ফুড বেনিফিট I পুষ্টিজাদুর কাঠি
শজিনার পাতা ও ডাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য তো বটেই, সৌন্দর্যচর্চায়ও বিশেষভাবে কার্যকর
শজিনাগাছকে ব্রিটিশ ও ফিলিপিনোরা নাম দিয়েছে জাদুকরী গাছ। কারণ, শজিনা ডাঁটা, পাতা, ফুল- সবকিছুই শরীর রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া মলিন হয়ে যাওয়া চুল ও ত্বকে উজ্জ্বলতা সঞ্চারের শক্তি শজিনা পাতায় বিদ্যমান। সুতরাং বলা যায়, স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যে এর অবদান অনস্বীকার্য।
মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঞ্চালনক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পাদন হবার জন্য ২০ রকমের অ্যামাইনো অ্যাসিডের প্রয়োজন। এগুলোর মধ্যে ১২টি দেহের ভেতরে তৈরি হয়। অবশিষ্ট ৮টি খাবার থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এগুলো শরীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি। শজিনা ডাঁটা দেহের মধ্যে প্রয়োজনীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড তৈরি করতে অসামান্য ভূমিকা রাখে। তাই একে বলা হয় ‘পুষ্টির ডিনামাইট’। ভারতীয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে, শজিনা পাতা ৩০০ রোগের দাওয়াই হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর।
শজিনা ডাঁটায় প্রতি ১০০ গ্রামে কার্বোহাইড্রেট ৮ দশমিক ৫৩, ডায়াটারি ফাইবার ৩ দশমিক ২, ফ্যাট ০ দশমিক ২০, প্রোটিন ২ দশমিক ১০, পানি ৮৮ দশমিক ২০ গ্রাম, ভিটামিন সি ১৪১ দশমিক ০, ক্যালসিয়াম ৩০, আয়রন ০ দশমিক ৩৬, সোডিয়াম ৪২, ম্যাগনেসিয়াম ০ দশমিক ২৫ মিলিগ্রাম রয়েছে।
আরও রয়েছে অ্যামাইনো অ্যাসিড আইসোলিউসিন ও লিউসিন, যা শরীরের মধ্যে প্রোটিন, এনজাইম ও জৈব রাসায়নিক উপাদান তৈরিতে সাহায্য করে। এই সবজিতে লাইসিনও বিদ্যমান। যেটি ক্যালসিয়ামের মাত্রা সঠিকভাবে শোষণ করতে সাহায্য করে। লাইসিন দেহে কোলাজেন গঠন করে। অ্যান্টিবডি, হরমোন ও এনজাইম উৎপাদন করে পুষ্টির ভারসাম্য বজায় রাখে। আরও আছে লেসিথিন, যা লিভারের সক্ষমতা বাড়ায় এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এতে আছে ফিনাইলেলাইন। এই অ্যামাইনো অ্যাসিড স্নায়ুকোষ ও মস্তিষ্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি ক্ষুধা বৃদ্ধি করে। বাড়িয়ে দেয় স্মরণশক্তিও।
শজিনা ডাঁটায় থাকা ভ্যালিন মাংসপেশির গঠন ঠিক রাখে। অ্যামাইনো অ্যাসিড ট্রিপ্টোফ্যানও যথেষ্ট পরিমাণ থাকে এতে, যা অনিদ্রা, হতাশা, উদ্বেগ কমায়। ধূমপান ও হৃৎস্পন্দনজনিত সমস্যা হ্রাস করে। শজিনা পাতা ও ডাঁটাতে আছে ভিটামিন এ বা বিটা ক্যারোটিন। এটি চোখের রেটিনাকে সুস্থ রাখে। ফলে অন্ধত্বজনিত রোগ রাতকানাসহ চোখের বিভিন্ন সমস্যায় প্রতিষেধক হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর।
অন্যদিকে, শজিনা পাতায় প্রতি গ্রামে গাজরের চার গুণ ভিটামিন এ, দুধের চার গুণ বেশি ক্যালসিয়াম, কলার তিন গুণ বেশি পটাসিয়াম, কমলালেবুর চেয়ে সাত গুণ ভিটামিন, দইয়ের চেয়ে দুই গুণ প্রোটিন রয়েছে। পালংশাকের পাঁচ গুণ আয়রন, মাংসের তিন গুণ আয়রন ধারণ করার ক্ষমতা রাখে এই পাতা। শজিনা পাতার টাটকা রস খাবারের আগে ২-৩ চা চামচ খেলে উচ্চ রক্তচাপ কমে যায়। প্রতিদিন দুই বেলা নিয়ম করে খেতে হবে এই রস। এ ছাড়া টিউমার যখন প্রাথমিক পর্যায়ে তখন শজিনা পাতার রস প্রলেপের মতো লাগিয়ে রাখলে ফোলা দূর হয়। শজিনাগাছের ছাল বেটে রস খেলে বাতের ব্যথা ৬৫ শতাংশ কমে যায়। এই পদ্ধতি প্রাচীনকাল থেকে চলছে। এ ছাড়া দাঁতের মাড়ির সুরক্ষায় শজিনা পাতা কার্যকর। দাঁতের গোড়ায় রক্ত ঝরলে বা ফোলা থাকলে, শজিনা পাতার রস ১ থেকে ২ কাপ গরম পানিতে মিশিয়ে কুলি করতে হবে নিয়মিত। অ্যান্টিসেপটিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন ক্ষত ও পোড়া সারাতে পারে এই পাতা। এটি শাক ও ভর্তা হিসেবে খাওয়া যায়। খেলে রুচি বাড়ে। শজিনা পাতার রস শ্বাসকষ্ট সারাতে পারে। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় এটি দারুণ কাজ করে। এ জন্য শজিনা পাতা সেদ্ধ করে এর থেকে ঘন রস বের করে নিতে হবে। আদার গুঁড়া মিশিয়ে এটি খেলে গ্যাস্ট্রিক দূর হয়ে যায়। শিশুদের গ্যাস্ট্রিক হলে শজিনা পাতার রসে লবণ মিশিয়ে নিতে হয়। আধা গ্লাস দুধের সঙ্গে শজিনা পাতার রস ৯/১০ ফোঁটা মিশিয়ে পান করলে হেঁচকি সমস্যা দূর হয়। দুধ মিশ্রিত শজিনা ফুলের রস মূত্রনালির পাথর সারাতে দারুণ উপযোগী। কুকুর কামড়ালে দেহে যে বিষ তৈরি হয়, শজিনা পাতার রসে তা নষ্ট হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে হলুদ, রসুন, লবণ, গোলমরিচের গুঁড়া বেটে পেস্ট তৈরি করে নিতে হবে। তারপর অতি দ্রুত ক্ষতস্থানে মেখে নিতে হবে। শজিনার পাতাকে অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের খনি বলা হয়। কারণ, এতে রয়েছে ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড। যা শরীরে রক্তের চাপ ও শর্করা কমাতে সাহায্য করে। এশিয়ান প্যাসিফিক জার্নাল অব ক্যানসার প্রিভেনশন দাবি করেছে, শজিনা পাতায় থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ক্যানসার কোষ সৃষ্টিতে বাধা দেয়।
দেহে যদি নিয়মিত অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট এবং আইসোথিওসায়ানেটস প্রবেশ করে, তাহলে ডায়াবেটিস কমে যায়। আইসোথিওসায়ানেটস হলো সালফারের একটি যৌগ। শজিনা পাতায় এই উপাদান বিদ্যমান। যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। তবে, ১ চা চামচ শজিনা পাতার গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে খেতে হয় তিন মাস। এতে ডায়াবেটিস ২১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে আসে। থাইল্যান্ডে শজিনা পাতা বহু বছর ধরে হৃদ্রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
চুল ও ত্বকের যত্নেও এর কার্যকারিতা কম নয়। শজিনা পাতায় আছে শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ভিটামিন ই, প্রোটিন ও জিংক। এই উপাদানগুলো মস্তিষ্কের রক্তসঞ্চালন অব্যাহত রাখে। ফলে চুলের গোড়া মজবুত হয়। চুল পড়া রোধ হয়। ভিটামিনের অভাব হলে চুল অতি দ্রুত শুষ্ক, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শজিনা পাতায় উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ রয়েছে। যা মস্তিষ্কের কোষ সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। কোষ সুস্থ থাকা মানেই চুলের সুরক্ষা। এ ছাড়া শজিনা পাতায় থাকা ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম চুলের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে দেয়।
সালফার এমন একটি খনিজ, যা মুখের ত্বক কোষে কোলাজেন এবং ক্যারোটিন উৎপাদনে অংশ নেয়। শজিনা পাতায় তা আছে। কোলাজেন ত্বকে নমনীয়তা ও স্নিগ্ধতা দেয়। অন্যদিকে, ক্যারোটিন শক্তি জোগায়। এই দুই উপাদান মিলে ত্বকের কোষগুলো সুরক্ষিত করে। শজিনায় বার্ধক্যরোধী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করার মতো। এর পাতায় ফ্লেভনয়েডস, পলিফেনল ও এসকরবিক অ্যাসিডের মতো কার্যকর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিদ্যমান। যেগুলো ফ্রি র্যাডিক্যালের সঙ্গে যুদ্ধ করে ত্বকের কোষ পরিষ্কার করে। চেহারায় এনে দেয় তারুণ্যের দীপ্তি। শজিনা পাতার ফেসপ্যাক তৈরিও খুব সহজ। এক চামচ শজিনা পাতার গুঁড়ার সঙ্গে সামান্য লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে নিতে হবে। আর পরিমাণমতো পানি। এই প্যাক ত্বকের ময়লা সরায়। ফিরিয়ে আনে হারিয়ে যাওয়া উজ্জ্বলতা।
শজিনার বীজ থেকে বিভিন্ন সুগন্ধি ও অ্যারোমাথেরাপির তেল উৎপাদিত হয়। একে বেন অয়েল বলা হয়। মাথার ত্বকের জন্য এটি দারুণ ফলপ্রদ। খুশকিও দূর করে। এতে ৩০ প্রকার অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের সুরক্ষায় সহায়ক। এই তেল ত্বকের কোষে দ্রুত শোষিত হয়। ফলে ত্বক হয়ে ওঠে সতেজ। শিশুদের নরম ত্বকেও এই তেল ব্যবহার উপযোগী।
রেন্টিনা চাকমা
ছবি: সংগ্রহ