ফিচার I সজ্জা সারথি
সায়মুল করিম। এস্কে ডেকর ও এসকে ইভেন্টসের কর্ণধার। তার পথচলা আর পরিকল্পনার গল্প
সময়ের বিবর্তনে আমরা বিকশিত হচ্ছি। সেই সঙ্গে কিছু জিনিস আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিলাসবহুল আসবাবের সহজলভ্যতা এবং ঝামেলামুক্ত ইভেন্ট আয়োজনের ক্ষেত্রে পেশাদারদের সাহায্য চাওয়া সম্ভবত ১০ বছর আগেও খুব একটা অগ্রাধিকার পেত না। তবে এর প্রয়োজনীয়তা সায়মুল করিম বেশ আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। তাই অনেকেই তাকে দেশে এই শিল্পের অন্যতম পথপ্রদর্শক গণ্য করে।
২০১০ সালের শুরুর দিকে সায়মুল যখন ডিজাইনার হিসেবে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ শুরু করেছিলেন, তখনই বুঝতে পারেন, এ সেক্টরে তার নিজেরও কিছু করার সম্ভাবনা রয়েছে। মূলত এই চিন্তা থেকেই তার প্রতিষ্ঠান এসকে ডেকর ও এসকে ইভেন্টসের যাত্রা শুরু।
সায়মুল করিমের পরিবারের সবাই ছিলেন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। কিছুটা স্রোতের বিপরীতে আর কিছুটা পরিস্থিতি সায়মুলকে সৃজনশীল এই পেশা ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়, জানালেন নিজেই। রাজধানীর পুরানা পল্টনে বেড়ে ওঠার ফলে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা ও আপডেটেড বিষয়ে নিজের বিকাশ ঘটাতে পারতেন বলে জানালেন। ছোটবেলা থেকে শিল্প, সংস্কৃতি, ড্রয়িং ও হ্যান্ডিক্রাফটে দারুণ পারদর্শী ছিলেন। স্কুলের পরীক্ষায় এসব বিষয়ে পেতেন ঈর্ষণীয় নম্বর। ছেলের এই প্রতিভা দেখে তা বিকাশের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তা-ই এনে দিতেন সায়মুলের বাবা। বাবার কাছ থেকে পাওয়া বই, খাতা, স্কেচবুক, ব্র্যান্ডের কালার পেনসিল, ওয়াটার কালার দিয়ে অনুশীলনে বসে পড়তেন সায়মুল। ক্লাস সেভেনে পড়াকালে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা তার কাছ থেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাজসজ্জার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা নিতে শুরু করেন। সেখান থেকেই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের বীজ রোপণ হতে থাকে তার মনে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর সায়মুলের ইচ্ছা ছিল ফ্যাশন ডিজাইনিং কিংবা চারুকলায় পড়ার। বাবার আগ্রহের কারণে বিধি বাম! পড়তে শুরু করলেন ঢাকা কমার্স কলেজে, অ্যাকাউন্টিংয়ে। এরপর দুঃস্বপ্নের মতো একটা ঝড় বয়ে যায় তার জীবনে। ১৯৯৭ সালে দুর্ঘটনার কারণে হাঁটু প্রতিস্থাপন করতে হয় তার। থমকে যায় পড়াশোনা। সেই ঝড় সামলিয়ে আবারও প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা শুরু করেন। এবার ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। সেই সময় ফ্যাশন ডিজাইনারদের সঙ্গে থেকে এবং বিভিন্ন ফ্যাশন শোতে পর্দার ও-পাশে কাজ শুরু করেন। কাজ শিখতে গিয়ে খুঁজে পান কয়েকজন মেন্টর, যারা সার্বক্ষণিক ছায়া দিয়ে তাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিলেন।
বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ও করপোরেট হাউসে ফ্রিল্যান্সিং করতে থাকেন সায়মুল। ফ্যাব্রিক সম্পর্কে ভালো আইডিয়া থাকা, কালার কম্বিনেশন বুঝতে পারার কারণে বেশ গ্রহণযোগ্যতা পান। তার কাজের বড় বৈশিষ্ট্য ছিল প্রথাগত ও প্রচলিত কিছু বেসিক রঙের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের রং নিয়ে খেলতে পারা। এরপর আসে তার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়। কাজ শুরু করেন একটি ফার্নিচার দোকানে, ডিজাইনার হিসেবে। চার বছর সেখানে কাজ করার পরে নিজে থেকে কিছু একটা করার তাড়না তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সেই তাড়নায় শুরু করেন ইন্টেরিয়র, ফার্নিচার নিয়ে কাজ করার ভাবনা। শুরু করেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনাও।
‘ডেকরের প্রতি আমার সব সময়ই ভিন্ন ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তাই নিজের আবেগকে যখন পেশায় পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, জানতাম ক্লায়েন্টদের জন্য আমাকে এমন কিছু আনতে হবে, যা অন্য কেউ বাজারে আনেনি এবং আনবে না,’ সায়মুল এভাবে এসকে ডেকরের পেছনের ভাবনা খোলাসা করলেন।
এসকে ডেকর ভিন্ন কিছু তৈরির জন্য কল্পনাপ্রসূত ডিজাইনকে বিলাসবহুল আসবাব সামগ্রীতে প্রয়োগ করে দেয় আভিজাত্যের ছোঁয়া। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি আসবাবই বিলাসিতাকে নিরূপণ করে—সেটা বেড বেস, চামড়ার সোফা, শক্ত কাঠের ডাইনিং টেবিল কিংবা সাইড বোর্ড—যা-ই হোক না কেন। সায়মুল নিশ্চিত করেন, গুণমান ও নান্দনিকতার প্রসঙ্গে কখনোই আপোস না করা। তিনি বলেন, ‘এসকে ডেকরে আপনি যে জিনিসগুলো পাবেন, তা কেবল আসবাব নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। এগুলো শিল্প ও বিলাসিতার একধরনের কম্বিনেশন। আমাদের আসবাবে আপনি বিলাসিতা, ট্র্যাডিশনাল, ফিউশন, ভিক্টোরিয়ান, অ্যাসথেটিক—সবকিছুর ছোঁয়া পাবেন।’
সায়মুল করিমের আরেকটি সফল উদ্যোগের নাম এসকে ইভেন্টস। বিভিন্ন অনুষ্ঠান থিমভিত্তিক উদযাপনে বিশেষজ্ঞ এস্কে ইভেন্টস ক্লায়েন্টদের প্রয়োজন অনুসারে পরিষেবা দিয়ে থাকে। আউটডোর সেটিংস থেকে হলরুম পর্যন্ত, ভেন্যু যা-ই হোক না কেন, ক্লায়েন্টদের স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে এই প্রতিষ্ঠান, এমনটাই জানালেন সায়মুল।
এসকে ইভেন্টস এখন পর্যন্ত এমন কিছু ইভেন্ট আয়োজন করতে পেরেছে, যেগুলো দেশের নেটিজেনদের মধ্যে আগ্রহ ও আলোচনার কেন্দ্রে পরিণত হয়। নিজের জন্মদিন জমকালোভাবে উদযাপন করায় খ্যাতি আছে অভিনেত্রী পরীমনির। সেই আয়োজনে তিনি এসকে ইভেন্টের সার্ভিস নিয়েছিলেন।
‘এ ধরনের আয়োজনের পেছনে ক্লায়েন্টের অনেক প্রত্যাশা ছিল। বহু প্রতীক্ষিত এই জন্মদিনের আয়োজন করা ছিল বেশ ঝামেলাপূর্ণ। আমাদের দিকে নজর ছিল সবার। তবে দিনের শেষে, আয়োজনটি সফল করতে পেরেছিলাম আমরা,’ বলেন সায়মুল করিম।
অভিনেত্রী বিদ্যা সিনহা সাহা মিমের বাগদান অনুষ্ঠানের জন্য একটি মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি করেছিল এসকে ইভেন্ট। এই ইভেন্টের নেপথ্য চিন্তাভাবনা সম্পর্কে সায়মুল বলেন, ‘বিশেষ দিনটি ঘিরে মিমের নির্দিষ্ট একটি দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি সমসাময়িক সাজসজ্জা চেয়েছিলেন, যা তার বন্ধুবান্ধব ও পরিবারকে নির্বিঘেœ দিনটি উপভোগ করতে দেবে। আমরা তার জন্য সেটিই লক্ষ্য হিসেবে রেখেছিলাম।’
শিল্প ও সাজসজ্জার প্রতি অনুরাগী সায়মুল করিম সব সময় নান্দনিকতা ও কার্যকারিতার মধ্যে একটি মধুর ভারসাম্য তৈরির উপায় খুঁজে নেন। যদিও করোনা অতিমারির দিনগুলোতে তার কিছু পরিকল্পনা বাধাগ্রস্ত হয়েছিল, তবু চলতি বছর থেকে নিজেকে ও নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও উঁচুতে নেওয়ার স্বপ্ন তার।
সায়মুল বলেন, ‘কোভিড সময়কাল আমাদের জন্য একটি ধাক্কা ছিল। কিন্তু ২০২২-এর শুরু থেকে পরিস্থিতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২০২৩ সালে আমাদের ব্যবসা আরও প্রসারিত হবে এবং ঢাকার বাইরের মানুষের কাছেও পৌঁছতে পারব, এই আশা রাখছি। বর্তমানে বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতি সবাইকে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব মাথায় রেখেই এগিয়ে যেতে চাই।’
i ফুয়াদ রূহানী খান
ছবি: সায়মুল করিমের সৌজন্যে