ফিচার I ডিজিটাল মেকআপ
প্রযুক্তি পাল্টে দিচ্ছে প্রসাধন ব্যবহারের চিরচেনা কৌশল। মেকওভার স্যালনকে পুরে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। প্রভাবিত করছে গোটা সৌন্দর্যবিশ্বকে। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
সোশ্যাল মিডিয়া জীবনযাপনে হাজার রকম পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। এর মাঝে ডিজিটাল মেকআপ একটি। ফটোশপ থেকে এর যাত্রা শুরু। এখন এসে পৌঁছেছে মুঠোফোনের ছোট্ট অ্যাপে। সেখানে রং বাহারি ফিল্টার রয়েছে। সেই ফিল্টার এখন আবার পাওয়া যাচ্ছে ইমেজ-সেন্ট্রিক সোশ্যাল হ্যান্ডেলগুলোতেও। এর মাঝে ইনস্টাগ্রাম, স্ন্যাপচ্যাট, টিকটক দারুণ জনপ্রিয়। ফেসবুকের মাই ডে অপশনেও দেখা মেলে ফিল্টারের। পুরো ছবির কালার শেড বদলের পালা থেকে এ গল্পের শুরু বলে ধারণা করা যায়, যা পাখা মেলেছে ডিজিটাল মেকআপ টুলসহ অ্যাপের বদৌলতে। সেখানে সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে রয়েছে নানা রকম টুলস আর অপশন।
মেকআপ কারও কাছে চিরন্তন আগ্রহের বিষয়, কারও কাছে আ বিগ নো! ডিজিটাল মেকআপ সনাতন মেকআপেরই মেটাভার্স যুগের নতুন ধারণা। এখানে আয়নাতে চোখ রেখে সাজতে হবে না, চোখ রাখতে হবে ডিজিটাল স্ক্রিনে। অগমেন্টেড রিয়েলিটির প্রভাবে মেকআপ শপিং হ্যাবিট থেকে মেকআপ করে নেওয়ার কৌশলেও আসবে বড় পরিবর্তন।
ডিজিটাল মেকআপ অ্যাপ্লাই করা হয় একটি ছবির ওপরে। সেখানে প্রতিটি অংশ মনের মতো করে সাজিয়ে নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। এর প্রতি আগ্রহ বেড়েছে সমসাময়িক কালে। সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে ছবি পোস্ট করা এখন নিত্যদিনের রুটিন। নতুন নতুন প্রফেশন তৈরি হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে। ডিজিটাল মেকআপ এসেছে এই ধারার হাত ধরেই। অতিমারির সময়টাতে নতুন প্রসাধন কিনে নেওয়া সম্ভব হয়নি অনেকের। নিত্যদিনের জীবনে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে করোনাভাইরাস। মেকআপও বাদ যায়নি সে তালিকা থেকে। সোশ্যাল মিডিয়া হ্যান্ডেলের প্রতি আগ্রহ ডিজিটাল মেকআপের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। নিজ অ্যাকাউন্টে নিয়মিত নজরকাড়া ছবি পোস্ট করার চাহিদায় ইমেজে ডিজিটাল মেকআপ ব্যবহার করে নতুন রূপ দেওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়েছেন ফ্যাশনিস্তারা।
ডিজিটাল মেকআপ কোনো প্রোডাক্ট নয়। ভার্চ্যুয়ালি এটি ব্যবহার করা হয়। প্রোডাক্টের বিপরীতে এখানে রয়েছে টুলস। মেকআপ টুলস ব্যবহারের মাধ্যমে ইমেজে ক্রিয়েটিভ বিউটি লুকস তৈরি করা যায়। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, মেকআপ করতে যেমন প্রচুর শিখতে হয়, হতে হয় পারদর্শী, এখানে তেমন কোনো ঝক্কি নেই। ইউজার-ফ্রেন্ডলি ডিজিটাল মেকআপ অ্যাপ রয়েছে বেশ কিছু। সেগুলো ব্যবহারের মাধ্যমে যে কেউ হয়ে উঠতে পারে প্রো-বিউটি এক্সপার্ট। ইউক্যামমেকআপ, ফেইসঅ্যাপ, ইনস্টাবিউটি, পারফেক্ট৩৬৫, আরবান, ফটো ওয়ান্ডার—এই ডিজিটাল মেকআপ অ্যাপগুলো বর্তমানে রয়েছে পছন্দের শীর্ষে।
ডিজিটাল মেকআপ জীবনযাপনের নতুন একটি ধারণা। এটি এসেই জয় করে নিয়েছে মেকআপে আগ্রহীদের মন। ইন্টারন্যাশনাল মেকআপ ব্র্যান্ডগুলোর অনলাইন সাইটে ডিজিটাল মেকআপের দারুণ ব্যবহার দেখা যাচ্ছে। তাদের প্রসাধন পণ্যগুলো ট্রায়াল করে দেখে নেওয়া যাচ্ছে এর মাধ্যমে। এ জন্য ঢুঁ মারতে হবে ব্র্যান্ডগুলোর ওয়েবসাইটে। ডিজিটাল মেকআপের অপশন থাকার কারণে সৌন্দর্য প্রসাধনের এই ব্র্যান্ডগুলো থেকে ক্রেতারা পণ্য কিনতে পারছেন নিরাপদে। জীবাণুযুক্ত টেস্টার ব্যবহারের অস্বস্তি দূর হয়েছে। একই সঙ্গে ঘরে বসে পছন্দের প্রসাধন চেহারায় কেমন দেখাবে, তা বাছাই করে নেওয়া যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এর চাহিদা বাড়ছে। ক্রেতারাও অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন।
ইনস্টাগ্রামে ডিজিটাল মেকআপ আর্টিস্ট ও মডেল হটিন অ্যান্ড্রেয়া ক্যাটেলিনার ফলোয়ার ২১ হাজারের বেশি। ডিজিটাল মেকআপ টুল ব্যবহার করে ইমেজ এডিট করে পোস্ট করেন তিনি। তার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, ডিজিটাল মেকআপ বেশ সময়সাপেক্ষ। এক ঘণ্টা সময়ে স্ক্রিনে যত ধরনের ম্যানুপুলেশন করা যায়, তা ত্বকে করতে চাওয়া হলে সময় লাগবে ৪-৫ ঘণ্টা। মিশেল ফানের ইউটিউব ভিডিওর নিয়মিত দর্শক ছিলেন তিনি। ছবিতে মেকআপ টুল নিয়ে খেলার আগ্রহ সেখান থেকে। তিনি মনে করেন, ডিজিটাল মেকআপের প্রধান আকর্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এর কোনো সীমা নেই। নেই সীমাবদ্ধতা। সাজতে বসে ভাবতে হবে না, বেশি হয়ে গেল নাকি কম। প্রসাধনের ব্যাকরণের নেই বারণ; বরং আছে স্বাধীনতা। নিজের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে সেজে বিশ্বের সামনে উপস্থাপন।
হটিনের কাছ থেকে ডিজিটাল মেকআপ টুল ব্যবহারের বেশ কিছু টিপস পাওয়া যায়। ডিজিটাল মাধ্যমে নিজেকে সাজিয়ে তোলার জন্য ছবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ রাখতে হবে বেজ মেকআপের দিকে। যে ছবিতে বেজ মেকআপ ভালো, বেছে নিতে হবে সেই ছবি। তারপর ফেইসের যতটুকু অংশ নিয়ে কাজ করা হবে, সেটুকু মার্ক করে নিতে হবে। হটিনের মতে পুরো ব্যাপারটায় সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ডিজিটাল মেকআপ ব্রাশ দিয়ে স্ট্রোক তৈরি করা। আর সবচেয়ে ভালো দিক, এই আধুনিক অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমের মেকআপ সহজে মুছে ফেলা যায়, আবার নতুন করে শুরু করা যায় সাজ। আইলাইনের তীক্ষ্ণ অথচ বক্র রেখা টানতে গিয়ে যদি হাসি কিংবা হাঁচি চলে আসে, তাতে বিব্রত হওয়ার ঝুঁকি নেই। একটু থেমে আবার শুরু যেমন করা যায়, তেমনি স্ট্রোক বেঁকে গেলে নতুন করে নিট করে নেওয়ার রয়েছে সুযোগ।
ডিজিটাল মেকআপের ক্ষেত্রে ইমেজের ডিটেইলিং নিয়ে কাজ হয় যেহেতু, তাই অনেক ক্ষেত্রে টেকনিক অ্যাপ্লাইয়ের সুযোগ রয়েছে। এখানে ফেইস রিপ্লেসমেন্ট থেকে শুরু করে স্পট ভ্যানিশিং, টোন লাইটেনিংয়ের পরে ক্যারেক্টার বিল্ডআপ যেমন করা যেতে পারে, তেমনি ফেইসের নির্দিষ্ট অংশ রাঙিয়ে তোলা সম্ভব। পোস্ট মেকআপ অ্যাপ্লাই করার মাধ্যমে পরিবর্তন নিয়ে আসা যায়। আইব্রাও করা যায় রিপ্লেস। আকারে নিয়ে আসা যায় পরিবর্তন। হেয়ার ডুতে সন্তুষ্ট না হলে সেখানেও উইগ ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।
‘ক্যাম্পেইন’-এর একটি ফিচার থেকে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ডিজিটাল মেকআপকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে। ১৬ থেকে ২২ বছর বয়সীদের মাঝে সাধারণত নিয়মিত ছবি পোস্ট করার প্রতি আগ্রহ বেশি। একই সঙ্গে মেকআপ ব্যবহারের প্রতি তাদের আগ্রহের মূল কারণ আকর্ষণীয় ছবি তুলে পোস্ট করা।
ডিজিটাল মেকআপ ক্রেতার বায়িং হ্যাবিটে পরিবর্তন নিয়ে আসছে। ওয়েবসাইটে ডিজিটাল মেকআপ প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রোডাক্ট টেস্টিংয়ের ব্যবস্থা থাকার কারণে ক্রেতা আর মেকআপ ব্র্যান্ডের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক হচ্ছে। ক্রেতারা এখন নিজের মতামত জানাচ্ছেন পছন্দের ব্র্যান্ডকে। ফলে তৈরি হচ্ছে কো-ক্রিয়েশনের সুযোগ। ল’রিয়েল ব্র্যান্ডের সিএমও স্টিফেন বিরুবি বলেন, ‘ব্র্যান্ডের চালকের আসনে বর্তমানে বসে আছেন ক্রেতা। কী চান—সেই সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নিচ্ছেন।’
ডিজিটাল মেকআপের নতুন ধারায় লাভবান হবে সেসব ব্র্যান্ড, যারা দ্রুত এই টেকনোলজিতে আসতে পারবে। ক্রেতারা এসব ব্র্যান্ডের মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করবেন ডিজিটাল মেকআপের মাধ্যমে। ‘সেলফ রেডি’ হয়ে প্রসাধন কেনার অভিজ্ঞতা আকর্ষণ করবে তরুণ ক্রেতাদের। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে মেকআপ ব্র্যান্ড ক্রেতার কেনাকাটায় প্রভাবিত করতে ইতিমধ্যেই সচেষ্ট। এর পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে বলে আশা করা যায়। ইতিমধ্যে এআই ব্যবহার করছে ল’রিয়েল। বিরুবি নিজের ব্র্যান্ডে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার প্রসঙ্গে বলেন, ‘ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি দারুণ কার্যকর। এর মাধ্যমে ব্যবসার প্রসার হয়।’
সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা সাধারণত তাদের ফলোয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সামাজিক যোগাযোগের হ্যান্ডেলগুলোর মাধ্যমে, নিয়মিত ছবি পোস্ট করে। তাদের মাঝেও দেখা যাচ্ছে ডিজিটাল মেকআপ ব্যবহারের রীতি।
জরিপ বলছে, প্রতিষ্ঠিত প্রসাধন ব্র্যান্ডগুলো ডিজিটাল মেকআপ ট্রেন্ডকে দূরে সরিয়ে না রেখে এতে আগ্রহী হয়ে উঠছে। যেমন এলিজাবেথ আরডেন আর ডিজিটাল মেকআপ অ্যাপ ইউক্যামের পার্টনারশিপের কথা এ ক্ষেত্রে বলতেই হয়। ইউক্যাম অ্যাপ ব্যবহার করে প্রোডাক্টের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন ক্রেতা। তারপরে কেনা যাবে এলিজাবেথ আরডেন ব্র্যান্ডের ওয়েবসাইট থেকে।
ডিজিটাল মেকআপ পরিবর্তন নিয়ে আসবে। মেকআপ ব্র্যান্ডগুলো তাদের ক্রেতাদের চাহিদা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে পারবে। এসব তথ্য ব্যবহারের মাধ্যমে প্রসাধন জগতে আসবে পরিবর্তন। ইতিবাচক পরিবর্তনের মাধ্যমে সৌন্দর্যবিশ্ব এবং ব্যবহারকারী উভয়েই উপকৃত হবেন বলে আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা।
ছবি: ইন্টারনেট