ত্বকতত্ত্ব I ডি-স্ট্রেস স্কিনকেয়ার
সৌন্দর্যচর্চাও হবে, সারবে মনের অবসাদও। সঠিক সমীকরণটা জানা চাই শুরুতেই
স্ট্রেস বা মানসিক চাপ। এর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব স্বাস্থ্যের গুরুতর পরিণতি ঘটাতে পারে। যার ছাপ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে মুখেও। এ ছাড়া সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি, পরিবেশদূষণ, অনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার মতো মানসিক চাপ বা উদ্বেগ ত্বকের অন্যতম প্রধান শত্রু। প্যানডেমিকের এই সময়টা খুব বেশি স্ট্রেসফুল। ফলাফল—ঘরে থেকেও ত্বকের নানা সমস্যায় ভোগান্তি।
বয়ঃসন্ধিকালে (১৪ থেকে ১৯ বছর) হরমোনের প্রভাবে কিশোর-কিশোরীদের ত্বকে ব্রণের সমস্যা দেখা দেয়। সাধারণত ২০ বছরের পর থেকে ব্রণ বা অ্যাকনের প্রবণতা কমতে থাকে। তবে পরিণত বয়সেও অনেকে এই সমস্যায় ভোগেন। ডার্মাটোলজিস্টরা একে ‘অ্যাডাল্ট অ্যাকনে’ বলেন। এর অন্যতম প্রধান কারণ স্ট্রেস। কেউ যখন অনেক বেশি উৎকণ্ঠা বা মানসিক চাপ অনুভব করেন, তখন তার শরীর কর্টিসল নামের একধরনের হরমোন তৈরি করে। এই কর্টিসল মস্তিষ্কের একটি অংশ যাকে হাইপোথ্যালামাস বলা হয়, সেখান থেকে কর্টিকোট্রফিন-রিলিজিং হরমোন (CRH) নামক হরমোন উৎপাদনে সহায়তা করে। অতিরিক্ত মানসিক চাপে এই সিআরএইচ ওভারড্রাইভে চলে যায়। এর ফলে চুলের ফলিকল ও লোমকূপের চারপাশে সেবেশিয়াস গ্রন্থি অতিরিক্ত তেল নির্গত করে। অত্যধিক তেল লোমকূপ বন্ধ করে, ব্রণের প্রকোপ বাড়িয়ে দেয়।
ত্বকের শুষ্কতার জন্যও স্ট্রেসের দায় কম নয়। স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম হলো ত্বকের একদম ওপরের স্তর। এটিতে প্রোটিন ও লিপিড রয়েছে, যা ত্বকের কোষগুলোকে হাইড্রেটেড রাখতে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এটি একটি দেয়াল হিসেবে ত্বকের নিচের স্তরকে রক্ষা করে। যখন স্ট্র্যাটাম কর্নিয়াম ঠিকমতো কাজ করে না, ত্বক তখন শুষ্ক হয়ে যায়। ২০১৪ সালে ইনফ্ল্যামেশন অ্যান্ড অ্যালার্জি ড্রাগ টার্গেটসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত স্ট্রেস এই স্ট্র্যাটাম কর্নিয়ামের কার্যকারিতায় ব্যাঘাত ঘটায়। আর এভাবে ত্বকের স্বাভাবিক পানি ধারণে পড়ে নেতিবাচক প্রভাব। ফলে ত্বক দ্রুত শুষ্ক হতে থাকে।
মানসিক চাপে শরীরে অ্যাড্রেনালাইন ও কর্টিসল হরমোন বেড়ে যায়। এই দুটি হরমোনই ঘামগ্রন্থিকে সক্রিয় করে এবং শরীর দ্রুত ত্বকের মাধ্যমে পানি হারায়। আবার ত্বকে যে প্রাকৃতিক হায়ালুরনিক অ্যাসিড রয়েছে, তার পানি ধরে রাখার কাজে হস্তক্ষেপ করে কর্টিসল।
মানসিক চাপ শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। ইমিউন সিস্টেমের এই দুর্বলতা অন্ত্র ও ত্বকের ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে, যা ডিসবায়োসিস নামে পরিচিত। ত্বকে ভারসাম্যহীনতা ঘটলে দেখা দেয় রেডনেস ও র্যাশ। যদি কারও আগে থেকে সোরাইসিস, একজিমা, কন্টাক্ট ডার্মাটাইটিসের মতো সমস্যা থাকে, তাহলে স্ট্রেসের ফলে সেগুলো আরও বেশি বেড়ে যায়।
ইদানীং অল্প বয়সেই অনেকের ত্বকে বয়সের ছাপ পড়তে দেখা যায়। এর জন্য অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগকে দায়ী করা যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, স্ট্রেসের কারণে ত্বকের প্রোটিন ও লিপিড লেয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এতে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়। এমন হলে ত্বকের ইলাস্টিসিটি কমতে থাকে। ইলাস্টিসিটি কমার চূড়ান্ত ফল হলো ফাইন লাইনস ও রিংকেল। স্ট্রেসের কারণে চোখের নিচে আইব্যাগ ও ডার্ক সার্কেলও দেখা দেয়।
এ থেকেই বোঝা যায়, ত্বকের সুরক্ষায় মানসিকভাবে চাপমুক্ত থাকা কতটা জরুরি। এই সমস্যাগুলো প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য প্রথমে মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। থাকতে হবে উদ্বেগ ও চাপমুক্ত। বেশ কিছু স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট টেকনিক রয়েছে; যেমন মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, ভিজ্যুয়াল ইমাজেরি ইত্যাদি। এগুলো আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খুব ভালো প্রভাব ফেলে স্ট্রেস রিলিফে সহায়তা করে; পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চা, দৈনিক আট ঘণ্টা ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক উদ্বেগ ও চাপ কমাতে পারে। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টায় নিজের জন্য কম করে হলেও ৩০ মিনিট সময় রাখতে হবে। এই সময়টা নিজে উপভোগ করা যায়, এমন কিছু করে কাটাতে হবে। এত কিছু করার পরও যদি কাজ না হয়, তাহলে প্রয়োজনে প্রফেশনাল থেরাপিস্টের সহায়তা নিতে এতটুকু দ্বিধা করবেন না। এরপরই নজর দিতে হবে ত্বকের যত্নের প্রতি। স্ট্রেসের সময় স্কিনকেয়ার করলে ‘এক ঢিলে দুই পাখি মারা’ হবে! কারণ, বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, মন চাপমুক্ত রাখতে স্কিনকেয়ার রুটিন ভালো ভূমিকা রাখে।
কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, চাপমুক্ত থাকতে স্কিনকেয়ার রুটিন বেশ কার্যকর। বিখ্যাত স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ড রোডান+ফিল্ডস পরিচালিত ওই গবেষণায় ১৮ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ৩০ নারী অংশগ্রহণ করেন। এদের সবাই মানসিক চাপজনিত অ্যাডাল্ট অ্যাকনের সমস্যায় ভুগছিলেন। আট সপ্তাহব্যাপী চলা গবেষণায় দেখা গেছে, তিন ধাপের মিনিমাল স্কিনকেয়ার রুটিন মেনে চলায় স্ট্রেসের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে অ্যাকনের সমস্যাও কমেছে। ত্বকের যত্নে এরা সবাই অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, প্রিবায়োটিকস, ইলেকট্রোলাইটস সমৃদ্ধ প্রোডাক্টের পাশাপাশি দিনে দুবার সানস্ক্রিন ব্যবহার করেছিলেন। ফলে তাদের স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল নিঃসরণের পরিমাণ ৮৩ শতাংশ কমে যায়।
তিন ধাপের স্কিনকেয়ার রুটিনটি কিন্তু খুবই বেসিক—ডাবল ক্লিনজিং, ট্রিটমেন্ট ও ময়শ্চারাইজিং বা হাইড্রেটিং। এর চেয়ে বেশি কিছু না করলেও চলে। তবে প্রতিদিন পাঁচ মিনিটের ফেশিয়াল ম্যাসাজ করা যেতে পারে। এ ধরনের ম্যাসাজ ত্বক ও মন—দুয়ের জন্যই ভালো। এক্সট্রা কেয়ারের জন্য সপ্তাহে তিন দিন রিলাক্সিং ফেস মাস্ক ব্যবহার করা যেতে পারে। আর সপ্তাহে এক দিন গ্লাইকোলিক বা ম্যান্ডেলিক অ্যাসিডের মতো কেমিক্যাল এক্সফোলিয়েটর দিয়ে এক্সফোলিয়েট করতে হবে। এ ধরনের এক্সফোলিয়েশন অ্যাকনে ও ইনফ্ল্যামেশনযুক্ত ত্বকের জন্য খুব উপকারী।
স্কিনকেয়ার রুটিনের এই স্ট্রেস রিলিফের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে এখন নামিদামি ও ইন্ডি স্কিনকেয়ার ব্র্যান্ডগুলো ঝুঁকেছে অ্যাডাপ্টোজেনিক প্রোডাক্ট তৈরিতে। অ্যাডাপ্টোজেন হচ্ছে এমন ভেষজ উপাদান, যা শরীর থেকে স্ট্রেসের বিষাক্ত প্রভাব কমিয়ে থাকে। এখনকার ডি-স্ট্রেসিং স্কিনকেয়ার প্রোডাক্টগুলোতে যে অ্যাডাপ্টোজেন ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো স্ট্রেসও কমায়, আবার ত্বকের জন্যও বিশেষ উপকারী। উদাহরণ হিসেবে লিকারিশ বা যষ্টিমধুর কথা ধরা যাক। এটি কর্টিসল নিঃসরণের গতি কমায়, আবার ত্বকের ইনফ্ল্যামেশন ও র্যাশও কমিয়ে থাকে। ইলিউথিরো বা সাইবেরিয়ান জিনসেং ত্বকে ফ্রি র্যাডিক্যালের কারণে হওয়া ক্ষতির পরিমাণ কমায়। ফলে ত্বকে সহজে বয়সের ছাপ পড়ে না। এগুলো ছাড়া আরও অ্যাডাপ্টোজেন আছে, যা ত্বকের অনেক সমস্যা সমাধানে কার্যকর। যেমন আমলা, গোজি বেরি, অশ্বগন্ধা, হোলি বেসিল বা তুলসী, চাগা, রেইশি মাশরুম, ল্যাভেন্ডার, ক্যামোমাইল, রোজ অব জেরিকো, টি ট্রি অয়েল, আর্নিকা, মাকা, ত্রিফলা, শিলাজিৎ, ক্যালেন্ডুলা, সেনটেলা এশিয়াটিকা ইত্যাদি।
ফাহমিদা শিকদার
মডেল: মাইশা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: তানভীর খান