টেকসহি I সমুদ্রে অভয়ারণ্য
এমপিএ। জলজ প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের আধুনিকতম ধারণা। কতটা কার্যকর বাংলাদেশে?
২০১৪ সালের শেষ ভাগে বাংলাদেশে প্রথম মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া (এমপিএ) বা সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে নাম আসে ‘নাই বাম’ এলাকার। দুবলার চর থেকে আরও ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৩৮ বর্গকিলোমিটার এই এলাকার পোশাকি নাম সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। এমপিএ হিসেবে আরেকটি নাম আসতে অবশ্য বেশ সময় লেগে যায়। ২০১৯ সালে নিঝুম দ্বীপ ও সংলগ্ন ৩ হাজার ১৮৮ বর্গকিলোমিটার জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠে দ্বিতীয় সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা। আর চলতি বছরের শুরুতে নারিকেল জিঞ্জিরা দ্বীপসংলগ্ন ১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাকে ঘোষণা করা হয় দেশের তৃতীয় এমপিএ হিসেবে। এ তালিকায় নাম ওঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে উপকূলীয় আরও বেশ কয়েকটি এলাকা।
জলজ প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য এমপিএ ঘোষণা এখনকার আধুনিকতম ধারণা। নাগোয়া প্রটোকলে স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশকে দেশের মোট এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন (ইইজেড) বা একচ্ছত্র অর্থনৈতিক আধিপত্যের সমুদ্রসীমার অন্তত ১০ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষণ করতে হবে, যেখান থেকে কোনো ধরনের সম্পদ আহরণ করা যাবে না, মাছ ধরা যাবে না। এলাকাগুলো ব্যবহার করতে হবে জলজ প্রাণীদের অভয়ারণ্য হিসেবে। বাংলাদেশ যখন নাগোয়া প্রটোকলে স্বাক্ষর করেছিল, তখন মোট সমুদ্রসীমা ছিল ৬০ হাজার বর্গকিলোমিটার। তবে পরবর্তীকালে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা পুনর্নির্ধারণের পর তা ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারে পরিণত হয়। এর ফলে বাংলাদেশের ইইজেডের পরিমাণ ২০০ নটিক্যাল মাইল থেকে বেড়ে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইলে দাঁড়ায়। এই নতুন বর্ধিত ইইজেড পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য আর অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের ইইজেড অংশে এখন পর্যন্ত ৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক সরীসৃপ, ১১ প্রজাতির সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী, ২০ প্রজাতির পাখি, ৩০ প্রজাতির কাঁকড়া (মিঠাপানির ও সামুদ্রিক মিলিয়ে), চার প্রজাতির লবস্টার, ৩৩ প্রজাতির চিংড়ি, ৪৩৭ প্রজাতির মিশ্রপানির ও সামুদ্রিক শামুক ও ঝিনুক এবং ১৬৫ প্রজাতির সামুদ্রিক শেওলা পাওয়া গেছে। ভবিষ্যতের ব্লু ইকোনমিতে পদার্পণ করতে হলে মোট ইইজেডের অন্তত ১০ শতাংশ সংরক্ষণ করতেই হবে বাংলাদেশকে।
২০১৫ সালের ‘ন্যাশনাল ফ্রেমওয়ার্ক ফর এস্টাবলিশিং অ্যান্ড ম্যানেজিং মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়াস ইন বাংলাদেশ’ নামের আইইউসিএনের এক প্রকাশনা থেকে জানা যায়, উপকূলজুড়ে মোট ৬৭টি ভিন্ন ভিন্ন স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল সম্ভাব্য এমপিএ সাইট হিসেবে। এর ভেতর ১৪টিকে দ্রুত এবং বাকিগুলোকে পর্যায়ক্রমে এমপিএ হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু জনবহুল দেশ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং একটি নির্দিষ্ট স্থানে একাধিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণের কারণে এ পর্যন্ত কেবল তিনটি সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা পেয়েছে বাংলাদেশ। অপেক্ষায় রয়েছে নিঝুম দ্বীপের ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ থেকে শুরু হওয়া ডুবোচর ও সংলগ্ন এলাকা, ক্যারিং চর; কক্সবাজার এলাকার শাহপরীর দ্বীপ, বাংলা চ্যানেল, নাফ নদীর মোহনা, বাকখালী মোহনা, সোনাদিয়া দ্বীপ, ঘটিভাঙ্গা; বাগেরহাটের সুন্দরবনের নদী ও বঙ্গোপসাগরের অংশবিশেষ; সাতক্ষীরার সুন্দরবনের নদী ও বঙ্গোপসাগরের অংশবিশেষ এবং বৃহত্তর খুলনার সুন্দরবনের নদী ও বঙ্গোপসাগরের অংশবিশেষ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ দিকের যে সুবিস্তৃত উপসাগর রয়েছে, তা পৃথিবীর ৬৪টি বৃহৎ সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে অন্যতম। বঙ্গোপসাগরের পানি লাগা আটটি দেশের প্রায় ৪০০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি এই উপসাগরের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে উপকূলীয় এলাকাগুলো দুর্যোগপ্রবণ, আর আয়বৈষম্যে নিচের দিকে থাকা মানুষে পূর্ণ; কিন্তু তাদের হাতের নাগালেই রয়েছে সামুদ্রিক ও বাদাবনগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকাগুলোয় লবণাক্ততা বেশি থাকায় যেমন ফসল হয় কম (এক মৌসুম), একই সঙ্গে সেখানে ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যাও অনেক বেশি। ফলে স্বভাবতই প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মাছের ওপরেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়। এতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জলজ সম্পদ আহরিত হচ্ছে। তবে সেটা অ-টেকসই উপায়ে। ফলে দিন দিন কমে আসছে মাছের জোগানও। এ ছাড়া বাংলাদেশ মাছ আহরণ করে ছোট মেশিন বসানো ট্রলারে, বড়জোর ৪০ মিটার গভীরতায় গিয়ে। গভীর সমুদ্রে গিয়ে মাছ সংগ্রহ করার মতো জাহাজ রয়েছে হাতে গোনা। এ ছাড়া ধ্বংসাত্মক বটম ট্রলিং পদ্ধতিতে মাছ সংগ্রহ করার কারণে সমুদ্র ও মোহনার তলদেশের বাস্তুতন্ত্রও বিঘ্নিত হয় মারাত্মকভাবে। অপ্রয়োজনীয় মাছ এবং অন্যান্য প্রাণীও ধরা পড়ে।
তা ছাড়া বিশ্বজুড়ে সামুদ্রিক মাছ মূল প্রোটিনের উৎস বিবেচিত হলেও বাংলাদেশে মিঠাপানির মাছেরই প্রাধান্য। তবে বাড়তি জনসংখ্যার চাপে জলদিই সামুদ্রিক উৎসগুলো থেকেও প্রয়োজন পড়বে ব্যাপক হারে প্রোটিন সংগ্রহ করার। এ জন্য আমাদের যে নলেজ গ্যাপ রয়েছে সমুদ্র নিয়ে, সেটাও কমিয়ে আনা দরকার। সেই লক্ষ্যে আইইউসিএন বাংলাদেশে এমপিএ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে আসছে ১০ বছরের বেশি সময় ধরে। যার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় দুটো সামুদ্রিক সংরক্ষিত এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এমপিএ এমন এলাকা, যেখানে অন্য সব সংরক্ষিত এলাকার মতোই মানুষের কর্মকাণ্ড সীমিত থাকবে প্রাকৃতিক পরিবেশ, আশপাশের জলময় এলাকার বাস্তুতন্ত্র আর যদি সেখানে সাংস্কৃতিক বা ঐতিহাসিক উপাদান থাকে, সেসব সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে। সাধারণত সামুদ্রিক সম্পদ স্থানীয়, রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিকভাবে কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সংরক্ষিত হয়ে থাকে। আর এ কারণে যেকোনো ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করতে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। বিশ্বজুড়েই জেলেরা সামুদ্রিক সম্পদ রক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা দেখালেও তারা তাদের প্রফিট মার্জিনকে কমে আসতে দেখলে প্রতিবাদ করেন। বাংলাদেশের জেলেরা সংরক্ষিত এলাকার কথা শুনলেই বিরোধিতা করতে থাকেন। এটা মূলত এমপিএ সম্পর্কে তাদের সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাবেই ঘটে থাকে। তবে এর সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে পাবলিক ও কমিউনিটি রিসোর্সের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের বিরূপ মনোভাব। ব্যবহারের সময় তারা একে সবার অধিকার বলে মনে করেন। কিন্তু যখন সংরক্ষণের প্রশ্ন ওঠে, সেটা আর কেউই গুরুত্ব দেন না!
বর্তমানে বাংলাদেশের ইইজেডের পরিমাণ দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৭০ শতাংশ। আর এখান থেকে সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্যই এমপিএ জরুরি। সে কারণে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পৃক্ত হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ নেভি ও কোস্ট গার্ড; বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন একযোগে কাজ করছে। অবশ্য এতে প্রতিবন্ধকতাও সামনে চলে এসেছে। যেমন বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বরাবরই প্রাকৃতিক সম্পদকে অর্থনৈতিক মূল্যে বিচার করে এসেছে, ফলে বাস্তুতন্ত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের মূল্য হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে। আর সাধারণত বাংলাদেশ সরকার সংরক্ষিত এলাকা ব্যবস্থাপনায় একটি প্রতিষ্ঠানকেই পুরো দায়িত্ব দিতে চায়। এতে সেই প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়; সার্বিকভাবে ওই এলাকার উন্নয়ন হয় না। পাশাপাশি আইনের প্রয়োগেরও অভাব দেখা যায়। অবশ্য এমপিএ ফ্রেমওয়ার্ক তৈরির সময়ে নতুন করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংরক্ষণ নীতি একীভূত করে ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি সংরক্ষিত এলাকার ব্যবস্থাপনায় বহুমুখী উপযোগিতার ব্যাপারও মাথায় রাখা হয়েছিল। স্থানীয় মানুষদের যুক্ত করা হয়েছিল প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে। তবে এখনো সরকারের যথেষ্ট জনবল নেই সামুদ্রিক আইনগুলো প্রয়োগ করার জন্য। সেই সঙ্গে দক্ষতা, প্রশিক্ষণ ও সক্ষমতারও ঘাটতি রয়েছে দেশের সমস্ত সংরক্ষিত এলাকার সঠিক ব্যবস্থাপনায়। তা ছাড়া দেশে যেহেতু এমপিএ ধারণাটাই বেশ নতুন, তাই এটি কতটা কার্যকর হবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট