skip to Main Content

মনোযতন I সন্দেহ সর্পবিষ

দাম্পত্য জীবনকে সাপের মতো ছোবলে ছোবলে বিষাক্ত করে তোলে সন্দেহ নামের এক ভয়ানক মনোব্যাধি। রক্ষা পাওয়ার কী উপায়? জানাচ্ছেন আশিক মুস্তাফা

প্রিয় মানুষটাকে কাছে পেলেই আপনি ডানা ঝাপটানো শুরু করেন। আপনার উড়ো মনে প্রজাপতির মতো রং ছড়ায় রাজ্যের আনন্দ-উল্লাস। উড়ে উড়ে ঘুরে বেড়ায় কত রোমাঞ্চকর ব্যাপার-স্যাপার! একান্ত প্রিয় মানুষটির মনের হাত ধরে সাগরতীরের মতো নাগরিক ফুটপাতে বসেও আড্ডায় বাদামের খোসায় কিংবা ফুচকার প্লেট থেকে পষ্ট ঢেউয়ের শব্দ শুনতে পান। সন্ধ্যার কনে দেখা আলোয় হেঁটে পৃথিবীর রং খুঁজতে খুঁজতে যখন হেঁটে বেড়ান, তখন নিজেকে নিয়ে গর্বই করেন। তবে এই প্রিয় মানুষে বুঁদ হওয়া, প্রকৃতিবাজ আর সৃজনশীল আপনার ভেতর মাঝেমধ্যে আলতো করে গুঁতো দেয় সন্দেহ নামের বিষধর এক সাপ। যার দাঁত থেকে ঝরে পড়ে মন্দ আর সম্পর্ক খারাপের বিষ। খারাপের মোড়কে প্যাঁচানো সন্দেহ নামের এই সাপ আপনার প্রিয় মানুষের সঙ্গে কাটানো সময়, একান্ত অনুভূতি আর অ্যাইম ইন লাইফটাকে যেকোনো সময় বিষিয়ে দিতে ওত পেতে থাকে। তাই বলে চুপসে থাকবেন আপনি? মুক্তির পথ খুঁজবেন না?
ইতিহাসের পাঠ
একটু চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, প্রিয় মানুষটি কেন আপনাকে ঈর্ষা করে। কেন আপনাকে দেখলেই আড়চোখে তাকায়। ক্যাম্পাস, বাড়ি কিংবা অফিসে যখন যেখানে আপনার দেখা পায়, সেখানেই ফোড়ন কাটে? কী, চোখ খোলা রেখেই মস্তিষ্ক থেকে সেই কারণগুলোর ডিজিটাল প্রিন্ট দিতে পারছেন? বলি, মানবজাতির আজকের যে ইতিহাস, এর পেছনেও আছে সন্দেহের চোখ রাঙানি। ইতিহাসে চোখ বোলালেই দেখবেন যত কাটাকাটি, খুনোখুনি আর ভাঙা-গড়ার খেলা—সবকিছুতেই সন্দেহের ছিল সরব উপস্থিতি। সেই আদি যুগ থেকে যে নেতিবাচক আবেগটি এককভাবে সংসারের সুখকে নিঃশেষ করার জন্য যথেষ্ট, তা হলো সন্দেহ। এটি বিভিন্ন রূপে আমাদের সম্পর্কে অনুপ্রবেশ করে। এটা কারও কারও মধ্যে থাকে স্বাভাবিক পর্যায়ে, আবার কারও মধ্যে প্রকাশ পায় অস্বাভাবিক অসুস্থতা রূপে। তখন ভাঙন ধরে সম্পর্কে। এক হিসাবে দেখা যায়, আমাদের রাজধানীতে প্রতিদিন গড়ে ৫০টি ডিভোর্সের ঘটনা ঘটে। দেশজুড়ে এই সংখ্যা কত বেশি, ভাবাও যাচ্ছে না!
প্রশ্নের উঁকি
ইতিহাসের হাত ধরে সন্দেহ ছড়িয়ে আছে আমাদের সমাজ, পরিবারসহ সবখানে। সন্দেহ নামের এই আফিমে আসক্তির শিকার হলেই বুঝে নিতে হবে, আপনি এই মানসিক রোগটাকে আপন করে প্রিয় মানুষটাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। তবে এ-ও ঠিক, কম-বেশি সব মানুষের মধ্যেই থাকে সন্দেহের বীজ। সম্পর্কে এই সন্দেহবীজ যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখনই বাধে গন্ডগোল। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু—এসবই বিশ্বাসের সম্পর্ক। আর অন্য সম্পর্কগুলো—মা-বাবা সন্তান, ভাই-বোন রক্তের বন্ধনে অবিচ্ছেদ্য। এই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কেও দূরত্ব বাড়ায় সন্দেহ। চিড়ও ধরায়। আর দাম্পত্য জীবনে আপনার মনটাকে বিচলিত করে তোলে; মনে প্রশ্ন জাগায়, ‘ও আমাকে ভালোবাসে তো?’
কলহের সূত্রপাত
প্রযুক্তি জীবনকে করছে গতিশীল। মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামে প্রতিনিয়ত বাড়ছে আমাদের পরিচিতি। সেই সঙ্গে বাড়ছে অপ্রয়োজনীয় সম্পর্ক। বাড়ছে নেতিবাচক আবেগ ও অনুভূতি, যা অন্য সম্পর্কগুলোর পাশাপাশি টানাপোড়েন সৃষ্টি করছে বৈবাহিক সম্পর্কেও। অথচ, দাম্পত্য জীবনে সুখের হাওয়া বইয়ে নিয়ে আসে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্মান ও সহমর্মিতার ডানা। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা ও সহানুভূতি যত গভীর হয়, দুজনের বন্ধনটাও তত দৃঢ় হতে থাকে। আর যখনই এই সম্পর্কে বিশ্বাস ও ভালোবাসার বদলে অনুপ্রবেশ করে অবিশ্বাস ও সন্দেহ, তখনই বাড়তে থাকে দূরত্ব। যার ফল দাম্পত্যে কলহ, নির্যাতন এবং অবশেষে পরিবারে ভাঙন। অধিকাংশ দাম্পত্য কলহের সূত্রপাত ঘটে স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি সন্দেহপ্রবণতা থেকেই।
বেড়ে ওঠা বিষবৃক্ষ
আপনি যখন নেতিবাচক আচরণে জড়িয়ে যাবেন, অনায়াসেই আপনার আচরণে আসবে পরিবর্তন। আর তা দেখে কাছের মানুষটির সন্দেহের তীর নিশানা খুঁজতে থাকবে। তখন আপনি অতিরিক্ত টাকা খরচ করবেন। আপনার নিয়মিত রুটিনেও আসবে পরিবর্তন, যেমন অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরবেন। আর এর জন্য কিছু অযৌক্তিক যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করবেন। এ ছাড়া হুটহাট ঝগড়ায় এবং মেজাজ দেখানোতে পোক্ত হয়ে উঠবেন। তবে এটাও সত্য, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিগুলো থাকবে। দৈনন্দিন মানসিক চাপ, অস্থিরতা ও টেনশন থাকবেই। মান-অভিমান, ভুল-বোঝাবুঝি, রাগ-অনুরাগ—সবই জীবন চলার অনুষঙ্গ। কিন্তু লোকদেখানো আদিখ্যেতা অনেক ক্ষেত্রে সন্দেহের জন্ম দেয়। বাড়াবাড়ি আচরণ অনেক সময় ইঙ্গিত দেয়, ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!’
নেপথ্যে
বাস্তব জীবন আপন করে প্রিয় মানুষকে হৃদয়ের একান্ত গহিন গোপনে নিয়ে চলছেন ঠিকই, কিন্তু নেপথ্যে বাজছে সন্দেহ সংগীত। এই সংগীত আপনাকে আপন করে নেয় নানাভাবে। সেটা হতে পারে কাজের কারণে ঘরের বাইরে বেশি সময় দেওয়া থেকে। কিংবা সন্তানকে স্কুল-কোচিংয়ে আনা-নেওয়া, বাজার করা, সংসারে অন্যান্য দায়িত্ব পালন করা থেকে। এতে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে যথেষ্ট কাছে পান না। কথায় আছে, ‘আউট অব সাইট, আউট অব মাইন্ড’। আর তখনই তৃতীয় পক্ষ নাক গলানোর সুযোগ পেয়ে যায়। এতে সন্দেহের তীব্রতা যায় বেড়ে। তখন তা আর নেহাত সন্দেহ থাকে না। আশঙ্কা দেখা দেয় বিবাদের, বিভাজনের।
সমাধানের পাঠ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, লেখক ও অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হকের মতে, ‘সন্দেহ একটি মানসিক রোগ। এই রোগ ভালো হয় ওষুধ ছাড়াই। দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী যে কারও এটা হতে পারে; এবং তাদের যে এটা ঠিক হচ্ছে না, সেটাও তারা বুঝতে পারেন। কিন্তু কোনোভাবেই সন্দেহের জাল থেকে বের হতে পারেন না অনেক সময়। ফলে পরবর্তীকালে এই নিয়ে তার মনে একটা কষ্ট এবং এ থেকে অনুশোচনা জন্ম নেয়।’
‘আসলে আপনি যদি নিজের জীবনসঙ্গীকে সবচেয়ে ভালো মানুষ হিসেবে ভাবতে না পারেন, তাহলে সুখী হতে পারবেন না কখনো। তাই সব নারীই ভালো, কিন্তু আমার স্ত্রীর জুড়ি নেই—সব পুরুষের এমনটাই ভাবা উচিত। একইভাবে প্রত্যেক স্ত্রীরও ভাবা উচিত, আমার স্বামী পৃথিবীতে সবচেয়ে ভালো স্বামী,’ যোগ করেন এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
সন্দেহ থেকে বেরিয়ে আসার কিছু পথও বাতলে দিয়েছেন অধ্যাপক আনোয়ারা সৈয়দ হক। যেমন—
 তৃতীয় পক্ষ থেকে সাবধান: দাম্পত্য জীবনে অশান্তি জন্মানোর অন্যতম কারণ সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের থাবা; অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝি হলে তৃতীয় পক্ষ বা আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশীদের জড়ানো। তাই সম্পর্কের জটিলতায় সব সময় সরাসরি কথা বলুন। কাউকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করবেন না।
 ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবনা: অন্যের সম্পর্কে কিছু ভাবার আগে নিজের অবস্থান নিয়ে ভাবুন। নেতিবাচক আবেগে মন তিক্ত হওয়ার আগে সুযোগ বুঝে সরাসরি কথা বলুন। যদি তার কোনো অক্ষমতা থাকে, সেটা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করুন। জীবনসঙ্গীর ভালো দিকগুলো তুলে ধরুন। এতে তিনি ভুল সংশোধনে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন। এর পাশাপাশি, একে অপরের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে শিখুন।
 শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান: কর্মস্থলে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সুসম্পর্ক তৈরির ভিত্তিতে নারী-পুরুষ সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু অনেকের দাম্পত্য জীবনে এটা হয়ে ওঠে অশান্তির কারণ। অনেক পুরুষ বা নারী স্ত্রী কিংবা স্বামীকে নিজের সম্পত্তি মনে করেন এবং অন্য কারও সঙ্গে তার কথা বলাটাকেও সন্দেহের চোখে দেখেন। এর পেছনে থাকে না কোনো যৌক্তিক কারণ কিংবা প্রমাণ। যেমন স্ত্রী পড়াশোনা কিংবা চাকরি করতে গিয়ে অন্য কারও সঙ্গে প্রেম করে কি না, অথবা স্বামী চাকরি করতে গেলে অফিসের বস বা কলিগ কারও সঙ্গে তার ভাব হয় কি না। এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ পায় সন্দেহ রূপে। এ জন্য বিপরীত লিঙ্গের সহকর্মী কিংবা সহপাঠীর সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে আপনাকেই। যদি এমন হয়, নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তিকে নিয়ে সমস্যা এবং তার সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা হয়, অথচ দেখা না হলেও চলে, তাহলে তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলাই শ্রেয়। কারণ, ঘরে অশান্তি করে আপনি সুখী হবেন না। আর কখনো এমন মানুষগুলোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে জীবনসঙ্গীর সামনেই তাদের সঙ্গে কথা বলুন, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন।
 অতীতের সম্পর্ক: বিয়ের আগে স্বামী বা স্ত্রী যে কারও প্রেমের সম্পর্ক কিংবা কোনো গোপন বিষয় থাকতেই পারে। কিন্তু বিয়ের পরে উভয় পক্ষই যদি এই বিষয় অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা করার চেষ্টা করেন, তা শুধু জটিলতা তৈরি করবে। কারণ, বিয়ের পর যদি স্বামী ও স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার মানসিকতা রাখতে পারেন, তাহলে বিয়ের আগে কী কী হয়েছে—এসব নিয়ে মাথা ঘামানো উচিত নয়। এমনকি এগুলো পরস্পরকে বলারও কিছু নেই। কারণ, অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না। যেতে হয় ভবিষ্যতে।
 ভুলের মাশুল: মানুষমাত্রই ভুল করে। আর এই ভুলের মাধ্যমেই পায় জীবনের নানা পাঠ। সঙ্গী যদি ভুলটা উপলব্ধি করে নিজ থেকে ফিরে আসতে চায়, তখন আপনি কী করবেন? ফিরিয়ে দেবেন? নাকি মেনে নেবেন? পরবর্তী ভুলের জন্য অপেক্ষায় থাকবেন? সারাক্ষণ টেনশনে থাকবেন আবার কখন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে? চোখে চোখে রাখবেন? এ অসম্ভব! বিশ্বাস যদি ভঙ্গুরও হয়, তবু অনেক সময় সংসার-সন্তানের খাতিরে, সমাজের খাতিরে একই ছাদের নিচে সহাবস্থান করতে হয় বৈকি। যদি মনে করেন, না, সম্ভব নয়, এভাবে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবেন, সে ক্ষেত্রে যেকোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যথেষ্ট সময় নিন।
আনন্দের ইশারা
আপনার ঘরের কোণে, স্টোর রুমে বেখেয়ালে বেড়ে ওঠা মাকড়সার জালে চোখ রেখেছেন কখনো? মাকড়সার কঙ্কাল তার শরীরের বাইরে থাকে। এই মাকড়সার মতো সন্দেহ নামের অশুভ দানবটা বাইরে থেকে এসে আমাদের মস্তিষ্কে দানা বেঁধে সম্পর্কগুলোকে হাঙরের মতো কামড়ে খায়! হ্যাঁ, আপনি যতই আধুনিক, মেধাবী আর আত্মসচেতন হোন না কেন, সন্দেহকে যদি মাকড়সার কঙ্কালের মতো শরীর থেকে আলাদা করতে না পারেন, তাহলে আপনার স্বপ্নের সম্পর্ক, আবেগ, মনের চূড়ান্ত ইচ্ছাশক্তি—সবই বৃথা হয়ে যাবে।
সন্দেহ নামের এই বিষধর সাপ অন্যের ক্ষতি করতে না পারলেও ঠিকই আপনার সুন্দর পৃথিবীটা ধ্বংস করে দিয়ে যাবে ব্ল্যাক ম্যাজিক্যাল ছোবলে। বিষ ছড়িয়ে দেবে আপনার ভালো সম্পর্কে। তাই এমন আত্মঘাতী বাতিক না পুষে একে বিদায় করে হাঁপ ছেড়ে বাঁচুন। নিজের জগৎটাকে, প্রিয় মানুষটাকে নতুন করে দেখুন আর হেসে উঠুন নিজের সঙ্গে, মেতে উঠুন অপার আনন্দে!

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top