ফিচার I গাছের মাংস!
গাছ থেকে তৈরি হচ্ছে মাংস। স্বাদে, গন্ধে তা প্রাণিজ মাংসের প্রতিদ্বন্দ্বী। উন্নত বিশ্বের কিছু রেস্তোরাঁয় শুরু হয়েছে এর চল
বৈশ্বিক তাপমাত্রা ভোগাচ্ছে সবাইকে। বাড়ছে পরিবেশসম্পর্কিত সচেতনতা। প্রকৃতিতে কার্বন ফুডপ্রিন্ট কমাতে সবাই এসে দাঁড়িয়েছে একই ছাঁদনা তলায়। বিশ্বজুড়ে তাই ভেগানিজমের জয়জয়কার। আমিষের চাহিদা মেটাতে প্রাণীর ওপর ভরসা করে বসে থাকলে চলবে না, এ বিষয়ে একমত হয়েছেন বিজ্ঞরা। অন্যদিকে প্রাণীর প্রতি নৃশংসতা কমাতেও সাড়া মিলেছে ব্যাপক। এসব মিলিয়ে মাংসপ্রাপ্তির উৎস হিসেবে বেছে নেওয়া হচ্ছে গাছ। বিষয়টি অনেকের কাছে অদ্ভুত ঠেকলেও সেটিই ঘটছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাছ থেকেও মাংস তৈরিতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেই মাংস স্বাদে-গন্ধে একেবারে আসলের মতো।
এ ধরনের মাংস তৈরির পেছনে লগ্নি করছে অনেক নামকরা কোম্পানি। যেমন বিল গেটসের অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান মেমফিস মিট। গাছ থেকে ল্যাবে তৈরি হওয়া এই মাংস বর্তমানে সিঙ্গাপুরে বেশ জনপ্রিয়। এ ছাড়া পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের রেস্তোরাঁগুলোতে উদ্ভিদভিত্তিক ফ্রায়েড চিকেনের ব্যবহার শুরু করেছে কেএফসি।
মূলত সয়া ও আলু থেকে পাওয়া প্রোটিন, নারকেলের ফ্যাট এবং উদ্ভিদ থেকে আসা হিম নামে একধরনের পদার্থ দিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় গাছের মাংস। এই হিমই মাংসে আনে আসল স্বাদ। অন্যদিকে আইসল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে যব থেকে তৈরি করেছেন মাংস। এ প্রক্রিয়ায় যবকে হোস্ট হিসেবে কাজে লাগানো হয়। প্রথমে শস্যটি মাড়াই শেষে নানান ধাপে সেগুলো বিশুদ্ধ করে, ল্যাবে তৈরি হয় যবের মাংস।
এ ধরনের খাদ্যে পুষ্টিগুণ থাকে সাধারণ মাংসের মতোই। ফিউচার ফুডস নামে একটি জার্নালে প্রকাশিত সমীক্ষা থেকে জানা যায়, উদ্ভিদজাত ও প্রাণীদের মাংসে পুষ্টিগুণ থাকে প্রায় সমপরিমাণ। বাজারে বেড়েই চলেছে উদ্ভিদজাত মাংসের কদর। জার্মান গবেষণা কোম্পানি স্ট্যাটিস্টা বলছে, ২০২৬ সালে বিশ্বজুড়ে গাছ থেকে পাওয়া বিকল্প মাংসের বাজার দাঁড়াবে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার।
অন্যদিকে জেরুজালেমভিত্তিক প্রতিষ্ঠান রিডিফাইন মিট উদ্ভিজ্জ উপাদানের সঙ্গে ল্যাবে তৈরি কিছু স্বাদ ও গন্ধ মিশিয়ে সফলভাবে তৈরি করছে গাছের মাংস। সম্প্রতি তারা আয়োজন করেছিল ব্লাইন্ড ফুড ফেস্টিভ্যাল। সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ১০০ অতিথিকে। তারা ল্যাবে তৈরি গাছের মাংস চেখে দেখেছেন। সেগুলো যে প্রাণিজ নয়, একজন ভোজনরসিকও তা আঁচ করতে পারেননি।
উদ্ভিদ থেকে পাওয়া এ ধরনের মাংসের রয়েছে নানা গুণ। যেমন তা ওজন কমাতে এবং পেশির গঠনে প্রাণিজ মাংসের চেয়ে বেশি কার্যকর। কেননা প্রাণী থেকে পাওয়া মাংসের ৪০ শতাংশই অস্বাস্থ্যকর। বিপরীত দিকে উদ্ভিদ থেকে পাওয়া মাংসে স্বাস্থ্যঝুঁকি কম। এর গুণগত মানও প্রাণীর মাংসের চেয়ে ঢের বেশি। তা ছাড়া হজমে বালাই নেই। কমাতে পারে কোলেস্টেরলের মাত্রাও। এ কারণে যারা রেড মিট এড়িয়ে চলেন, তারা ঝুঁকছেন গাছের মাংসের দিকে। সবচেয়ে বড় সুবিধা, এ ধরনের মাংসের দাম প্রাণীর মাংসের চেয়ে কম। ফলে আপামর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আমিষের জোগান হবে আরও সহজ।
গাছের মাংস পরিবেশের ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না। এ ধরনের খাদ্য গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ কমাবে। এমনকি তা কমে যেতে পারে ৯৮ শতাংশ পর্যন্ত। কমবে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপাদনের মাত্রাও। তা ছাড়া উদ্ভিদজাত মাংস উৎপাদনে পানির খরচও কম। আলাদা করে জমির দরকার পড়ে না।
মার্কিন মুলুকের ইট জাস্ট নামে একটি কোম্পানি উদ্ভিজ্জ প্রোটিন ব্যবহার করে মাংসের পাশাপাশি ডিমও তৈরি করে। দেশটির একটি রেস্তোরাঁর পুরো ব্যবসা নির্ভর করে এ ধরনের মাংসের ওপর। সেখানে যাওয়া ভোজনরসিকদের কেউই এখনো সেই মাংস খেয়ে মন্দ বলেননি। আমেরিকার বেশ কিছু জায়গায় উদ্ভিজ্জ প্রোটিনে তৈরি নাগেট মেলে। ওগুলো তৈরি হয় সে দেশের ল্যাবে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটি মাত্র একটি কোষ দিয়ে চিকেন নাগেট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। একটি কোষ থেকে দুটি, দুটি থেকে চারটি—এই প্রক্রিয়ায় চিকেন নাগেট তৈরি করে তারা। এগুলোর স্বাদ ও পুষ্টি মুরগির মাংসের মতো। এ ধরনের মাংসের চাহিদা বেশি সিঙ্গাপুরে। দেশটি ল্যাবে তৈরি মাংস বাজারে ছাড়ার অনুমোদন দিয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, সিঙ্গাপুরের দুই বিজ্ঞানী চিংড়ি উৎপাদনের ফার্ম তৈরি করেছেন। যদিও সেখানে সত্যিকারের কোনো চিংড়ির দেখা মেলে না। একটি কোষ দিয়ে তারা বানিয়ে ফেলেন আস্ত এক চিংড়ি। এ উদ্দেশ্যে তারা চিংড়ির কোষ সম্প্রসারণ করেন। পরে তাতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি মেশান। নির্দিষ্ট সময় পর তা একটি আস্ত চিংড়িতে পরিণত হয়, যা একাধারে প্রাণীবান্ধব, পরিবেশবান্ধব ও স্বাস্থ্যকর। কেননা তাতে বাড়তি কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা হরমোন ব্যবহার করা হয় না।
যাহোক, গাছ থেকে যে শুধু মাংসই তৈরি হয় তা কিন্তু নয়। হয় মাছও! ‘প্ল্যান্টস মেক দ্য বেস্ট ফিশ’ স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলেছে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান প্ল্যান্টিশ। নামের ধরন দেখেই আঁচ করা যায় তাদের কাজের বিষয়ে। গাছপালা থেকেই মাছ তৈরি করে প্রতিষ্ঠানটি। পানি ছাড়াই তারা তৈরি করছে মাছ। পুরোটাই ল্যাবে। এর স্বাদ একদম আসল মাছের মতোই। এমনকি পুষ্টিগুণেও তা স্যামন মাছের সমতুল্য। যদিও এ ধরনের মাছ এখনো বাজারে সহজলভ্য নয়। প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষার্থে এ ধরনের মাছ তৈরিতে কোমর বেঁধে কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি।
গাছ তো গেল, অন্যদিকে শুধু মুরগির পালক থেকেই তৈরি করা হচ্ছে মাংস! কাজটি হচ্ছে থাইল্যান্ডে। এ ধরনের মাংসে কোনো হাড় কিংবা রক্ত থাকে না। যদিও এটি বাজারে প্রতুল নয়। তবে এর স্বাদ পুরোপুরি মুরগির মাংসের মতোই হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃক্ষ থেকে তৈরি মাংসে গাছের ওপর প্রভাব পড়লেও বেঁচে যায় প্রাণী। মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ ও প্রকৃতির বৈরিতায় অনেক প্রাণীই এখন বিলুপ্ত। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বাড়তি আমিষের চাহিদা মেটাতে চাই আরও বেশি মাংস। বিপরীত দিকে পৃথিবীতে কমে আসছে পশুচারণযোগ্য ভূমি। এই বিষয়গুলো মাথায় রেখেই বিজ্ঞানীরা ঝুঁকছেন গাছ থেকে মাংস তৈরির দিকে। যদিও সব দেশে সেগুলো বাজারজাতের অনুমোদন মিলতে আরও সময় লাগবে। তা ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে সময় প্রয়োজন। তবে এখন পর্যন্ত যতটুকু হয়েছে, তাতে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষ এ ধরনের মাংস সাদরেই গ্রহণ করেছেন।
আহমেদ সজিব
ছবি: ইন্টারনেট