টেকসহি I প্রাণিপ্রেম
৪ অক্টোবর। ওয়ার্ল্ড অ্যানিমেল ডে। অ্যানিমেল রাইট ও ওয়েলফেয়ার নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং যথাযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণের বার্তা নিয়ে প্রতিবছর আন্তর্জাতিক এই বিশেষ দিবস পালিত হয়। আমাদের দেশে অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের চিত্র কেমন? জানাচ্ছেন সাদিয়া আফরিন শায়লা
ঢাকার বাসিন্দা আফসানা আনজুম (ছদ্মনাম)। বাড়িতে রয়েছে ছোট্ট দুটি বিড়াল ও একটি কুকুরছানা। ছানাগুলোকে সময়মতো খাওয়ানো, বাইরে নিয়ে যাওয়া, অসুখ-বিসুখে চিকিৎসকের কাছে নেওয়াসহ সব দিকেই খেয়াল রাখেন তিনি। নিজের পোষ্যগুলোর পারলেও পথে থাকা হাজারো বেওয়ারিশ প্রাণীর যত্ন নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। ‘বাইরে বেরোলেই রাস্তায় কোনো না কোনো পশুকে দেখি অসুস্থ। বেশির ভাগ সময়ই সম্ভব হয় না ওদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা করানোর। আবার অনেক সময় তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেও চিকিৎসা-পরবর্তী যত্ন নেওয়া তো সম্ভব না একার পক্ষে। এ দেশে যদি অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান বেশি থাকত, তাহলে হয়তো প্রাণীগুলোকে এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হতো না,’ বলছিলেন আফসানা।
শুধু অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান দিয়েই কি এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব? প্রথমে জেনে নিই অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার আসলে কী। একটি প্রাণী যে পরিবেশে বসবাস করছে, সেই পরিবেশে সে ঠিক কীভাবে মানিয়ে নিচ্ছে কিংবা মানিয়ে নিতে আদৌ পারছে কি না, তারই সূচক ‘অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার’। একটি প্রাণী যদি সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়, নিরাপদ বাসস্থান পায়, স্বাভাবিকভাবে সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশের সুযোগ পায় এবং ব্যথা, শারীরিক কষ্ট, এমনকি ভয়ের মতো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে না ভোগে, তাহলে প্রাণীটি ভালো ও স্বাভাবিকভাবে চলতে পারছে বলে ধরা হয়। এ ছাড়া আরও কিছু বিষয় যেমন প্রাণীর রোগ প্রতিরোধে নেওয়া ব্যবস্থা ও প্রয়োজনমতো ওদের চিকিৎসার সুযোগ থাকাও অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের অংশ। সহজ ভাষায়, একটি প্রাণীর ‘ওয়েলফেয়ার’ মানে তার শারীরিক ও মানসিক চাহিদা পূরণ করা।
এখন দেখা যাক, অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের চিত্রটা কেমন। রাজধানী ঢাকার গুলিস্তানে ঘোড়ার গাড়িতে চড়া ছিল একসময় এ শহরের মানুষের বিনোদনের অন্যতম প্রধান উৎস। বর্তমানে ঘোড়ার গাড়ির সংখ্যা কমে এলেও বিনোদনের এ ‘অমানবিক’ মাধ্যমটি পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অভুক্ত, শীর্ণ প্রাণীগুলো শরীরে শক্তি না থাকা সত্ত্বেও এখনো প্রতিদিন বহন করে চলেছে মানুষের ভার। এরপরই আসে চিড়িয়াখানার কথা। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী একই স্থানে ছোট্ট খাঁচায় বন্দি করে রেখে যে কেবল প্রাণীগুলোর অবাধ বিচরণ ও সহজাত প্রবৃত্তি প্রকাশে বাধা দেওয়া হচ্ছে, তা নয়; প্রাণীগুলোকে মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া, মারধর করা, এমনকি ঠিকঠাক খাবার না দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে আসছে বহুদিন ধরে। অমানবিক এসব কার্যক্রম বন্ধে নানা সময়ে বিভিন্ন সংস্থা এগিয়ে এলেও এখনো চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলোর অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। প্রাণীদের প্রতি অমানবিক আচরণের আরও একটি বড় উদাহরণ ঢাকার কাঁটাবনে প্রাণী বেচাবিক্রির দোকানগুলো। ব্যস্ত এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতের সময় ছোট ছোট খাঁচায় আটকে রাখা প্রাণীগুলো নজরে আসেনি—এমন মানুষ কমই আছেন। অন্ধকার, দুর্গন্ধময়, নোংরা পরিবেশে এ প্রাণীগুলোকে দিনের পর দিন অনেকটাই অভুক্ত অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়। স্পষ্টভাবে আইনের পরিপন্থী কাজ হওয়া সত্ত্বেও এখনো বন্ধ হয়নি ‘পশু-পাখি নির্যাতনকারী’ ওই সব দোকান। অন্যদিকে, বাংলাদেশে প্রকাশ্যে প্রাণীর প্রতি অমানবিক আচরণের সবচেয়ে বড় উদাহরণ সম্ভবত, সিটি করপোরেশন পরিচালিত অবাধে কুকুর নিধন কার্যক্রম। এ প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অমানবিক নিধন কার্যক্রম যদিও অনেক বছর ধরে আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে; তবু বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে প্রায়শই তা চলে।
তবে এ দেশে যে প্রাণীর ওয়েলফেয়ার নিয়ে কাজ করা সংগঠন একেবারেই নেই, তা নয়। ২০০৯ সালে দেশে প্রথম অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘অভয়ারণ্য-বাংলাদেশ অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণিতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি ১২ বছর ধরে দেশের অন্যতম অবহেলিত প্রাণি—অবাধে বিচরণকারী, মালিকানাবিহীন কুকুর নিয়ে কাজ করে চলেছে। ২০০৯ সাল থেকেই সংগঠনটি নিজস্ব উদ্যোগে কুকুরকে জীবাণুমুক্তকরণের পাশাপাশি কুকুরসহ অন্যান্য প্রাণি জীবাণুমুক্তকরণের সুবিধা সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে। ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সংগঠনটি তাদের প্রতিষ্ঠার প্রথম চার বছরে ৩ হাজার ৫০০টি কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ ও জীবাণুমুক্ত করেছে।
কুকুর থেকে জলাতঙ্ক এবং নানা ধরনের সংক্রামক রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকলেও, আদতে যে কুকুরই মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়ে থাকে—বিষয়টি স্পষ্ট। কুকুর নিধনের মতো অমানবিক কাজ বন্ধে সর্বদাই সোচ্চার ছিল অভয়ারণ্য। তাদের কার্যক্রম শুরুর তিন বছর পর, ২০১২ সালে কুকুর নিধনকে অমানবিক উল্লেখ করে তা বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। সে নির্দেশনার পর সরকারের পক্ষ থেকে কুকুর বন্ধ্যাকরণ করে এ প্রাণীর সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা দেওয়া হয়। একই বছরের এপ্রিলে কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জলাতঙ্ক প্রতিরোধে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য অভয়ারণ্যের সঙ্গে দুই বছর মেয়াদি একটি চুক্তি সই করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু দুই বছর পর সেই চুক্তি আর নবায়ন করা হয়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভেটেরিনারি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত, এক বছর কুকুর বন্ধ্যাকরণের একটি প্রকল্প চালু ছিল। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও নেওয়া হয়নি যথাযথ পদক্ষেপ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিক কতগুলো কুকুরকে বন্ধ্যাকরণ করা হয়েছে, সে-সংক্রান্ত কোনো তথ্যই নেই ভেটেরিনারি বিভাগের কাছে। তাদের তথ্য থেকে আরও জানা যায়, ২০১৮ সালের পর বেওয়ারিশ কুকুর নিয়ন্ত্রণে রাখতে আর কোনো কার্যক্রমই নেওয়া হয়নি। এর দুই বছর পর, ২০২০ সালে আবারও রাজধানীতে কুকুর নিধন শুরু হয়। সে সময় এ কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অভয়ারণ্য, পিপলস ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ও অভিনেত্রী জয়া আহসানের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।
তাহলে এত সব প্রমাণ ও প্রচেষ্টার পরও কেন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার? বাংলাদেশের আইনই-বা এ বিষয়ে কতটা জোরালো অবস্থানে রয়েছে? অবাক করার মতো হলেও সত্যি, ২০১২ সাল পর্যন্ত দেশের সংবিধানে প্রাণীর নিরাপত্তার বিষয়ে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য আইন প্রণীত হয়নি। সংবিধানে এখনো ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট, ১৯২০’ বহাল আছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর ভারত এই আইন হালনাগাদ করলেও তৎকালীন পাকিস্তান এবং পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশে আইনটি অপরিবর্তিতই রয়ে যায়। এই আইন অনুযায়ী, কোনো প্রাাণির ক্ষতি করলে একজন ব্যক্তির সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ড বা ২০০ টাকা জরিমানা হবে। এমনকি ব্যক্তিটি নিজের দোষ স্বীকার করে ২০০ টাকার সামান্য জরিমানা দিয়ে সহজেই দায়মুক্ত হতে পারেন। উল্লিখিত আইনের অধীনে কারাদণ্ড কেবল তখনই প্রযোজ্য হবে, যদি অভিযুক্ত তার দোষ স্বীকার না করেন এবং বিচারকাজ বা ট্রায়াল শেষ হওয়ার পর প্রকৃতপক্ষে দোষী সাব্যস্ত হন। বাংলাদেশে ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট, ১৯২০’-এর অধীনে প্রথম মামলাটি হয় ২০১৫ সালে। জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই আইনের অধীনে মোট তিনটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এরপর ২০১২ সালে প্রণীত হয় ‘বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন’। এই আইনের অধীনে ১ হাজার ৩০৭টি প্রাণী ও উদ্ভিদকে সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইন অনুযায়ী, বাঘ বা হাতি হত্যা করলে ২ থেকে ৭ বছরের কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা দিতে হবে। এ ছাড়া পাখি বা পরিযায়ী পাখি হত্যা করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড ও এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে প্রাণীর সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের নেওয়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও ইতিবাচক পদক্ষেপ সাম্প্রতিক ‘অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট, ২০১৯’ প্রণয়ন। এই আইন অনুযায়ী, কোনো প্রাণীর স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে বাধা দিলে সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। একই আইন অনুযায়ী, একটি প্রাণী হত্যা করলে একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
এই আইনের আরও কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন অব অ্যানিমেল হেলথ ও ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অন অ্যানিমেল রাইটসের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য। পাশাপাশি, একজন ভেটেরিনারি সার্জনের সার্টিফিকেশনের অধীনে ইউথেনেশিয়ার মাধ্যমে একটি রোগাক্রান্ত প্রাণীর বেদনাহীন মৃত্যুর অনুমতিও দেওয়া হয়েছে এই আইনের মাধ্যমে, যে বিধান বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। এ ছাড়া খামারের প্রাণী এবং গবাদিপশুর বিষয়েও এই আইনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি দেখা গেছে। প্রাণীর দেহে নেশাজাতীয় রাসায়নিক পদার্থ বা অনির্ধারিত ও অতিরিক্ত মাত্রার ওষুধ প্রয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যেখানে আগের ‘ক্রুয়েলটি টু অ্যানিমেল অ্যাক্ট, ১৯২০’ অনুসারে পশুকে গৃহপালিত বা বন্দি—এই দুই গোত্রে ফেলা হয়েছিল, সেখানে নতুন আইনে বেওয়ারিশ প্রাণীগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে কুকুর হত্যার মতো রাস্তার পশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতার বিষয়ে কোনো স্পষ্ট ধারা প্রণীত হয়নি এই আইনেও।
জনবহুল এই দেশে যেখানে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকাই দায়, সেখানে এই অবলা প্রাণীদের রক্ষায় এবং তাদের জন্য একটি সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ নিশ্চিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন—উভয় দিক থেকেই এগিয়ে আসা জরুরি। ওরা যেহেতু এ পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই এ প্রাণীগুলোর ক্ষতি হলে পরিশেষে আসলে হুমকির মুখে পড়বে মানুষও।
ছবি: ইন্টারনেট