ত্বকচর্চা I শুষ্কতায় সতর্কতা
ত্বকের শুষ্কতা কাটিয়ে ওঠার সহজ পরিচর্যা। সুস্থ ও সতেজ লুকের জন্য
শুষ্কতা ত্বকে শুধু অস্বস্তি তৈরি করে না, সৌন্দর্যও নষ্ট করে। অতিরিক্ত টানটান ভাব- বিশেষ করে মুখ ধোয়া কিংবা গোসলের পর এমন অবস্থাই শুষ্ক ত্বকের প্রধান উপসর্গ। সেই সঙ্গে অমসৃণতাও দেখা দেয়। অনেকের চুলকানি হয়। ত্বকের আবরণ উঠতে দেখা যায়। কারও ত্বক দেখায় ধূসর, কারও লালচে। সবচেয়ে সমস্যার দিক হচ্ছে রাতরাতি বুড়িয়ে যায় এ ধরনের ত্বক। প্রাকৃতিকভাবে অন্য ত্বকের তুলনায় দ্রুত বলিরেখা এবং সূক্ষ্মরেখা পড়ে শুষ্ক ত্বকে। তবে বিশেষজ্ঞদের জরিপে দেখা গেছে, ত্বকের শুষ্কতা জন্মগত নয়, এর জন্য অনেকাংশেই দায়ী পরিবেশ। রোজকার কিছু অভ্যাসও শুষ্ক করে দেয় ত্বক। তাই শুষ্কতার সমস্যা সেরে যায় নিয়মিত পরিচর্যায়। আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবেশের শুষ্কতার প্রভাব পড়ে ত্বকে। বাতাসে আর্দ্রতা নিম্নগামী হলে শুষ্ক ত্বকে শুষ্কতা দেখা দেয়। অতিরিক্ত তাপমাত্রায়ও অনেক সময় এমনটি ঘটে। তাপমাত্রার আধিক্য বাতাসে আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। তখন সানস্ক্রিন ছাড়া দীর্ঘ সময় রোদে থাকলে শুষ্ক হয়ে ওঠে ত্বক। ধূমপান আর পর্যাপ্ত পানি পান না করলেও এ সমস্যা দেখা দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে গরম পানিতে গোসল ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট করে দিয়ে ত্বকের শুষ্কতা বাড়ায়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে শুষ্কতা। কারণ, সে সময় ত্বক পাতলা হতে শুরু করে। তেলগ্রন্থি থেকে তেল বের হওয়ার হার কমে যায় প্রাকৃতিকভাবে। ফলাফল শুষ্ক ত্বক।
ত্বক শুষ্ক কি না, তা নির্ধারণ করা যায় সহজ পদ্ধতিতে। বেশি যন্ত্রপাতির তো দরকার হয়-ই না, হ্যাপাও নেই। বেয়ার ফেসড মেথড এ ক্ষেত্রে দারুণ জনপ্রিয়। এ পদ্ধতিতে ভালো কোনো ক্লিনজার দিয়ে মুখ ধুয়ে নিতে হয় প্রথমে। তারপর ত্বকে কোনো ময়শ্চারাইজার, সেরাম কিংবা ট্রিটমেন্ট ক্রিম না মেখে আধঘণ্টার অপেক্ষা। নির্দিষ্ট সময় পর নাক, কপালসহ মুখের কোনো অংশে তেলের ছিটেফোঁটা না থাকলে কিংবা চকচকে উজ্জ্বল না দেখালে বুঝতে হবে ত্বক শুষ্ক। ব্লটিং শিট মেথডও জনপ্রিয় ত্বকের ধরন যাচাইয়ের কাজে। মূলত ত্বকের বিভিন্ন অংশে ব্লটিং পেপার চেপে চেপে করা হয় এ পরীক্ষা। যদি পেপারে তেলের ছিটেফোঁটাও না থাকে, তাহলে বুঝতে হবে ত্বক শুষ্ক।
প্রাত্যহিক পরিচর্যায়
সকাল শুরু করা চাই ক্লিনজিং দিয়ে। ফেনাবিহীন, অ্যালকোহল ও সুগন্ধিমুক্ত কোমল ক্লিনজিং লোশন বা মিল্ক- এ ধরনের ত্বকের যত্নে সবচেয়ে কার্যকর। কারণ, এগুলো ত্বককে শুষ্কতার হাত থেকে রক্ষা করে। আলতো হাতে ক্লিনজিং লোশন ব্যবহার করা উচিত, বেশি ঘষামাজার প্রয়োজন নেই। তারপর ঈষদুষ্ণ পানিতে মুখ ধুয়ে নিতে হবে। মাইসেলার ওয়াটারও শুষ্ক ত্বক পরিষ্কারের দারুণ অপশন। ত্বকের প্রাকৃতিক তেল নষ্ট না করে এগুলো ত্বক পরিষ্কার করে। ভিটামিন ইনফিউজড ক্লিনজিং ইমালশন ব্যবহার করা যেতে পারে। এগুলো ত্বকের গভীর থেকে দূষণ দূর করে। সরায় মৃত কোষ। শুষ্ক ত্বকেরও টোনিং জরুরি। অ্যালকোহল, ইথানল, আইসোপ্রোপাইলের মতো উপাদানমুক্ত টোনার এ ধরনের ত্বকের জন্য বেছে নেয়া উচিত। তারপর দিতে হবে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সেরাম। ভিটামিন ই, এ এবং সি যুক্ত সেরাম শুষ্ক ত্বকের কোলাজেন ভেঙে যাওয়া প্রতিরোধ করে। ফলে স্বাস্থ্যোজ্জ্বল দেখায় ত্বক। আর ময়শ্চারাইজার তো অবশ্যই। হায়ালুরনিক অ্যাসিড, গ্লিসারিন আর অ্যালগির মতো উপাদানগুলো ত্বককোষে পানি ধরে রাখার ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে তা আর্দ্র থাকে। থাকে মসৃণ। এসপিএফ যুক্ত ময়শ্চারাইজারগুলো হ্যাপা কমায়। নতুবা আলাদা করে এসপিএফ মাখতে হবে মনে করে, যা আর্দ্রতাকে আটকে দেবে ত্বকে। দেবে সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে বাড়তি সুরক্ষা। শুষ্ক ত্বকের রাতের রুটিন প্রায় একই রকম। ক্লিনজিং এবং টোনিং দরকার রাতেও। তারপর মাখতে হবে সেরাম। তবে রাতে রেনিটল যুক্ত সেরামই বেশি কার্যকর। এগুলো দ্রুত ত্বক শুষে নেয়। কোষ পুনরুৎপাদনে সাহায্য করে। স্কিন টোন এবং টেক্সচার ভালো রাখার সহায়ক। সূক্ষ্ম রেখা এবং বলিরেখার হার কমায়। রাতে পেপটাইড যুক্ত আইক্রিমও মাখতে পারেন চোখে। এগুলো কোলাজেন উৎপাদনের মাত্রা বাড়ায়। ফলে সুন্দর থাকে চোখের চারপাশের সংবেদনশীল ত্বক। সঙ্গে বাড়তি আর্দ্রতার জোগান দেবে হাইড্রেটিং ময়শ্চারাইজার। রোজহিপ, ইভনিং প্রাইমরোজ, বোরেজ, ফসফোলিপিড, ক্যানবেরি, সুইট আমন্ড কিংবা জোজোবা অয়েলযুক্ত ময়শ্চারাইজার বেছে নিতে পারেন এ ক্ষেত্রে। এগুলো ত্বকের প্রাকৃতিক লিপিডের মাত্রা বাড়ায়। রাতভর ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক সারাইয়ের কাজ করে। ত্বকে আর্দ্রতার মাত্রা বাড়ায়।
সপ্তাহ শেষে
শুষ্ক ত্বকে খুব দ্রুত মৃত কোষ জমে। ফলে সব ধরনের ত্বকের তুলনায় এতে এক্সফোলিয়েশন বেশি জরুরি। তবে খুব রুক্ষ উপাদানযুক্ত ফেসিয়াল স্ক্রাবের বদলে কেমিক্যাল এক্সফোলিয়েন্ট শুষ্ক ত্বকে বেশি উপযোগী। এগুলো দ্রুত এবং কার্যকর উপায়ে মৃত কোষ সারাইয়ের কাজ করে। বেরি এক্সট্র্যাক্ট, এএইচএ কিংবা বিএইচএ-এর মতো অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট শুষ্ক ত্বকের দাগছোপ দূর করে। খুলে দেয় বন্ধ লোমকূপের মুখ। শুষ্ক ত্বকের ডিসকালারেশন রোধ করে ফিরিয়ে দেয় স্বাস্থ্যোজ্জ্বল আভা। বলিরেখাসহ বয়সের ছাপ রুখে দেয় কার্যকরভাবে। সপ্তাহে একবার শুষ্ক ত্বকের উপযোগী ফেস মাস্কও ব্যবহার করা চাই। বাসায় বসেই তৈরি করা যায় প্যাক। শসা কিংবা কলা চটকে নিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। দইয়ের সঙ্গে মধু কিংবা মধুর সঙ্গে গোলাপজল মিশিয়ে মাখিয়ে নেয়া যায়। অ্যালোভেরা জেল ত্বকের শুষ্কতা কাটিয়ে উঠতে দারুণ। ফেস অয়েলও খুব উপকারী। এর মধ্যে ল্যাভেন্ডার অয়েল ত্বকের শুষ্কতা কাটিয়ে আর্দ্রতা ধরে রাখতে সাহায্য করে। সারায় দাগছোপ। আলট্রা হাইড্রেটিং প্রোপার্টিযুক্ত আরগান অয়েল শুষ্ক ত্বকে ব্যবহার করা যায়। চিটচিটে না করেই এই তেল ত্বকের গভীরে প্রবেশ করায় প্রয়োজনীয় পুষ্টি। রুখে দেয় বয়সের ছাপ। এ ছাড়া অ্যাভোকাডো, জোজোবা, কোকোনাট অয়েলও শুষ্ক ত্বকে কাজ করে জাদুর মতো।
পনেরো দিন পর
শুধু মুখত্বক নয়, গলা, ঘাড়, পিঠসহ অন্যান্য অংশের বাড়তি যত্ন প্রয়োজন পনেরো দিন পরপর। বিটা আর আলফা হাইড্রোক্সি অ্যাসিড পিলের মিশ্রণ তৈরি ও ব্যবহার করা যেতে পারে ঘরে বসেই। যা ত্বকে জমে থাকা মৃত কোষ সরিয়ে দিতে সাহায্য করবে। দেবে দীপ্তিময় নতুন ত্বক।
মাসে একবার
শুষ্ক ত্বকে আর্দ্রতার জোগান দেয়াটাই মুখ্য। তাই কোমল এক্সফোলিয়েটিং প্রক্রিয়া যুক্ত হাইড্রেটিং ফেসিয়াল করিয়ে নিতে হবে মাসে একবার। ডিটক্সিফাইয়িং ফেসিয়াল করিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে, ফেসিয়ালে ব্যবহৃত মাস্ক যেন শুষ্ক ত্বকের উপযোগী হয়। কেমিক্যাল ট্রিটমেন্টও করিয়ে নেয়া যেতে পারে। তবে অভিজ্ঞ কারও সঙ্গে আলাপ করে।
জাহেরা শিরীন
মডেল: আনুশকা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন