টেকসহি I চ্যাটজিপিটি চমক
একেবারেই নতুন চ্যাটবট। শুরু থেকেই চর্চায়। ফ্যাশনে শিল্পে চ্যাটজিপিটির প্রভাব কতটুকু? সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা কোথায়?
গত বছরের নভেম্বরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট ‘চ্যাটজিপিটি’ নিয়ে আসে ওপেনএআই কোম্পানি। এক মাসের মধ্যেই এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ মিলিয়নে। অভিনব এই চ্যাটবট আসার পর অনেকেই চাকরি হারানোর দুর্ভাবনায় পড়ে যান। সে যাক! ফ্যাশন শিল্পের মতো সৃজনশীল কাজে কী প্রভাব রাখবে চ্যাটজিপিটি? এই বিষয়ে বোঝাপড়ার আগে চলুন জেনে নিই, এটি আসলে কীভাবে কাজ করে। এআই সিস্টেমটি ওয়েবসাইট, আর্টিকেল এবং অন্যান্য উৎস থেকে ডেটা সংগ্রহ করে মানুষের মতো কথোপকথন জেনারেট করতে পারে। ফলে এ চ্যাটবটকে কোনো কিছু নিয়ে জিজ্ঞেস করলে সে মানুষের মতোই উত্তর দিতে সক্ষম। তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
ফ্যাশন শিল্পে চ্যাটজিপিটি যেসব উপায়ে প্রভাব ফেলতে পারে, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং (এনপিএল) বা প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণের ব্যবহার। এনপিএলের সাহায্যে চ্যাটজিপিটি আলাদা গ্রাহকের নির্দিষ্ট চাহিদা ও পছন্দ বুঝে সে অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া জানাতে পারবে। এর মাধ্যমে রিটেইল বিক্রেতারা তাদের গ্রাহকদের ভার্চুয়াল স্টাইলিংয়ে সহায়তার পাশাপাশি, কেনাকাটার অভিজ্ঞতাকে আরও সহজ করে তুলতে পারবেন; সেই সঙ্গে বাড়বে বিক্রিও। তা ছাড়া অসংখ্য ডেটা বিশ্লেষণের সক্ষমতা থাকায় চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে নতুন নতুন পেটেন্ট তৈরির কাজ অনায়াসেই করতে পারবেন ডিজাইনাররা। চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে হালের ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের কালেকশনে নতুনত্ব আনতে পারে ব্র্যান্ডগুলো। পোশাকের রঙের প্যালেট থেকে শুরু করে এর ফ্যাব্রিক, কাট—এসব নির্ধারণেও চ্যাটজিপিটি কাজে লাগানো সম্ভব। শুধু বড় বড় ব্র্যান্ড নয়, আপনি চাইলে ব্যক্তিগতভাবেও এই চ্যাটবট ব্যবহার করে ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারবেন। কোন ধরনের পোশাকের সঙ্গে কী অ্যাকসেসরিজ পরা যায়, কিংবা কোন কোন রং মিক্সম্যাচ করে পরলে ভালো, তার ধারণা মিলবে চ্যাটজিপিটি থেকে।
এ তো গেল ট্রেন্ড অনুযায়ী ফ্যাশনের হিসাব। এবার দেখা যাক ফ্যাশন শিল্পের প্রডাকশনে চ্যাটজিপিটির প্রভাব। ডেটা বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোকে তাদের অপচয় কমিয়ে আনতে এবং দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে এই চ্যাটবট। এটি ব্যবহারে আরও টেকসই ও সাশ্রয়ী উৎপাদন সম্ভব, যা বর্তমানের দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারের জন্য অপরিহার্য বলা চলে। ফ্যাশন শিল্পে সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টের দক্ষতা এবং নির্ভুলতার দিকটা আরও উন্নত করতেও ব্যবহার করা যেতে পারে চ্যাটজিপিটি। বিক্রয়, ইনভেন্টরি, মার্কেট অ্যানালাইসিস, ফোরকাস্টিং টেকনিক এবং গ্রাহকের চাহিদার ডেটা বিশ্লেষণ করে ব্র্যান্ডগুলোর কার্যক্রম অপটিমাইজ করতে, রিটেইল বিক্রেতাদের উৎপাদন ও বিতরণ প্রক্রিয়া সহজ করতে এই চ্যাটবট সহায়তা করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই কৃত্রিম বুদ্ধিমতা ফ্যাশন শিল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, তা হলো মার্কেটিং ও বিজ্ঞাপন। গ্রাহকের ডেটা বিশ্লেষণ এবং ট্রেন্ড নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার সক্ষমতা থাকায়, ব্র্যান্ডগুলোর বিপণন প্রচারাভিযানে কাজে লাগানো যেতে পারে চ্যাটজিপিটিকে। তা ছাড়া এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে দুর্দান্তভাবে পণ্যের বিবরণ লিখতেও কিন্তু কম যায় না চ্যাটবটটি। আরেকটু খোলাসা করি। ধরুন, চ্যাটজিপিটিতে একটি পণ্যের স্বাভাবিক কিছু বৈশিষ্ট্য লিখে তাকে বললেন সেই পণ্য নিয়ে বিস্তারিত জানাতে। চ্যাটজিপিটি সেই কমান্ড নিয়ে ইন্টারনেটে উপস্থিত তথ্য—যেমন: অন্যান্য ব্র্যান্ডে একই ধরনের পণ্যের বিবরণ, বিভিন্ন সাইটে স্টোর করা গ্রাহক প্রতিক্রিয়া—এসব বিশ্লেষণ করে আপনাকে সেই পণ্যের প্রায় সঠিক এক বিবরণী লিখে দিতে পারবে। এই বিবরণগুলো ই-কমার্স কিংবা মার্কেটে বিপণনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোনো ধরনের কায়িক শ্রম ছাড়াই একটি পণ্য এবং এর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়ার এ ক্ষমতা চ্যাটজিপিটিকে ফ্যাশন শিল্পের বড় এক সহায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম।
কমার্শিয়ালের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য কনটেন্ট তৈরিতেও কাজে লাগানো যেতে পারে এই চ্যাটবট। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া পোস্ট কিংবা সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার বা মডেলদের অনুসরণ করে চ্যাটজিপিটির মডেলগুলো এ ধরনের কনটেন্ট তৈরির কাজ করতে পারে। হিউম্যান-জেনারেটেড এসব কনটেন্টের ভাষা, টোন, ধাঁচ প্রভৃতি বিশ্লেষণের জন্য ট্রেইন করা যেতে পারে চ্যাটজিপিটিকে। তবে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করতে চ্যাটজিপিটি মডেলগুলোকে ট্রেইন করার মূলমন্ত্র হলো, সেগুলোকে একটি বৈচিত্র্যময় ডেটাসেটে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং পরে ব্র্যান্ডের বিবরণীর সঙ্গে মিল রেখে কনটেন্ট জেনারেট করা। প্রক্রিয়াটি চ্যালেঞ্জিং হলেও এর সম্ভাবনা কম নয়।
শুধু প্রচার-প্রচারণা কিংবা ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য নয়, কাস্টমার সাপোর্টের বেলায়ও কাজে লাগানো যেতে পারে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে। মুহূর্তের মধ্যে গ্রাহকের ব্যক্তিগত অনুসন্ধানের উত্তর দিতে পারবে এই চ্যাটবট। সাধারণত, এটি এমন প্রতিষ্ঠানের জন্য উপযোগী হতে পারে, যারা ভার্চুয়াল চ্যাট বা অন্যান্য অনলাইন চ্যানেলের মাধ্যমে গ্রাহক সহায়তা দিয়ে থাকে। তবে এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা চাই। চ্যাটজিপিটি যেহেতু ইন্টারনেট ডেটাবেইস বিশ্লেষণ করে কথোপকথন চালায়, তাই কাস্টমার সাপোর্টের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এটির প্রভাব সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে আগে থেকেই।
আধুনিক ফ্যাশন ডিজাইনিং ও মার্কেটিং এক্সপার্টদের জন্য চ্যাটজিপিটির আবির্ভাব তাদের ডিজাইনকে আরও নিখুঁত, আরও সূক্ষ্ম করার পাশাপাশি সামগ্রিকভাবে সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। তবু একে মানুষের সহজাত বুদ্ধিভিত্তিক লেখনীর প্রতিলিপি করার মতো টুল বলে সৃজনশীলতার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া হয়েছে—এটাই মনে করছেন অনেক কনটেন্ট রাইটার, ব্র্যান্ড প্রমোটার, মার্কেটিং এক্সপার্ট। তা ছাড়া প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ টুল হিসেবে কথোপকথনের প্রেক্ষাপট ধরতে না পারা, ২০২১ সালের পরবর্তী উপাত্ত এখানে ইনপুট না দেওয়া—এরূপ অযাচিত কিছু কারণে সমসাময়িক ঘটনার ওপর কোনো বিশ্লেষণধর্মী, আকর্ষণীয় কনটেন্ট জেনারেট করা এই চ্যাটবট দিয়ে আপাতত সম্ভব হচ্ছে না।
প্রাক-প্রশিক্ষিত এই জিপিটি-৪ মডেলটি ওয়েবপেজ, উইকিপিডিয়াসহ বিভিন্ন সোর্স থেকে প্রতিবার প্রায় ৫৭০ জিবি ডেটা বিশ্লেষণ করে আউটপুট জেনারেট করে; যা সাময়িক প্রেক্ষাপটে বিস্ময়ের ব্যাপার হলেও অদূর ভবিষ্যতে চ্যাটজিপিটির সহজলভ্যতাই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের একই ধাঁচের মার্কেটিংয়ের মতো ঘটনার কারণ হতে পারে। ফ্যাশন শিল্পে একজন শিল্পী সুনিপুণ দক্ষতায় মানব মনের চাওয়া-পাওয়ার আদলে তৈরি করেন প্রতিটি পোশাক, সেখানে থাকে হাতের ছোঁয়া, থাকে সমসাময়িক ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার অন্তর্দৃষ্টি, সৃজনশীলতা, টার্গেট অডিয়েন্সের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ, যা এখনো কোনো যান্ত্রিক বট করতে পারেনি। আর এ কারণেই অভিজ্ঞ ডিজাইনার ও মার্কেট স্পেশালিস্টরা এখনো চ্যাটজিপিটিকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে নারাজ।
সাদিয়া আফরিন শায়লা
ছবি: ইন্টারনেট