ফিচার I বিশ্রাম বিস্ময়
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে নিতে নিরন্তর ছুটে চলি আমরা। কিন্তু বিশ্রামকে দাম দিচ্ছি কি? লিখেছেন দীপান্বিতা ইতি
‘চলছে জীবন রথ/ যত মত তত পথ/ কার আগে কী পাব কী হারাব/ দে দৌড়…’—জেমসের এ গানের মতোই প্রতিনিয়ত ছুটছি আমরা। ব্যস্ত এই বিশ্বে যে তাড়াহুড়োর দৈনন্দিন জীবনযাপন করি, তাতে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা আসলেই মুশকিল খুব। স্কুল-কলেজ-কর্মক্ষেত্র-বাজারঘাট আর সামাজিকতার চাপে সময়গুলো কখন যে উড়ে যায়, হিসাব মেলে না। এই ‘দে দৌড়ে’র জীবনে নিজের জন্য সময় কোথায়!
কিন্তু দেহঘড়ি বানিয়েছেন যে মিস্তিরি, সেই ঘড়ি সঠিকভাবে সচল রাখার নিয়মাবলির জ্ঞানটুকুও রাখা চাই। কী সেটা? জানি অনেকেই, মানি কি? রেস্ট, রিল্যাক্সেশন, এক্সারসাইজ—সুস্থভাবে বেঁচে থাকার মূলমন্ত্র। শরীরচর্চা, মানসিক গঠন, সুশিক্ষা, ক্যারিয়ার উন্নয়ন—নিজেকে প্রমাণ করতে ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখতে থাকি ছুটে চলা। বিশ্রাম বলতে বুঝি ছয় বা আট ঘণ্টার ঘুম। অবশ্যই নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। তবে ঘুম ছাড়াও বিশ্রামের গুরুত্ব কম নয়। প্রাত্যহিক জীবনে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসম্পন্ন ঘুমের প্রয়োজনীয়তা অনেক। মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য এ দুটি সমান গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, নিত্যদিনের ব্যস্ততার ফাঁকফোকরে পরিমিত বিশ্রাম পারে ঘুমের মানের উন্নয়ন ঘটাতে।
ঘুম হলো মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর বিশ্রাম নেওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। গভীর ঘুম আমাদের রিসেট ও রিচার্জ করে। মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, স্মৃতিশক্তি, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা এবং হজমপ্রক্রিয়া বাড়াতে এর বিকল্প নেই। আর বিকল্প নেই বলেই ঘুমের ঘাটতি হলে শরীর আমাদের ঘুমিয়ে পড়তে বাধ্য করে। কিন্তু বিশ্রাম? গুরুত্ব বুঝে সুস্থ জীবনের জন্য বিশ্রাম নিতে হবে নিজেদেরই। বিশ্রামকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। একেকজনের কাছে এর মানে একেক রকম। তবে সার্বিকভাবে, বিশ্রাম হলো শারীরিক বা মানসিক সুস্থতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেকোনো আচরণ। বিশ্রাম হতে পারে অ্যাকটিভ; যেমন বাইরে হাঁটতে যাওয়া। আবার প্যাসিভ বিশ্রামেও শান্ত হয় শ্রান্ত মন; যেমন গল্পের বই পড়া বা গান শোনা বা যোগব্যায়াম করা। যিনি যেভাবে নিতে চান, পদ্ধতিভেদে সব বিশ্রামই শারীরিক ও মানসিক শক্তি পুনরুদ্ধার করে।
সংজ্ঞা, গবেষণা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ—কঠিন সব কথা ভুলে সহজ ভাষায় বললে, ঘুম হলো ঘুম; বিশ্রাম নয়। বিছানায় গড়িয়ে একটু বেশি ঘুমিয়ে নিলেই যে বিশ্রামের প্রয়োজন হবে না, তা নয়। অনেক সময় যথেষ্ট গভীর ঘুমের পরেও আমরা ক্লান্ত থাকি। কাজে বা চিন্তায় উদ্যম থাকে না। অথবা ক্লান্তি দূর করার জন্য লম্বা সময়ের ঘুমের প্রস্তুতি নিয়েও ঘুমটা গভীর হয় না। রাজ্যের ভাবনা আর মানসিক জটিলতা ঘিরে রাখে অবচেতনকে। সহজ কথায় বলা যায়, এই রহস্যই হলো বিশ্রামের গূঢ় গুরুত্ব। যথেষ্ট ঘুম হয়েছে ভেবে আমরা নিত্যনৈমিত্তিক জীবন কাটিয়ে যাই, কিন্তু শরীর ও মনের সুস্থতার জন্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ বিশ্রাম নিতে ভুলে যাই নানা অজুহাতে। অনেক কাজ করতে হবে, ক্যারিয়ারে বা সমাজে অনেক উন্নতি করতে হবে, অনেক আয় করতে হবে—এই তাড়নায় বিশ্রাম নেওয়া হয় না অনেকের। তাতে অনেক প্রাপ্তি বা সাফল্যের মাঝেও আমরা ক্রমাগত ক্লান্ত হতে থাকি, ক্ষয়ে যেতে থাকি। বিশ্রামের অভাবে শরীর ও মনে আক্রান্ত হই। কেননা বিশ্রামের সঠিক গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করি না।
সুস্থ দেহ, সুন্দর মন আর সতেজ জীবনের জন্য মানুষের জীবনের পদে পদে বিশ্রামের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর জীবনেও সাত ধরনের বিশ্রামকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
প্রথমেই আসে শারীরিক বিশ্রামের কথা। এই বিশ্রাম হতে পারে সক্রিয়; এমনকি নিষ্ক্রিয়ও। সক্রিয় বিশ্রাম যেমন ধ্যান, মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, থেরাপি শরীরকে শান্ত করে; আবার ঘুমের মতো নিষ্ক্রিয় বিশ্রামের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই দুই ধরনের বিশ্রামে শরীর থাকে যথেষ্ট সুস্থ ও নীরোগ।
শারীরিক বিশ্রামের পাশাপাশি মানসিক বিশ্রামও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেকেই আছেন, দেহ-মনের ক্লান্তি দূর করতে এক মগ কফি খেয়ে দিন শুরু করেন। তবু ঘাটতি থেকে যায়। মন-মেজাজ খারাপ করে খিটখিটে হয়ে থাকে। কাজে মন দিতে না পেরে সারা দিন কাটিয়ে দেন অবসাদে। আবার রাতেও ঠিকঠাক ঘুম হয় না। ছাড়া ছাড়া ঘুমিয়ে ঘড়ির অ্যালার্মে এমনভাবে বিছানা ছাড়েন, যেন তিনি সজাগই ছিলেন। এমনটা হয় মানসিক বিশ্রামের অভাবে। কাজের মাঝেও সময় বের করে মানসিক শ্রান্তি কাটাতে তাই বিশ্রাম নেওয়া চাই। পছন্দের কোনো বই পড়া বা গান শোনা হতে পারে এর অনুষঙ্গ। আর ডায়েরিতে কাজের তালিকা লিখে রাখার অভ্যাস করলে ভাবনাগুলো ঘুমের ঘোরে খুব একটা হানা দেবে না।
আমাদের আরও প্রয়োজন সংবেদনশীল বিশ্রাম। উজ্জ্বল আলো, কম্পিউটার স্ক্রিন, ব্যাকগ্রাউন্ড সাউন্ড, মাইক বা গাড়ির হর্নের মতো উচ্চ শব্দ এবং একটানা কথোপকথন—অফিসে হোক বা জুম কলে—একঘেয়ে জীবনযাপনের এমন সব দিক আমাদের ইন্দ্রিয় ভোঁতা করে দেয়। যেটুকু না হলেই নয়, তার বাইরে ধুমধাড়াক্কা শব্দ বা স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা চাই। এ ক্ষেত্রে মোবাইল গেমস বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সময় না কাটিয়ে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে খুঁজে নিতে পারেন সৃজনশীল কিছু। জেনে রাখুন, কাজের মাঝে চোখ ও কানের বিশ্রামে কিছুটা সময় বের করে নিলে কর্মগতি বাড়ে বৈ কমে না।
অন্য প্রাণীদের সঙ্গে মানুষের অন্যতম পার্থক্যের জায়গা সৃজনশীলতায়। শেষ কবে পাখির ডাকে মুগ্ধ হয়েছিলেন? শেষ কবে প্রকৃতির পরম পরশে অনুভব করেছিলেন স্বর্গীয় অনুভূতি? শেষ কবে সবুজের অবগাহনে হারিয়ে গিয়েছিলেন? মনে করতে পারছেন না? আপনার চাই সৃজনশীল বিশ্রাম। এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ মানবসত্তাকে জাগিয়ে তোলে। প্রকৃতিকে উপভোগ করতে হয়তো খুব বেশি দূর যেতেও হয় না; ঘরের কোণের ছোট্ট টবে রাখা ফুলগাছ বা অফিস ডেস্কে রাখা মানিপ্ল্যান্টের সবুজ পারে সতেজ করতে মন। ছবির প্রদর্শনী, মঞ্চনাটক, গানের অনুষ্ঠান, কবিতার আসর, রুপালি পর্দা, সাহিত্য পর্যালোচনা কিংবা সমমনা মানুষের সঙ্গে নিছক আড্ডার মাধ্যমে পাওয়া সৃজনশীল বিশ্রামের ফলে বদলে যাবে আপনার চিন্তাভাবনার গতিপ্রকৃতি। উদ্ভাবনী যেকোনো কিছুতেই উৎসাহ আসবে প্রশান্ত মনে।
আবেগের যথাযথ প্রকাশ না হলেই ক্ষোভ, অভিমান, ঘৃণার মতো অনুভূতি তৈরি হয়। তাই মানসিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে ইমোশনাল রেস্ট, অর্থাৎ আবেগীয় বিশ্রাম প্রয়োজন প্রত্যেক মানুষের। কোথায় কোন কথা বলা উচিত, কোন কথা বলা ঠিক নয়, কাকে কী বলতে হবে—এমন নানা বিষয় নিয়ে আমরা সচেষ্ট থাকি। সামাজিক বা পারিবারিক পরিবেশে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণই অনেক সময় আমাদের মুখ্য ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়। তবে নিজেকে ধোঁকা না দিয়ে আবেগ প্রকাশ করে ফেলাও খারাপ নয়; শুধু প্রকাশের ভঙ্গিটা পরিশীলিত হওয়া চাই। আমি যদি খারাপ থাকি, তবে কারও প্রশ্নের উত্তরে যদি বলি, ‘ভালো নেই’—ক্ষতি কী? কারণ ব্যাখ্যা করব কি করব না, করলেও কতটুকু করব—তা না হয় অপর ব্যক্তির ওপর নির্ভর করবে।
পরিপূর্ণ মানসিক বিশ্রাম হচ্ছে না, তার মানে সামাজিক বিশ্রামেও ঘাটতি রয়েছে। আর সামাজিক বিশ্রামের ঘাটতি থেকেই জীবনে আমরা অনেক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। কোন কোন মানুষ আমাদের ভালো দিকগুলো উজ্জীবিত করেন আর কারা জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেন—অনেক সময় বুঝতে পারি না। সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়; জীবন গঠনের রাস্তাটা হয়ে পড়ে কঠিন। বিচ্ছেদ, ব্যর্থতা, আর্থিক সমস্যা, সামাজিক সংকটে পড়ে যাই আমরা। তাই সামাজিক বিশ্রামে এমন সব মানুষের আশপাশে থাকা ভালো, যারা ইতিবাচক জীবনযাপন করেন। গঠনমূলক আলোচনা, নানা সমস্যার সমাধান, তাদের সঙ্গে সুন্দর সময় কাটানো হতে পারে এমন বিশ্রামের প্রধান অনুষঙ্গ।
অন্যদিকে, বিশ্রামের ভিন্নমাত্রা হলো আধ্যাত্মিক বিশ্রাম। শরীর ও মনের সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার পরিচয় ঘটিয়ে জীবনকর্মে প্রশান্তি আনে এটি। ধর্মীয় আচার-আচরণ বা নিয়মনীতি মেনে এই বিশ্রাম প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগ ঘটায়। ষড়রিপুর বশ থেকে নিজেকে মুক্ত করে সত্যকে সঙ্গী করে জীবন কাটানোই এ বিশ্রামের ফলাফল। সকল সৃষ্টির প্রতি আত্মীয়তা অনুভব, ভালোবাসা, গ্রহণযোগ্যতা এবং জীবাত্মার উদ্দেশ্য অনুভব করার ক্ষমতা অর্জন সম্ভব দৈনন্দিন প্রার্থনা, ধ্যান, সমাজসেবা ও বিশ্রামের মাধ্যমে।
আবার কখনো কখনো বিশ্রামও যথেষ্ট নয়। যথেষ্ট নয় গভীর ঘুম। সব ধরনের বিশ্রাম গ্রহণের পরেও কাজে ক্লান্তি আসতে পারে, দেখা দিতে পারে উদ্যমের অভাব, উদ্ভাবনেও আনন্দ আসে না, উদ্যোগে উৎসাহ পারে হারিয়ে যেতে। শরীরে ভিটামিন বা মিনারেল কম থাকতে পারে, ঘাটতি থাকতে পারে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টির, হতে পারে দীর্ঘস্থায়ী কোনো অসুখের লক্ষণ। তাই নিরবচ্ছিন্ন ঘুম বা যথাযথ বিশ্রামের পরেও যদি ক্লান্তি আসে, চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। তবে তার আগে ভেবে দেখুন, নিজের ওপর বেশি চাপ দিয়ে ফেলছেন না তো? নিজের মনের কথা, শরীরের কথা শুনছেন তো? পারফেক্ট মানুষ হতে গিয়ে বা পিছিয়ে পড়ার ভয়ে আপনার স্বাস্থ্যের সহ্যসীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন না তো?
জীবন আমার, তাই সুস্থ থাকার দায়িত্ব আমার। চলুন, আমরা শুধু বেঁচে না থেকে জীবনটাকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। বিশ্রামের গুরুত্ব ভুলে গেলে চলবে না। মনে রাখা চাই, ভালো থাকার মূলমন্ত্র—রেস্ট, রিল্যাক্সেশন, এক্সারসাইজ।
ছবি: ইন্টারনেট