ছুটিরঘণ্টা I অপ্সরার আবাসে
যেন রূপকথার মতো, আকাশ থেকে সুগন্ধি ফুল হয়ে ঝরে ঝরে ধরণিতে ধরা দিয়েছে তারা, ছোট ছোট দ্বীপ হয়ে! কারা তারা? কোথায় আবাস? জানাচ্ছেন ফাতিমা জাহান
মিয়ানমারের বাগান শহর থেকে বাসে করে ম্যান্ডালে বা মান্দালে শহরে যাচ্ছিলাম। সাত-আট ঘণ্টার পথ, তাই যাত্রীদের মনোরঞ্জনের জন্য টিভিতে স্থানীয় নাটক দেখানো হচ্ছিল। বার্মিজ ভাষা বুঝি না; তবু নাটকটা বেশ উপভোগ করছিলাম। সুখী পরিবারে মা, বাবা, মেয়ে ও মেয়েজামাই একসঙ্গে থাকে। অবাক হয়তো অনেকেই হবেন, ঘরজামাই আবার সুখী হয় কী করে! আমি পূর্ব এশিয়ার যত দেশে গিয়েছি, কোনো দেশেই ঘরজামাই হওয়া কোনো লজ্জা বা অপরাধ নয়; বরং খুবই সাধারণ ব্যাপার। নিজেদের এবং মা-বাবার সুবিধার জন্য স্বামী-স্ত্রী পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, কোথায় পাতবেন সংসার। তাতে না আছে মিথ্যে অহমিকা, না কাউকে নিপীড়নের মনোভাব।
নাটকটির কাহিনি হলো, শ্বশুর পরকীয়া করতে গিয়ে শাশুড়ির হাতে ধরা পড়েছে এবং উপহারস্বরূপ শ্বশুর ও মেয়েজামাইকে একেবারে মেরেধরে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে শাশুড়ি! তার ধারণা, শ্বশুরের পরকীয়ায় মেয়েজামাইয়েরও রয়েছে হাত।
খুব আক্ষেপ হচ্ছিল সহযাত্রী কাউকে চিনি না বলে। নয়তো বলতাম, ‘তোমাদের দেশে পুরুষ স্বাধীনতা বলে কিচ্ছু নেই!’ আমাদের দেশে কী হয়, তা অবশ্য বলতাম না; দেশের ভাবমূর্তি বলে একটা ব্যাপার আছে না!
মান্দালেতে পৌঁছে হোটেল খুঁজে পেতে তেমন অসুবিধা হলো না। আগে থেকেই অনলাইনে বুক করা ছিল। বাসস্ট্যান্ড থেকে আমি আর একজন ইউরোপীয় মেয়ে হেঁটেই খুঁজে পেলাম। ছিমছাম, ছোট হোটেল। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি বুঝিয়ে দিলেন নিয়মকানুন। রুম সার্ভিসেও দেখি মেয়েরাই কাজ করছেন।
একসময় মিয়ানমারে মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। এখানে আসার আগে যে চিত্র আমার চোখে ভাসত, তা হলো, একটি মেয়ে ঘোড়ার গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে আর পথের সব পুরুষকে এটা-সেটা করার নির্দেশ দিচ্ছে। বেশ শাসন করছে আরকি।
হোটেলে ব্যাগ রেখে চললাম স্থানীয় মার্কেট দেখতে। ততক্ষণে বিকেল হয়ে এসেছে বলে কোনো মন্দির বা প্যাগোডা খুঁটিয়ে দেখার সময় নেই আর। সরগরম বাজারের নাম ‘যেই চো মার্কেট’। কাপড়, জুতা, গয়না, ব্যাগ, প্রসাধনী, স্যুভেনির, গৃহসজ্জার সামগ্রী, পেইন্টিং, হস্তশিল্প থেকে শুরু করে বেকারি, রেস্তোরাঁ, কাঁচাবাজার, মুদিসামগ্রী … কী নেই এখানে! বিশাল এই বাজারের প্রায় সব দোকানিই নারী। পুরুষ নিজে থেকে অস্তিত্ব জানান না দিলে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মনে হলো যেন চলে এসেছি কোনো কল্পিত নারীস্থানে। আমাদের দেশে যেমন নারী দোকানি খুব অল্প হলেও তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনতে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, এ দেশে তেমন নয়। পুরুষ ক্রেতার সঙ্গেও নারী দোকানিরা সাবলীল। মিয়ানমারকে বলা হয় বিশ্বের অন্যতম নিরাপদ দেশ। লাখ লাখ টাকা নিয়ে মাঝরাতে পথে পথে ঘুরলেও ছিনতাইয়ের ভয় নেই; তেমনি কোনো মেয়ে মাঝরাতে একা বেরোলেও তাকে কেউ উত্ত্যক্ত করে না।
নানা রঙিন পণ্যে ঝকমক করছে যেই চো মার্কেট। বাজারটির ভেতরে আমাদের ঢাকার গাউছিয়া মার্কেটের মতো সরু গলি আছে; কিন্তু গিজগিজে ভিড় নেই। আমি ঘুরে ঘুরে কিছু পাপেট আর কাঠের কারুকাজের দোকান দেখলাম। সকল খোদাই বা চিত্রকর্মে গৌতম বুদ্ধ বিশাল আসন করে নিয়েছেন। এ দেশের রত্নভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে মাটি ও সমুদ্র। অন্য অনেক দেশের চেয়ে অনেক কম দামে এখানে মণিমুক্তা কিনতে পাওয়া যায়। বাজারের রঙিন অলিগলি ঘুরেফিরে আমি বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আকাশ লাল রঙের চাদর জড়িয়েছে। ইয়াঙ্গুনে থাকাকালে এক বার্মিজ বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘এখানে পুরুষ কোথায়? তারা কোথায় কাজ করেন?’ সে হেসে বলেছিল, তার ঘরের পুরুষ এখন বাড়িতে কাপড় ধুচ্ছেন। মজা করেই বলেছিল। পুরুষেরাও এখানে নারীদের পাশাপাশি কাজ করেন। আমাদের দেশে নারীদের বাইরে এত বেশি কাজ করতে দেখি না বলে আমার চোখ অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি।
ছোটবেলায় চীন দেশের রূপকথায় অপ্সরাদের গল্প পড়েছি। আমার সামনে এই কর্মজীবী নারীরা একেকজন অপ্সরা যেন। আকাশ থেকে সুগন্ধি ফুল হয়ে ঝরে ঝরে ধরণিতে ধরা দিয়েছে বাজারের মাঝে ছোট ছোট দ্বীপ হয়ে। নানান পসরা সাজিয়েছে হরেক রঙের সৌন্দর্য হয়ে।
বাইরে মূল সড়কে তখন সারি সারি স্টল বসে গেছে খাবারের। মিয়ানমারের খাবার বৈচিত্র্যময় এবং বিভিন্ন রঙে রঙিন। অনেক খাবারের নাম জানি না আমি। প্রায় সব খাবারের স্টলে কাজ করছেন নারীরা। এ যেন নারীদের নিজস্ব এক দেশ!
এত এত খাবারের ভিড়ে কিছু চেনা খাবার চোখে পড়ল—মোহিঙ্গা (একধরনের স্যুপ, যার মধ্যে সেদ্ধ ডিম, নুডলস, ভাজা শিমের বীজ ইত্যাদি থাকে), নান গিয়ো থোটে (জুসি চিকেন নুডলস), স্যুপ নুডলস, কোকোনাট নুডলস, সি তামিন (স্টিকি রাইস)। এ ছাড়া ডিপ ফ্রাইড বা কড়া ভাজা মাছ, চিংড়ি, মাংস প্রভৃতি তো আছেই। জুস আর মিষ্টান্ন যদি চাখতেও দেওয়া হয়, তাহলে এদের এত ধরন যে, মাস পার হয়ে যাবে! আমি এক বাটি নান গিয়ো থোটে আর এক বাটি ফালুদা নিয়ে চাঁদের আলোয় বসলাম। পূর্ণিমা সবে দেখে এসেছি বাগান শহর থেকে। চাঁদ এখনো রুপো বিলাচ্ছে, ছলকে ছলকে উঠছে বাতাস এখানে। ঠান্ডা পড়ে না এ শহরে; তবে রাতের আবহাওয়া সাবলীল, শীতের বাতাস যেন স্নিগ্ধ পরশ বোলায় গায়ে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের নারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা’। এ দেশের নারীরা এমনিতেই জাগ্রত আছেন। তাদের সামাজিক অবস্থান, অর্থনীতিতে অবদান—সবই পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে। এমনকি আলাদা করে বলার উপায় নেই—এটা নারীদের কাজ কিংবা ওটা পুরুষদের।
পরদিন প্রথমে চললাম মান্দালে শহরের রয়েল প্যালেস বা রাজপ্রাসাদ দেখতে। একটা স্কুটি ভাড়া করতে হলো সারা দিন ঘুরে বেড়ানোর জন্য। পূর্ব এশিয়ার এই ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগে, যেকোনো শহরেই চলাফেরা করার জন্য স্কুটি ভাড়া পাওয়া যায়।
এই রাজপ্রাসাদ আমি কল্পনায় বহুবার দেখেছি! অমিতাভ ঘোষের ‘দ্য গ্লাস প্যালেস’ বই পড়ে কত কী যে কল্পনা করেছি, সে আমিই জানি। বাইরে গোলাকার জলাশয় দিয়ে ঘেরা রাজপ্রাসাদ আর দুর্গ। ১৮৫৭ সালে প্রাসাদটি নির্মাণ করেন এ শহরের শেষ রাজা মিনদোন। বার্মিজ রাজধানী এখানেই গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু অল্প কিছুদিন পর ইংরেজদের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন। ফলে সেই আশা পূরণ হয়নি তার।
প্রবেশদ্বার দিয়ে অন্দরে প্রবেশ করতেই চোখ ঝলমলিয়ে উঠল সোনা রঙের প্রাসাদের বহিরঙ্গ দেখে। মিয়ানমারের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য প্রাসাদ বা প্যাগোডা এ রকম ঐশ্বর্যময়। দেখলে মনে হবে কতই না গুপ্ত রত্নভান্ডার লুকিয়ে আছে এখানে। আসলে প্রায় সব ভবনই কাঠের তৈরি; চৌকোনা তার ছাদ, প্রথাগত বার্মিজ স্থাপত্যশিল্প। আর এই কাঠের কারুকাজের ওপর সোনালি রং করা বলে ভবনগুলো এত উজ্জ্বল।
মূল প্রাসাদের দরবার হল আগাগোড়া সোনালি রঙের হলেও অন্যান্য একতলা ভবনের রং বাদামি ও খয়েরি। এসব খুঁটিয়ে দেখার আগেই আমার সামনে কলকল করতে লাগলেন নানা রঙের পদ্মের মতো এই জগতের অপ্সরারা। হেসে একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ছেন। মিয়ানমারে নারী-পুরুষ সবাই ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরেন। অফিস আদালত বা অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা কোনো পোশাক নেই; নারী-পুরুষের একটাই পোশাক—লুঙ্গি। আর ঊর্ধ্বাঙ্গে শার্ট।
রাজপ্রাসাদের এই অনন্যা সুন্দরী জাগ্রত, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বহ্নিশিখারা সদ্য পাস করেছেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই স্মৃতি তাজা রাখার জন্য ফটোসেশন করতে এসেছেন প্রাসাদে। দামি রেশমের লুঙ্গি আর শার্ট পরিহিত সবাই। আমার ক্যামেরার সামনেও সাবলীল কয়েকটি পোজ দিলেন। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে এটা কল্পনা করা যায় না। ভিনদেশি কেউ ছবি তুলতে চাইলে আমরা সাধারণত আতঙ্কিত হই, নয়তো অস্বস্তিতে পড়ি। অথচ মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ। আর মান্দালে তো একেবারে বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষে ছড়িয়ে আছে। তবু দেশে দেশে সংস্কৃতি ও আচরণে কত পার্থক্য!
প্রাসাদ দেখে আমি চললাম শহরের অপর প্রান্তে, ইরাবাদী নদীর ওপাড়ের মিনগুন পাথোদোগি দেখতে। ইরাবাদী নদীটি মিয়ানমারের অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে। ধর্মশালা মিনগুন পাথোদোগির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ১৭৯০ সালে। পাহাড়ের ওপর নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন রাজা বোদোপায়া। কিন্তু সে কাজ শেষ করা হয়নি। স্থাপনাটি আজও অসম্পন্ন। তবে ভক্তরা এখানে নৈবেদ্য দিতে আসেন। ভিক্ষুরা নিয়মিত ফুল উৎসর্গ করে মন্ত্র পাঠ করেন। আমি এখানে বেশ কয়েকজন দেবী প্রতিমার রূপে গোলাপি শার্ট, কমলা লুঙ্গি আর বাদামি বর্ণের উত্তরীয় পরিহিত ভিক্ষু দেখলাম; যাদের বয়স ৫ থেকে ১৫ বছর। এই মেয়েরা সবাই শিক্ষার্থী। মাথা কামানো থাকলেও তাদের নিষ্পাপ সৌন্দর্য এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। বৌদ্ধধর্মপ্রধান কোনো দেশে আমি এর আগে নারী ভিক্ষু দেখিনি। অথচ মিয়ানমারের প্রতিটি শহর, প্রতিটি গ্রামে তা দেখেছি। পুরুষ ভিক্ষুর মতোই এরা মন্ত্রপাঠ, নৈবেদ্য দেওয়া, সকালবেলা দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যাওয়া—এককথায় সব কাজ করেন। এদের কেউ ইংরেজি জানেন না; আর আমি জানি না বার্মিজ ভাষা। তবু ইশারায় অনেক কথা বললাম। বুঝলাম, বাড়ি থেকে ভিক্ষু হতে পাঠিয়ে দিয়েছে, এখন শুদ্ধাচারই জীবনের মূল লক্ষ্য এদের।
মিনগুন পাথোদোগি দেখে চললাম শহরের দিকে। পথে পড়ল একটি প্যাগোডা। এর অপর পাশে মূর্তি তৈরির কারখানা দেখে চমকে গেলাম। সেখানে প্রমাণ আকারের সব মূর্তি। কোথাও ছেনি বাটাল, কোথাও মেশিন দিয়ে খোদাই করছেন নারী কর্মীরা। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। নারীদের অনেক পেশায় দেখেছি; কিন্তু মূর্তি তৈরির শিল্পী কিংবা মজদুর হিসেবে এই প্রথম দেখলাম। সবার মুখে হাসি। সবাই আনন্দ নিয়ে কাজ করছেন। পাশেই তাঁতে কাপড় বুনছে আরেক দল নারী। তার পাশে বড় বড় ফ্রেমে বাঁধানো কাপড়ে এমব্রয়ডারি করছে নারীদের আরেকটি দল। সবার চোখে-মুখে সারল্যের আবরণ; মিষ্টি ভাষা। কোথাও এতটুকু বিরক্তির চিহ্ন নেই। আশ্চর্য সুন্দর এক নারীদের জগৎ এ যেন। এ জগৎ ঘুরে দেখতে দেখতে বেলা পড়ে এলো। দিন শেষে সবার একই বক্তব্য, ‘আমরা মানুষ।’
এই সব অনন্যসাধারণ মানুষের সঙ্গে পথ চলতে চলতে আমার চিরচেনা জগৎ হয়ে ওঠে মণিমাণিক্যে পরিপূর্ণ এক রত্নভান্ডার।
ছবি: লেখক