ফিচার I প্লাস ফ্যাশন
বাজার ১৭৮ বিলিয়ন ডলারের। পোশাকের পাশাপাশি চাহিদা বেড়েছে এই ইনক্লুসিভ লাইন পরিধানকারী মডেলদেরও। শুধু হাইস্ট্রিট নয়, হাইএন্ড ব্র্যান্ডগুলোর প্রডাক্ট লাইনেও প্রাধান্য পাচ্ছে বিশেষ এ ক্যাটাগরির ওয়্যারড্রোব স্টেপল থেকে সুইমওয়্যার। লিখেছেন সারাহ্ দীনা
শারীরিক গঠনভেদে স্বতন্ত্রতা স্বাভাবিক। তা অনুধাবনের পর থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনাররা ক্রেতাদের চাহিদা বুঝে তৈরি শুরু করেন ‘প্লাস সাইজ’ ফ্যাশন লাইন। বডি পজিটিভিটি এ ক্ষেত্রে রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সব দেহের আকারই সুন্দর, আনকোরা। ব্যাপারটা ইতিবাচক রূপ নিতেই ফ্যাশনে দেখা যায় নতুন মোড়। আলোচনায় উঠে আসে প্লাস সাইজ ফ্যাশন। ১৯২০ সালে প্রথম প্লাস সাইজ নিয়ে কাজ শুরু করে ব্র্যান্ড লেন ব্রায়েন্ট। ৩৮ থেকে ৫৮ ইঞ্চির বাস্টের জন্য পোশাক তৈরি করে বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়। এর পরপরই ফ্যাশনের এ ক্যাটাগরি নিয়ে ভাবতে শুরু করে অনেক ব্র্যান্ড। বর্তমানে এর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে।
প্লাস সাইজের আগে এসেছে ওভারসাইজড ধারা। নিজের মাপের চেয়ে বড় সাইজের পোশাকের এই ফ্যাশনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় বিংশ শতাব্দীতে। সে সময়ে মার্কিন ও কানাডিয়ান ভোটাধিকার আন্দোলন সফল হয়। নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার মূল্যায়নের চর্চা সেখান থেকে পায় গতি। ব্যবসা ও চাকরিতে যোগ দিতে শুরু করেন নারীরা। বিশ্ব তাদের কীভাবে দেখতে চায়, তার চেয়ে নিজেকে কীভাবে নারী প্রকাশ করতে চান, তা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ড শ্যানেল একটি বাজার গবেষণা করে। সেখানে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে নিরীক্ষামূলক বাজারজাত করে দুটি ডিজাইনের পোশাক—একটি ফ্রক, অন্যটি সোয়েটার। তথাকথিত সাইজের বাইরে এই পোশাক দুটি শোকেস হয়। জনপ্রিয়তা পায় আশাতীত। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীদের তখন নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক কেনাকাটায় সাহস জোগায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল নিজের দেহকে অন্যের সঙ্গে তুলনা না করে নিজস্বতায় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠা। বডি পজিটিভিটি প্লাস সাইজ ফ্যাশনের ধারণাকে উৎসাহিত করেছে, এমনটা বলা যেতে পারে।
ফাইবার টু ফ্যাশন ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, গত ২০ বছরে মানবদেহের আকৃতিতে একটি পরিবর্তন দেখা গেছে। বর্তমানে যারা ৪০ ও ৫০ এ পা দিচ্ছেন, তাদের ৬০ শতাংশ প্লাস সাইজ দেহের অধিকারী। এই দলভুক্তদের চাহিদার দিকে লক্ষ রাখছে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো। ফাইবার টু ফ্যাশনের আর্টিকেলে বাজার গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালে নারী দেহের বাস্ট সাইজের গড় ছিল ৩৪ বি, ২৪ ইঞ্চি ওয়েস্ট এবং ৩৩ ইঞ্চি হিপস, যা বর্তমানে দাঁড়িয়েছে বাস্ট ৩৬ সি, ২৮ ইঞ্চি ওয়েস্ট এবং ৩৮ ইঞ্চি হিপস। তা ছাড়া বিশ্ব ফ্যাশন বাজারে এখন ৩০% নারী প্লাস সাইজ পোশাক ক্রয় করেন। এ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বেশি।
গ্লোবাল ফ্যাশনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও। ব্র্যান্ডগুলো অল্প পরিসরে কাজ করছে প্লাস সাইজ নিয়ে। ডেডিকেটেড প্লাস সাইজ ব্র্যান্ড রয়েছে, তবে হাতেগোণা। তবে দিন দিন দেশের বাজারেও প্লাস সাইজ লাইনের কাজের পরিমাণ বাড়বে বলে ধারণা বাজার বিশ্লেষকদের। প্লাস সাইজ ফ্যাশনকে কেন্দ্র করে সেভাবে বাজার তৈরি হয়নি এখনো। তবে দেশি ব্র্যান্ডগুলোর বেশির ভাগে চেস্ট সাইজ ৪৮ অবধি পোশাক পাওয়া যায়। এর বাইরে দেশি প্লাস সাইজ পোশাকের জন্য রেডিমেড ব্র্যান্ডের ওপর নির্ভর করতে পারার মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি।
প্লাস সাইজ ফ্যাশনকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ ব্র্যান্ড পৌষী। বডি পজিটিভিটির বিষয়ে সচেতন থেকে নকশা করা হয় এ লাইনের পোশাকগুলো। পৌষীর উদ্যোক্তা মাহিয়া নিনান পৌষী বলেন, ‘দেশীয় ক্রেতাদের একটি বড় অংশের মাঝে প্লাস সাইজ পোশাকের চাহিদা রয়েছে। গঠনগতভাবে এ দেশের মানুষের গড়ন মাঝারি। তাই আন্তর্জাতিক ফিগারের হিসেবে পোশাক তৈরি করা হলে আরামদায়ক হয় না। ডিজাইনিং এবং ফিগার সাইজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে আমাদের অঞ্চলের মেয়েদের উপযোগী পোশাক নকশা করি। আমার ব্র্যান্ডের পোশাক পরে ট্যুর থেকে পার্টি—সব ক্ষেত্রেই যেন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ক্রেতারা নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন, সে চেষ্টা থাকে প্রতিটি পোশাক নকশা করার ক্ষেত্রে।’ তিনি আরও জানান, পৌষীর পোশাকের দাম ২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে শুরু। ক্রেতারা যেন সুলভে ডিজাইনার ওয়্যার কিনতে পারেন, তা মাথায় রেখেই সচেতনভাবে মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সাইজ বাড়ার সঙ্গে এই ব্র্যান্ডের পোশাকের দাম বাড়ানো হয় না। পৌষীতে ৬০ সাইজ পর্যন্ত পোশাক পাওয়া যায়। তৈরি করা হয় সব দেহের উপযোগী করেই।
ফ্যাশন ব্র্যান্ড কিউরিয়াস যাত্রার শুরু থেকেই প্লাস সাইজ পোশাকের বিশেষ লাইন শুরু করেছে। ১২৫০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে এই ব্র্যান্ডের প্লাস সাইজ পোশাক পাওয়া যায়। ব্র্যান্ডটির হেড অব ডিজাইন বিপ্লব বিপ্রদাস বলেন, ‘কিউরিয়াস ব্র্যান্ডের রেগুলার লাইনগুলোর একটি প্লাস সাইজ ফ্যাশন। শুরু থেকেই ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। এই লাইনে নিয়মিত নতুন ডিজাইনের পোশাক নিয়ে আসি।’
এদিকে বাংলাদেশি ব্রাইডাল ওয়্যার ব্র্যান্ড সাফিয়ার স্বত্বাধিকারী সাফিয়া সাথী বলেন, ‘বিয়ের কনের পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে কনের দৈহিক গড়নকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে থাকি। প্লাস সাইজের কনের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়। এ ক্ষেত্রে সচেতন থাকি রং, ফ্যাব্রিক ও অলংকরণ নির্ধারণের ক্ষেত্রে। চেষ্টা করি পোশাক যেন কনেকে স্বস্তি দেয়। এ ছাড়া ভারী পোশাকের কারণে কনের শরীরে বাড়তি ইঞ্চি যোগ হয়েছে, এমন যেন মনে না হয়।’
প্লাস সাইজ পোশাক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা চাই—
নিজেকে শুধু সুন্দর করে উপস্থাপনের উদ্দেশ্য নিয়ে পোশাক পরিধান মূল উদ্দেশ্য নয়। আরামকে দিতে হবে প্রাধান্য। নিজেকে ভালোবাসতে হবে। এরপরে পছন্দের ব্র্যান্ড থেকে প্লাস সাইজ পোশাক বেছে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়ে দেখে নিতে হবে পোশাকের ফ্যাব্রিক, রং, প্রিন্ট, অলংকরণ ও প্যাটার্ন। প্লাস সাইজের পোশাক বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গোল্ডেন রুল মেনে চলা যেতে পারে—‘সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি এড়িয়ে চলা আবশ্যক’। অতিরঞ্জনে প্লাস সাইজ পোশাকের কার্যকারিতা হারিয়ে যেতে পারে; বরং সংযম আর রুচির সমন্বয়ে তৈরি পোশাকই জুতসই। অলংকরণে হতে হবে লিরিক্যাল।
প্লাস সাইজ পোশাক কেনার ক্ষেত্রে নিজের দেহের আকারের আদ্যোপান্ত জানা থাকা চাই। দেহের গঠনের সঙ্গে কোনোভাবেই সমঝোতা নয়! ওভারসাইজড পোশাকে বিগ নো। ব্যাগি স্টাইল এবং ভলিউম—এই দুইও সরিয়ে রাখা ভালো। নিজের দেহের সঙ্গে ঠিকভাবে ফিট হয় এমন পোশাক বেছে নিতে হবে। আঁটসাঁট না, আবার ঢিলেঢালাও না! মেজারমেন্টের ব্যাপারেও থাকতে হবে আপটুডেট।
রং বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে উজ্জ্বল শেডে ভরসা রাখা যায়। তবে কোনোভাবেই এমন শেড নয়, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করবে। পোশাকের ফ্যাব্রিকে প্রিন্ট থাকলে বড় মোটিফ এড়িয়ে চলা মঙ্গল। লাউড স্ট্রাইপ এবং অ্যানিমেল প্রিন্টও রাখতে হবে তালিকার বাইরে। পোশাকজুড়ে বড় বড় প্রিন্টে প্লাস সাইজ পোশাক নয়; বরং পুরোটাজুড়ে থাকতে পারে ছোট ছোট প্রিন্ট।
প্লাস সাইজ পোশাকে দেহের নিজস্বতা উপভোগের সুযোগ থাকতে হবে। একই সঙ্গে থাকতে হবে দেহের গঠনের চেয়ে অতিরিক্ত মেদযুক্ত অংশ সুন্দরভাবে ঢেকে রাখার সক্ষমতা। নয়তো উপযোগিতা হারাবে পোশাকটি।
প্রতিটি রঙেরই রয়েছে নিজস্বতা। পোশাকে রং তাই শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। প্লাস সাইজ পোশাকের ক্ষেত্রে গাঢ় এবং মিউটেড শেড বেশি কার্যকর। ওয়াইন, এমারেল্ড, অ্যাকুয়া মেরিন, মাস্টারড, অলিভ, টেরাকোটা, স্যান্ড, বেইজ, পাউডারি ব্রাউন, গ্রে, সবুজ আর নীল—এই রংগুলোতে প্লাস সাইজ পোশাক বেশি ভালো দেখায়। প্যাস্টেলের সঙ্গে সাদার মিশেল দারুণ দেখাবে। ডার্ক শেডের অতিরঞ্জন এ ধরনের পোশাকের ক্ষেত্রে সেভাবে মানানসই নয়। তাই প্লাস সাইজ পোশাক নকশার ক্ষেত্রে এই শেডগুলো এড়ানো যেতে পারে।
প্লাস সাইজ পোশাকের হাজার রকমফের। এগুলোর মধ্য থেকে স্কার্ট, স্যুট, ব্লাউজ, টপ, শার্ট, টি-শার্ট, প্যান্ট, জাম্প স্যুট, কোট, ট্রেঞ্চ কোট সংগ্রহে থাকতে পারে। শার্ট কাটিং প্লাস সাইজ টপ, অ্যাসিমেট্রিক্যাল প্যাটার্ন, এ লাইন এবং জ্যাকেট ড্রেস প্লাস ফ্যাশনে ইন ট্রেন্ড। হাতের বাড়তি মেদে মনোযোগ কম যাবে বলে প্লাস সাইজ পোশাকে স্লিভ থাকলে ভালো। স্লিভের আকার বড় কিংবা দীর্ঘ হওয়া আবশ্যক নয়। কিন্তু এই অংশের উপস্থিতি প্লাস সাইজ পোশাকের উপযোগিতা বাড়ায়।
প্লাস সাইজের ফ্যাব্রিক বেছে নিতে হবে বাড়তি মনোযোগের সঙ্গে। লিনেন, কটন, ডেনিম, টুইড, স্যাটিন, সিল্ক ব্যবহারে প্লাস সাইজ পোশাক একই সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন ও আরামদায়ক হয়। কারণ, এই ফ্যাব্রিকগুলো পোশাকের নকশা অনুযায়ী দেহের সঙ্গে সুন্দর খাপ খেয়ে যায়।
পোশাক যদি প্রিন্টেড ফ্যাব্রিকে তৈরি হয়, তাহলে জ্যামিতিক নকশা, অ্যাসিমেট্রিক স্ট্রাইপ, পোলকা ডট এবং ফ্লোরাল প্রিন্ট প্লাস সাইজের পোশাককে দৃষ্টিনন্দন করে তুলবে। ছোট প্যাটার্নের প্রিন্ট বেছে নেওয়া যায় এ ধরনের পোশাকের ক্ষেত্রে।
প্লাস সাইজ বটমের ক্ষেত্রে হাই ওয়েস্ট, অল্প ক্রপড বটম—এই ডিজাইনগুলো বেছে নেওয়া যায়। প্লাস সাইজ বটমে ডেনিম ট্রাউজার একটি মাস্ট হ্যাভ আইটেম। এ ক্ষেত্রে সামনের অংশে বাটন আছে এমন ডিজাইন বেছে নিলে সুন্দরভাবে দেহের সঙ্গে সেট হয়ে যাবে। একদম স্ট্রেইট কাটের বদলে ফ্রেইড, স্লিট কাটে আকর্ষণীয় দেখাবে। কালারে লাইট শেড রাখা যেতে পারে। পেয়ার আপ করা যেতে পারে, টি-শার্ট আর টপস ব্যবহার করে।
বটমে স্কার্ট নিতে চাইলে নি লেন্থ স্কার্ট, পেনসিল, এ লাইন কিংবা অ্যাসিমেট্রিক কাট থেকে তা মনমতো বেছে নেওয়া যেতে পারে। স্কার্টের এই ডিজাইনগুলো প্লাস সাইজের জন্য উপযোগী।
প্লাস সাইজ ফ্যাশনের অন্যতম আকর্ষণ হলো স্যুট। এখানে প্যান্ট আর কোটের পেয়ার আপ হবে। প্যান্টের ক্ষেত্রে হাই ওয়েস্ট ডিজাইন বেছে নেওয়া যায়, যার দৈর্ঘ্য হবে গোড়ালি অবধি। কোটের ইনার হিসেবে পরতে হবে টি-শার্ট।
প্লাস সাইজে লেয়ারিং বেশ জনপ্রিয়। লেয়ারিং আইটেম হিসেবে ব্লেজার জনপ্রিয়। বটমে যেকোনো ধরনের ট্রাউজারের সঙ্গে ব্লেজার পরে নেওয়া যায় অনায়াসে। এ ক্ষেত্রে ব্লেজার লেয়ার করে থাকবে টি-শার্ট, ট্যাং টপকে।
মডেল: সাবরিন, রিফা, মায়শা ও নাতাশা
ওয়্যারড্রোব: পৌষী
ছবি: তানভীর খান
কৃতজ্ঞতা: মাহিয়া নিনান পৌষী