ফিচার I খিচুড়িতে বাউলিয়ানা
বাউলিয়ানার সঙ্গে খিচুড়ির কী সম্পর্ক? বৃষ্টির সঙ্গেই-বা কী?
বৃষ্টি এলেই খিচুড়ি খাওয়ার ধুম। কেন এমন হয়? এর প্রচলন হয়েছিল কবে? এসব প্রশ্নের বেশ কয়েকটি উত্তর চলে আসে। প্রথমটি হচ্ছে বাউলিয়ানা। এর সঙ্গে বৃষ্টির দিনে খিচুড়ি খাওয়ার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। সাধারণত বাউলেরা ঘুরে ঘুরে গৃহস্থদের কাছ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা পেতেন চাল ও ডাল। এই দুই পদের মিশেলে খিচুড়ি তৈরি করে খেতেন তারা। দুটি কারণে প্রাপ্ত খাদ্যদানা দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করতেন বাউলেরা। প্রথমটি হলো, সরল জীবনযাপনের জন্য তারা সময়সাপেক্ষ রসনায় অভ্যস্ত হতেন না। ঝামেলা এড়াতে চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি রান্না করে খেতেন। আরেকটি বিষয় হলো, তাদের রসুইঘর ছিল অস্থায়ী কিংবা কাঁচা। বসতঘর থেকে দূরে থাকার কারণে বর্ষণমুখর দিনে ওসব রান্নাঘর দীর্ঘক্ষণ ব্যবহার করার উপায় ছিল না। তাই ডালে-চালে মিশিয়ে তড়িঘড়ি করে খিচুড়ি রান্না করে খেয়ে দিন পার করে দিতেন বাউলেরা। একই কারণে গ্রামবাংলার অন্যান্য গৃহস্থ বর্ষায় খিচুড়ি রান্না করে খেতেন। কেননা, ভারী বর্ষণে অনেক সময় তাদের চুলা ভিজে যেত। তা ছাড়া জ্বালানি কাঠ সাশ্রয়েরও একটি বিষয় ছিল। খিচুড়ি রান্না করতে সময় লাগে কম। ফলে খড়িকাঠ বাঁচে। বর্ষাকালে শুকনো খড়ি জোগাড় করাও খুব একটা সহজ কর্ম নয়। ফলে সব মিলিয়ে খিচুড়ি রান্না করাই ছিল সুবিধাজনক। মূলত এসব থেকেই আষাঢ়-শ্রাবণের সঙ্গে খিচুড়ি খাওয়ার বিষয়টি জুড়ে গেছে।
খিচুড়ি গুরুপাক। বেশি ডাল থাকায় হজম হতে সময় লাগে বেশি। খাবারটি পেটে থাকে অনেকক্ষণ। এ কারণেও বর্ষায় খিচুড়ির কদর। খাবারের অপ্রতুলতা কিংবা রান্নাঘর ব্যবহারের অপারগতার কারণে মানুষের হয়তো এমন একটি খাদ্যের প্রয়োজন ছিল, যা দীর্ঘক্ষণ পেটে থেকে ক্ষুধা দমিয়ে রাখবে। যাতে বারবার খাবার রান্নার ঝক্কিতে পড়তে না হয়। খিচুড়ি সে কারণে বর্ষার দিনে খুবই আদর্শ খাবার। আবার হজম হতে দেরি হয় বলে গরমের দিনে খাবারটি খেলে শরীর খারাপ হতে পারে। এ কারণে সাধারণত ঠান্ডা আবহাওয়ায় মানুষ খিচুড়ি খায়। দীর্ঘদিন একই ধরনের খাবার খেতে খেতে অরুচি ধরে গেলে বৃষ্টি পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মানুষ নতুন স্বাদ চাখতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। ফলে সেদিন রান্না হয় খিচুড়ি। এটিও বর্ষার সঙ্গে খিচুড়ির মেলবন্ধনের একটি কারণ।
বাংলায় খিচুড়ি খাওয়ার চল বেশ পুরোনো। আলেকজান্ডার আমল (৩৫৬-৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) থেকেই এই অঞ্চলের মানুষ তা খায় বলে জানা যায়। স্কটরা দাবি করেছেন, তাদের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কেডজ্রি নামের একটি খাবার ভারতবর্ষে এসেছিল; সেটাই এখন এই অঞ্চলের খিচুড়ি। বাংলায় খিচুড়ি শব্দটি ভারতীয় ‘খিচড়ি’ থেকে এসেছে। সেটি আবার সংস্কৃত ‘খিচ্চা’ থেকে আগত। চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ইবনে বতুতা ভারতবর্ষে মুগ ডাল ও চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না হতে দেখেছেন। নিজের ভ্রমণকাহিনিতে ‘খিশ্রি’ নামে খাবারটির উল্লেখ করেছেন তিনি। রুশ পর্যটক নিকিতিনও এই অঞ্চলের খিচুড়ির কথা বর্ণনা করেছেন।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট