skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I অন্তরের শুভ্রতা

একজন ভালো মানুষের যেকোনো সুসময় ও দুঃসময় ঠিক যেন বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুলের মতোই সমগ্র মানবজাতিকে দোলা দিয়ে যায়।

‘এখানে আকাশ নীল—নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা—রং তার আশ্বিনের আলোর মতন;/ আকন্দফুলের কালো ভীমরুল এইখানে করে গুঞ্জরণ/ রৌদ্রের দুপুর ভ’রে…’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই এঁকেছেন বাংলার চিরায়ত শরতের চিত্র, তার কবিতার পঙ্ক্তিমালায়। শরৎ শব্দটার কথা এলেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে আকাশে মেঘের মহাকাব্যিক খেলা। বাংলার জমিনে তখন হাওয়ার তালে নাচে শুভ্র কাশফুল। সেই শুভ্রতা দোলা দিয়ে যায় ছোট-বড় সবার মনে, নির্বিশেষে।

দুই
প্রকৃতিতে যখন শুভ্রতার খেলা, অন্তরে তখন কী চলছে? ঘাপটি মেরে থাকা কোনো পঙ্কিলতা উঁকি দিতে চাইছে? সাবধান! নিজেকে রাখুন সংযত। প্রাকৃতিক শুভ্রতার ছোঁয়ায় অন্তরও হয়ে ওঠুক নির্মল। গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিস বলে গেছেন, ‘প্রিয় বন্ধু, নিজের অন্তরের যত্ন নাও। নিজেকে জানো। যখন আমরা নিজেদের জানতে পারব, তখন আমাদের যত্নে রাখার উপায়ও জানা সম্ভব হবে।’
অন্যদিকে অ্যানালাইটিক্যাল সাইকোলজির জনক ও সুইস মনোবিশ্লেষক কার্ল ইয়ুং বলে গেছেন, ‘কেউ যদি নিজের পথে চলতে গিয়ে ধ্বংস হয়ে যায়, তাতে ক্ষতি নেই।… কানের কাছে কোনো পাপাত্মা যতই নতুন ও চমৎকার পথগুলোর কথা ফিসফিসিয়ে বলে প্ররোচনা দিক না কেন, একজন মানুষের নিজ বিধিমালার প্রতি অবশ্যই অনুগত থাকা চাই।… এমন কণ্ঠস্বরের আহ্বানে সাড়া দেওয়া মানুষের সংখ্যা কম নয়। ফলে তারা একবার অন্যদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এমন সব সমস্যার সামনে হাজির হয়, যেগুলো সম্পর্কে অন্যরা অবগত নয়। তাই অন্যদের কাছে নিজের সেই সমস্যা ব্যাখ্যা করা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে পড়ে অসম্ভব। সেই দুর্ভেদ্য কুসংস্কারের দেয়ালে আটকা পড়ে সে, যা কাউকে বোঝানো মুশকিল। লোকে হয়তো বলবে, “তুমি অন্যদের চেয়ে আলাদা নও” কিংবা “এমন কোনো বিষয়ের অস্তিত্ব নেই আসলে।” এমনকি এমন পরিস্থিতিকে “অস্বাস্থ্যকর” বলেও ডেকে বসবে কেউ কেউ।… ফলে একজন মানুষ একবার বিচ্ছিন্ন ও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়লে, নিজের অন্তস্তল থেকে আসা আহ্বানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যাওয়া উচিত তার। বাকি সবাই হয়তো হাহাকার করে বলবে, “আহা, নিজের কবর সে নিজেই খুঁড়েছে!” কিন্তু সেই লোকই তো ভালো জানে তার নিজের রাস্তা, নিজের বিধিমালা।… অর্থবহ জীবন আসলে একমাত্র সেই জীবন, যেটি নিঃশর্তে ও নির্বিকল্পে এর নিজস্ব সুনির্দিষ্ট বিধিমালায় একজন ব্যক্তিমানুষ অনুধাবনের প্রচেষ্টা চালায়।… তাই যে মানুষ তার সত্তার বিধিমালার প্রতি সৎ নয়, নিজ জীবনের তাৎপর্য অনুধাবনে সে ব্যর্থ।’ আর নিজ জীবন অনুধাবনের জন্য নিজের অন্তরের শুশ্রূষা যে অনিবার্য, সে কথা তো বলাই বাহুল্য।

তিন
মানুষ সহজাতভাবেই বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হয়। সেই সব মানবিক গুণ তাদেরকে বাদবাকি প্রাণিকুল থেকে আলাদা ও বিশিষ্ট করে তোলে। তাই তো শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, অন্যদের নিয়েও নিবিড়ভাবে ভাবে মানুষ। অন্যের শুশ্রূষায় বাড়িয়ে দেয় হাত। বিপন্ন পশুপাখির দিকে মেলে দেয় মমতার দৃষ্টি। সযত্নে পরিচর্যা করে উদ্ভিদের। পক্ষান্তরে, কিছু দানবিক দোষও মানুষের অন্তস্তলে সহজাতভাবে জায়গা করে নেয়। সেই মন্দ সত্তা তাকে দিয়ে করায় নৃশংস, জঘন্য সব কাজ। শুধু অপর মানুষ নয়, এই গ্রহের সকল সত্তার জন্যই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে সে। এই যে একই মানুষের ভেতর একেবারেই বিপরীত, ভালো ও মন্দ—দুই ধরনের বৈশিষ্ট্যের সহাবস্থান, তাতে শেষ পর্যন্ত কোন পক্ষের বিজয় ঘটে—সেটি দিয়েই একজন ব্যক্তিমানুষকে বিচার করি আমরা। তাই দিন শেষে আপনি ভালো নাকি খারাপ—কোনো আড়াল দিয়েই সেই পরিচয় ঢেকে রাখতে পারবেন না। আর মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে খারাপ হওয়া ক্ষেত্রবিশেষে আপনাকে এগিয়ে রাখলেও পরিশেষে তা যে কোনো বাহাদুরি নয়, সেটি অনুধাবন করার জন্য রকেট সায়েন্সের দরকার পড়ে না।
অন্যদিকে, একজন ভালো মানুষের যেকোনো সুসময় ও দুঃসময় ঠিক যেন বাতাসে দোল খাওয়া কাশফুলের মতোই সমগ্র মানবজাতিকে দোলা দিয়ে যায়। নিজ থেকেই অন্যরা তার পক্ষ গ্রহণ করে। তার আনন্দে হেসে ওঠে; তার বেদনায় মুষড়ে পড়ে। তাই প্রত্যেক মানুষের ভেতরে থাকা ভালো ও মন্দ—দুই সত্তার মধ্য থেকে দোষগুলোকে বিজয়ী হতে দেওয়া সমীচীন নয় কিছুতেই। অন্যদিকে, গুণগুলোকে চিরজাগরূক রাখার জন্য নেওয়া চাই অন্তরের যত্নআত্তি।

চার
অন্তরের যত্ন নেওয়ার সঙ্গে শরীরের যত্ন নেওয়ার রয়েছে নিবিড় সংযোগ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, মন ভালো রাখার জন্য শরীর ভালো রাখা জরুরি। তারপর সুস্থ দেহে, সুস্থির মাথায় ভাবনাচিন্তা করে খুঁজে নেওয়া চাই নিজস্ব জীবনপথ। আর সেই পথে ছড়িয়ে দেওয়া চাই ইতিবাচকতার শুভ্র বার্তা। জানি, শুনতে যত সহজ মনে হচ্ছে, ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। তবে এই জটিল প্রক্রিয়াকে আয়ত্ত করার কৌশলও জানিয়েছেন মনোবিশ্লেষকেরা। তাদের মতে, নিজের দেহ ও মন ইতিবাচক তথা মানবিক মূল্যবোধে শাণিত করার জন্য প্রয়োজনে সাহায্য নিতে পারেন মেডিটেশনের। টুকে রাখতে পারেন দিনলিপি। প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার কালে কিংবা সকালে ঘুম থেকে উঠে মিলিয়ে নিতে পারেন হিসাবের খাতা—নিজের অন্তরের গুণাবলির কতটুকু ঘটাতে পারলেন প্রকাশ, দানবিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে কতটুকু ও কীভাবে করতে পারলেন দমন, কতটুকু হলেন ব্যর্থ, কতটুকু সফল…। এমন অভ্যাসগুলোকে জীবনচর্চায় নিয়মিত করা গেলে সুফল আসার সম্ভাবনা থাকে। একই সঙ্গে বলে রাখা ভালো, নিজেকে যখন আপনার জানা হয়ে যাবে ভালো করে, তখন নিজ অন্তরের যত্ন নেওয়ার নিজস্ব কৌশলও জেনে যাবেন। তাই সেই যাত্রায় নিজ পথ অনুসরণ করাই বোধ করি শ্রেয়; যেমনটা অভিমত সক্রেটিস ও ইয়ুংয়ের মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদ-মনোবিশ্লেষকদের।

পাঁচ
অকালপ্রয়াত বাংলাদেশি রকস্টার আইয়ুব বাচ্চু বেদনার্ত গলায় গেয়েছিলেন, ‘গতকাল রাতে বিবেক আমার/ স্বপ্নের কড়া নেড়ে করলো জিজ্ঞেস—/ “আমায় ছাড়া আর কত দিন রবে?”’ বিবেকের এই কড়া নাড়া জাগ্রত থাকুক। আমাদের অন্তর হয়ে উঠুক মনুষ্যত্বের সকল গুণে ভরা শুভ্র রঙিন, ঠিক শরতের প্রকৃতির মতোই।
সবার জন্য শুভকামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top