফে।
২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বরে সূচনা হয়েছে এ ক্যাফের। এখনো গ্র্যান্ড ওপেনিং হয়নি। সেটা হবে এ বছরের মার্চ নাগাদ। তাই বলে এখন অজানা বা অচেনা নেই সিনে ক্যাফে। বিশেষ কিছু পদ ও দরদাম সাধ্যের মধ্যে থাকায় ইতোমধ্যেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে রেস্তোরাঁটি। বলে রাখা ভালো, এটি যে শুধু কফি শপ, তা নয়। অ্যাপেটাইজার, স্যালাড, স্ন্যাকস, স্যুপ, ডেজার্ট, কাবাব, ড্রিংকস, সিফুড- সবই আছে এখানে। সেগুলোর পাশাপাশি চলে কফি। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা কফি বিন নিজেদের মতো করে প্রক্রিয়াজাতের পর তৈরি কফি পরিবেশন করে সিনে ক্যাফে। তাদের সিগনেচার আইটেম হচ্ছে রিফ্রেশিং কফি। তবে এরপর কফিপ্রেমীরা মূলত এখানে আসেন ক্যাপাচিনোর আকর্ষণে। যাদের কফিতে বারণ, তাদের জন্য রয়েছে চায়ের বন্দোবস্ত। রিফ্রেশিং কফির মতোই আছে ‘রিফ্রেশিং টি’। চায়ের তালিকায় আরও আছে ‘আইসড লেমন টি’।
এই রেস্তোরাঁর খাবারগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠার নেপথ্যে কাজ করেছে তাদের আইডিয়া এবং ফোকাসড কাস্টমার। টিনএজার শিক্ষার্থীদের জন্য সিনে ক্যাফেতে রয়েছে স্টুডেন্ট সেট মিলের বিশেষ প্যাকেজ। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মাত্র ১৬৫ টাকায় তারা পাচ্ছে চারটি আইটেম- থাই ফ্রায়েড রাইস, ভেজিটেবল, চিকেন চিলি অনিয়ন এবং এক টুকরা থাই ফ্রায়েড চিকেন। ফলে এই সময়টা উঠতি বয়সীদের আনাগোনায় মুখর থাকে ক্যাফের অন্দর। পাশাপাশি কর্মজীবীদের জন্য আছে সিনে ক্যাফেতে বিশেষ লাঞ্চ। এটাও সেট মেনু। ২২৫ থেকে শুরু করে ২৯০ টাকার মধ্যে। বরিষ্ঠদেরও মন খারাপের অবকাশ রাখেনি সিনে ক্যাফে। সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য আয়োজন স্নেহমুক্ত স্বাস্থ্যকর ‘সিনে স্পেশাল স্যুপ’।
এর পাশাপাশি প্রতি মাসেই থাকে বিশেষ বিশেষ অফার। খুব শিগগির আসছে সিনে ক্যাফে বুফে। ৪৯৯ টাকায় উপভোগ করা যাবে ৩০টি পদ। ইতিমধ্যে হাঁসের মাংস দিয়ে খিচুড়িও ভোজনরসিকদের আকৃষ্ট করেছে।
সম্ভাবনা রয়েছে অচিরেই ছায়াছবিপ্রাণিত নতুন কিছু পদ সংযোজনের। অন্তত ক্যাফের নামের মাহাত্ম্য বাড়াতে। এসব পদের নামকরণ হতে পারে রুপালি পর্দার তারকার নামের সঙ্গে মিলিয়ে কিংবা আসতে পারে তারকাদের পছন্দের পদ।
সিনে ক্যাফের সিফুড, যেমন ‘গ্রিল ফিশ’ও রাখা হয়েছে তারকাদের কথা চিন্তা করে। বেশ কয়েকজন তারকার সিফুড প্রেমকে উৎসাহিত করতেই এই পর্বের সংযোজন; যা আরও সমৃদ্ধ হবে বলে জানালেন রেস্তোরাঁর হেড অব অপারেশনস।
এ ছাড়া এখানকার শেফদের উদ্ভাবিত কিছু ‘শেফস স্পেশাল কুজিন’ও রয়েছে। যেমন- গ্রিন চিকেন কারি উইথ রাইস, বিফ রেড কারি উইথ রাইস, ইন্দোনেশিয়ান প্লেটার ও বাটার চিকেন কারি। চাউমিনও বেশ জনপ্রিয়। কেননা, এটি তারা করেন থাই স্টাইলে।
‘সিনে স্পেশাল পিৎজা’ নামে বিশেষ এক পিৎজাসহ আরও পাঁচ রকম পিৎজা মেলে এখানে। রয়েছে চিকেন ক্রিসপি বার্গারসহ মোট তিন ধরনের বার্গার। এগুলোর পাশাপাশি পাওয়া যায় শর্মাও।
ডেজার্ট আইটেমের মধ্যে বর্তমানে কেবল পুডিং ও ফিরনি ছাড়া হাতে গোনা দু-তিনটি আইটেম থাকলেও অচিরেই যুক্ত হতে যাচ্ছে কাপ কেক ও ব্রাউনি। ড্রিংকসের মধ্যে এখানকার ‘সিন্ডারেলা’ বেশ চলে। পাশাপাশি চলে কোকোনাট ও স্ট্রবেরি ফ্রাপে।
বইয়ের শেলফের কথা শুরুতে বলেছিলাম। কফিতে তারিয়ে তারিয়ে চুমুক দিতে দিতে পড়তে থাকা কোনো বই পছন্দ হলে সেটি অনায়াসে কিনেও নেয়া যাবে। সিনে ক্যাফের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো মৃৎশিল্পপ্রেম। মৃৎশিল্পীদের নিয়ে তাদের আছে পৃথক পরিকল্পনা। তাদের তৈরি পণ্য প্রদর্শনী ও বিক্রির সুযোগ থাকছে এখানকার গ্যালারিতে।
আপাতত ধানমন্ডি ২ ছাড়া সিনে ক্যাফের আর কোনো শাখা নেই। তবে অচিরেই ঢাকায় আরও চারটি শাখা ছড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে তারা। এর প্রথমটি হতে পারে বনানীতে।
শিবলী আহমেদ
ছবি: সৈয়দ অয়ন, সিনে ক্যাফে