ফিচার I নিরামিষে নিষ্পত্তি
নিরামিষ ভোজনে শরীরে কিছু পরিবর্তন আসতে পারে। তাই হুট করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন অনুচিত। তবে একবার নিরামিষাশী হয়ে উঠতে পারলে আছে দারুণ উপকার
নিরামিষ শব্দের মানে ‘আমিষ রহিত’। যিনি স্বেচ্ছায় মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ-রসুন এড়িয়ে খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলেন, তিনিই নিরামিষভোজী। উদ্ভিদ থেকে পাওয়া খাদ্য এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পদগুলো নিরামিষের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলার কিছু শারীরিক ও মানসিক উপকারিতা রয়েছে।
সিংহভাগ মানুষ দীর্ঘায়ু কামনা করেন। কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা রোগ। শরীরে বিষাক্ত রাসায়নিক বাড়তে থাকলে মানুষ অসুস্থ হয়। ক্ষয় হতে থাকে দেহ। ওসব মন্দ উপাদানের সঙ্গে লড়াই করতে পারে শাকসবজি। ফলে নিরামিষ খেলে দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ে। শরীরকে ক্ষতিকর কোলেস্টেরল থেকে সুরক্ষিত রাখতে উদ্ভিজ্জ ফ্যাট উপাদেয়। দক্ষিণ কোরিয়ান গবেষকেরা মত দিয়েছেন, নিরামিষভোজীদের শরীরে কোলেস্টেরল থাকে কম। সুস্থ থাকতে যতটা ভালো কোলেস্টেরল প্রয়োজন, তা নিরামিষ থেকে লাভ করা সম্ভব। মানে নিরামিষ খেয়ে বেঁচে থাকলে শরীরের তেমন ক্ষতি হয় না বলে মত অনেকের।
বর্তমানে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে জটিল স্বাস্থ্যসমস্যার মধ্যে রয়েছে স্থূলতা ও হৃদরোগ। নিরামিষভোজীরা স্থূলতা থেকে সহজে রেহাই পেতে পারেন। তা ছাড়া বেলজিয়ামের বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, নিরামিষাশীদের হৃদরোগের আশঙ্কা কম। এ ধরনের খাবার রক্তে শর্করার পরিমাণও নিয়ন্ত্রণে রাখে। মানে ডায়াবেটিসের লাগাম টেনে ধরতে পারে। তা ছাড়া রক্তে ফ্যাটি অ্যাসিডের পরিমাণও স্বাভাবিক রাখে শাকসবজি।
নিরামিষ সাধারণত ফাইবার জাতীয় হয়। শরীরের বিপাকক্ষমতা বাড়াতে আঁশজাতীয় শাকসবজি বেশ উপকারী। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিরামিষভোজীদের মেটাবলিজম বেশ উন্নত। শাকসবজির ফ্যাট বিপাকে সহায়ক। শরীরের প্রয়োজনীয় পানির চাহিদাও মেটায় নিরামিষ।
চোখের ছানির সমস্যা থেকে রেহাই দিতে পারে নিরামিষ খাদ্য। শাকাহারী মানুষের চোখে ছানি পড়ার আশঙ্কা তুলনামূলক কম। তা ছাড়া সবুজ শাকসবজিতে থাকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এই উপাদান দুটি ফ্রি রেডিক্যাল নষ্ট করে দেয়। ফলে আমাদের মগজে পুষ্টি পৌঁছায় বেশি। নিরামিষের ভিটামিন বি মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সতেজ ও কার্যকর করে তোলে। এ ছাড়াও নিরামিষ খেলে শরীরের শক্তি বাড়ে। সারা দিন চনমনে থাকা যায়।
শরীরের ভেতরে ছাড়াও ত্বকের বিভিন্ন উপকার করে নিরামিষ খাদ্য। ফল ও শাকসবজির ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বকের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখে। তা ছাড়া মানসিক উদ্বেগও কমাতে পারে। নিরামিষাশীরা মানসিকভাবে বেশ ফুরফুরে অনুভব করেন। শাকসবজিগুলো তাজা থাকলে এবং জৈব উপায়ে উৎপাদন করা হলে সেসব খেয়ে দীর্ঘদিন সুস্থ থাকা যায়। এ ধরনের খাদ্য অর্থনৈতিকভাবেও সাশ্রয়ী। তুলনামূলকভাবে কম দামের হওয়ায় খাওয়াদাওয়ার পেছনে খুব বেশি খরচ পড়ে না।
নিরামিষ খেলে শরীরে কিছু পরিবর্তন আসে। যেমন এ ধরনের খাবার থেকে খুব বেশি জিংক মেলে না। কিন্তু এই মৌল স্বাদেন্দ্রিয় ও শ্রবণেন্দ্রিয়ের ক্ষমতা বাড়ায়। ফলে নিয়মিত নিরামিষ খেলে এ দুটির ক্ষমতা কমতে পারে। তবে জিংক সাপ্লিমেন্ট খেয়ে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। নিরামিষ খাবার গ্রহণের ফলে শুরুতে মল ত্যাগে পরিবর্তন আসতে পারে। কখনো কোষ্ঠকাঠিন্য আবার কখনো অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে উদরে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিরামিষ খাবার পেটে মানিয়ে যাবে। এতে চিন্তিত হওয়ার কারণ নেই। এমনকি মল আগের চেয়েও ভালোভাবে ত্যাগ করা যাবে।
নিরামিষ খাওয়া শুরু করলে শরীরে প্রাণিজ প্রোটিন আসা বন্ধ হয়ে যায়। এতে পেশির পরিবর্তন ঘটতে পারে। আঘাত পেলে তা সেরে উঠতে বেশি সময় লাগার আশঙ্কা আছে। যারা জিম করেন কিংবা ভারী বস্তু ওঠানো-নামানোর কাজে রত, তাদের পেশি নিরামিষের সঙ্গে মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগতে পারে। কেননা এ ধরনের খাদ্যে উদ্ভিজ্জ প্রোটিন বেশি, প্রাণিজ প্রোটিন প্রায় নেই। এ কারণে কখনো কখনো নিরামিষভোজীদের বাইরে থেকে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট দেওয়া লাগতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। ভুগতে হতে পারে ক্যালরির ঘাটতিতেও। নিরামিষভোজীদের শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘনত্ব কমে যেতে পারে। তবে এসব সমস্যা এড়িয়ে শাকাহারী হওয়ারও পদ্ধতি রয়েছে।
হুট করে নিরামিষাশী হয়ে ওঠা সহজ নয়; তা হওয়া ঠিকও নয়। শরীরের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ারও ব্যাপার আছে। কেননা একধরনের খাদ্যাভ্যাস থেকে অন্য অভ্যাসে যেতে শরীরকে অনেক ধরনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তাই রয়ে-সয়ে নিরামিষাশী না হলে রয়েছে হিতে বিপরীতের ঝুঁকি। প্রথমে প্রয়োজন মানসিক প্রস্তুতি। তাই তাড়াহুড়ো না করে প্রথমে প্রতিদিনের খাবারে ধীরে ধীরে নিরামিষের পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এ সময় পাতে আমিষের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। একটা সময় দেখা যাবে, মাছ-মাংস না খেলে খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। এই অবস্থায় পুরোপুরি নিরামিষাশী হলে খুব বেশি ক্ষতি হবে না। তা ছাড়া নিরামিষাশী হওয়ার ক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় মাথায় রাখা চাই। তা হলো, জোর করে খাওয়া যাবে না। নিরামিষকে ভালোবাসতে হবে। শুধু স্বাস্থ্যের জন্যই নয়, নিরামিষ খাবারকে উপভোগ করতে হবে।
শাকসবজি দিয়ে নানা ধরনের মুখরোচক পদ রান্না করা যায়। ক্ষেত্রবিশেষে তা মাছ-মাংসের চেয়েও বেশি স্বাদের। আজকাল অন্তর্জাল ও পত্রপত্রিকায় নিরামিষের মজার পদের রেসিপি মেলে। এর জন্য আছে আলাদা বইও। সেসব দেখে দারুণ সব পদ রান্না করে খাওয়া যেতে পারে। রুচিতে বৈচিত্র্য আনতে মাঝেমধ্যে ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে নিরামিষের দেশি-বিদেশি পদ খেলে জীবনটা একঘেয়ে লাগবে না। শুধু তরকারি না খেয়ে স্যালাড ও স্যুপ করেও নিরামিষ খাওয়া সম্ভব। তা ছাড়া রেস্তোরাঁর পদগুলো বাড়িতে তৈরির চেষ্টা করা যেতে পারে।
নিরামিষ খাবারকে উপভোগ করতে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে বিখ্যাতদের মধ্যে কারা কারা নিরামিষাশী। তাদের মধ্যে পছন্দের কেউ আছেন কি না। এমন অনুসন্ধান আপনাকে অনুপ্রেরণা জোগাবে। বলে রাখি, বলিউড তারকা আমির খান নিরামিষভোজী। অভিনেত্রী আলিয়া ভাটও নিরামিষ ধরেছেন সম্প্রতি। অনেক বছর ধরেই নিরামিষ খাচ্ছেন অমিতাভ বচ্চন। কারিনা কাপুরও নিরামিষ খান। তা ছাড়া মল্লিকা শেরাওয়াত ও নেহা ধুপিয়াও নিরামিষভোজী। অ্যাকশন হিরো বিদ্যুৎ জামাল নিরামিষ খেয়েও কতটা সুঠাম রয়েছেন, সেটা তার সিনেমা দেখলেই বোঝা যায়। তাই আপনিও হয়ে উঠতে পারেন নিরামিষাশী। তবে তা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট