মনোজাল I দাম দিয়ে যায় চেনা!
সস্তার তিন অবস্থা—এই প্রবাদের প্রভাব কি সৌন্দর্যবিশ্বেও সত্য? নাকি পুরোটাই হাইএন্ড ব্র্যান্ডগুলোর বাড়াবাড়ি রকমের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি? মূল উদ্দেশ্য ক্রেতার মনস্তত্ত্বের ম্যানিপুলেশন
কথায় বলে, যা সস্তা, তার কলঙ্ক উপেক্ষা করা কঠিন। মানসিকভাবে বছরের পর বছর এভাবেই প্রশিক্ষিত হয়ে আসছে মানুষ। তাই একটি অল্প এবং একটি বেশি দামি পণ্যের মুখোমুখি হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যয়বহুল বিকল্পটিই বেছে নেওয়া হয়। মনে করা হয়, দামে বেশিটাই ভালো মানের বা বেশি উন্নত। তাই সামর্থ্য থাকলে সেটিই বেছে নেওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। গবেষকদের মতে, বিশেষ করে সৌন্দর্যপণ্যের ক্ষেত্রে নারীদের এই প্রবণতা বেশি। যদিও একটি পণ্যের মূল্য সর্বদা তার সেরা সূচক হতে পারে না। কিন্তু বিশ্বজুড়েই নারীদের কাছে অবচেতনভাবে, কখনো কখনো সচেতনভাবে উচ্চ মূল্যের প্রাইসি বিউটি প্রোডাক্টগুলো সমাদৃত। ফলে জনপ্রিয় ব্র্যান্ডগুলোর স্কিন বা হেয়ার কেয়ার প্রোডাক্ট খুব সহজে এর কম দামি প্রতিদ্বন্দ্বী পণ্যের তুলনায় বেশি উৎসাহ ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে তাদের মনে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই মনস্তত্ত্বের পেছনে কারণ কী। এর খুব সহজ ব্যাখ্যা হলো, যখন বাজেট বনাম বিলাসের কথা আসে, টাকা যদি কোনো ব্যাপার না হয়, তাহলে কেন কেউ সস্তা পণ্য বেছে নেবেন? মানুষ সাধারণত ব্যয়কে গুণমানের সঙ্গে তুলনা করে। যত বেশি দাম, পণ্য তত ভালো। তাতে নিশ্চয় খুব উন্নত মানের উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ত্বক, চুলের জন্য ম্যাজিকের মতো কাজ করবে—এমনটাই বিশ্বাস করেন ক্রেতারা। সস্তা পণ্য মানেই সাধারণ উপকরণ, যা হয়তো ত্বক বা চুলের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে—এমনটাও ধারণা অনেকের। নিজের সৌন্দর্য, তারুণ্য নিয়ে তো আর হেলাফেলা করা যায় না। এ ছাড়া সৌন্দর্যপণ্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অন্যদের দেখে সব সময় সেরাটাই কিনতে হবে এমন মানসিকতাও দেখা যায় অহরহ। ছোটবেলা থেকে মা, বোন, ভাবি বা অনুসরণীয় কারও কাছ থেকে হয়তো জানা ও মানা হয়, সৌন্দর্য সুরক্ষাকারী পণ্যের ক্ষেত্রে অন্তত সব সময় সস্তা ব্যাপারটি এড়িয়ে চলা চাই। আর সৌন্দর্যসচেতনদের এই মানসিকতার কারণেই হয়তো বিশ্ববাজারে বাড়তে থাকে সৌন্দর্যপণ্যের দাম।
ইউনিলিভারের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান পিটার বেইলি একবার এই মনস্তত্ত্ব নিয়ে দারুণ একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন নিজ অভিজ্ঞতা থেকে। ট্রেসেমের কেরাটিন স্মুথ রেঞ্জ ডেভেলপ করার সময় তারা টেস্টারদের চুলের অর্ধেক খুব দামি রেঞ্জের শ্যাম্পু এবং বাকি অর্ধেক চুলে একটি নেতৃস্থানীয় স্যালন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু (যথেষ্ট কম দামি) ব্যবহার করেন। নারীদের কোনো ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি, কোন দিক কোন শ্যাম্পু দিয়ে ধোয়া হয়েছে। ৭২ ঘণ্টা পরে, চুলের কোন অংশটি তাদের ভালো লেগেছে, তা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। ৭৫ শতাংশই বেছে নিয়েছিলেন সস্তা শ্যাম্পু দিয়ে ধোয়া চুল। অথচ প্যাকেজিংয়ের ওপর ভিত্তি করে তারা কোন ব্র্যান্ড কিনবেন, তা জানতে চাইলে কিন্তু ওই দামি রেঞ্জের শ্যাম্পুর নামটিই শীর্ষে উঠে আসে!
মেনে নেওয়া কিছুটা হতাশাজনক হলেও সত্যি, মানুষ খুব সহজে চাকচিক্যের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। পণ্যের ঝকঝকে মোড়ক, নামের জনপ্রিয়তা আর হাই প্রাইস ট্যাগ ভাবতে বাধ্য করে এটি বাজারের অন্য যেকোনোটির তুলনায় ভালো। আবার অনেক সময় নির্দিষ্ট একটি পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তার দাম যতই বেড়ে যাক, সেটি কিনতেই হবে—এই মানসিকতা থাকে ৯০ শতাংশ ভোক্তার। সৌন্দর্যপণ্য হচ্ছে সবচেয়ে সহজলভ্য বিলাস পণ্যগুলোর মধ্যে একটি, যা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট। এ এমন এক বিষয়, যা নিজের সম্পর্কে ভালো বোধ করায়, একধরনের তৃপ্তি দেয়।
ভোক্তা মনোবিজ্ঞানী ড. ক্যাথরিন জ্যানসন-বয়েডের মতে, পণ্যের দাম যা-ই হোক, সামর্থ্য থাকলে তারুণ্য ধরে রাখতে বা সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সবার সেরা পণ্যটাই বেছে নেবেন যে কেউ। উচ্চ মূল্য যেখানে কোনো বাধা নয়, সে ক্ষেত্রে পণ্য বাছাইয়ের সময় তার কার্যকারিতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই বিবেচনা করা হয় না।
কেউ যদি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে ফেলেন কোনো পণ্য সৌন্দর্যকে কয়েক গুণ বাড়িতে তুলতে সাহায্য করবে, তাহলে ব্যয়বহুল হলেও প্রশ্ন ছাড়াই তা কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন অনেকে। পারফিউমের কথাই ধরা যাক। সুগন্ধির জন্য সব সময় একটু বেশি দাম দিতে হয়; কারণ, উচ্চ মানের সুগন্ধি তেল এর দীর্ঘস্থায়িত্বকে প্রভাবিত করে। এই ধারণাতেই দামি পারফিউমগুলো খুব সহজে বিক্রি হয়ে যায়। আবার ব্যাগ থেকে একটি কালো, চকচকে, দামি পাউডার কমপ্যাক্ট বের করে, মুখে তার প্রলেপ মেখে তারপর খুব আলতো ক্লিকের সঙ্গে এটি বন্ধ করার অনুভূতি যে অতুলনীয় আনন্দ দেয়, সেটিও এখানে কাজ করে। সৌন্দর্যশিল্পের ভবিষ্যৎ তাই প্যাকেজিং, ব্যয়বহুল বিপণন এবং যেভাবেই হোক, জনপ্রিয়তা ধরে রাখায় সচেষ্ট। মনস্তাত্ত্বিক মূল্য নির্ধারণ করে প্রাইসিং সেট করার কৌশলগুলো, সাধারণত গ্রাহক আচরণকে প্রভাবিত করতে ব্যবহৃত হয়।
ব্যয়বহুল, সুন্দর প্যাকেজিংয়ের পণ্যগুলো দামে যা-ই হোক, মানে ভালোই হবে—এ এক বদ্ধমূল ধারণা। একচেটিয়াভাবে বিলাসবহুল এবং বিশেষ ব্র্যান্ডগুলোর প্রতি মানুষ স্বভাবজাতভাবে তাই আকর্ষিত হয়। এর থেকে বের হওয়ার উপায় নেই। কারণ, ভোক্তারা বিশ্বাস করেন, তাদের ত্বক অত্যন্ত সংবেদনশীল, যা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেটি ফিরে পাওয়া কষ্টসাধ্য। তাই ব্র্যান্ডগুলো যখন পণ্যের পুরোনো ফর্মুলা পাল্টে ক্ষতিকর উপাদানগুলোর বদলে কোমল ও প্রাকৃতিক কিছু দিয়ে নতুন পণ্য তৈরি হয়েছে বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করে, তখন নিজেকে বোঝানো ক্রেতাদের পক্ষে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। একটি ভালো পণ্যের জন্য আরও বেশি অর্থ ব্যয়ের অজুহাত তৈরিতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না।
সৌন্দর্য বিপণনের বেড়াজালে আটকেই যে কেবল ব্যাপারটি ঘটে এমন নয়। বিলাসবহুল বিউটি প্রোডাক্ট কেনা অনেক নারীর কাছে অস্বাভাবিক ক্রয় মনে না হতেই পারে। কিন্তু সামর্থ্য না থাকলে অযথা আর্থিক বোঝা তৈরি করতে পারে এ ধরনের অভ্যাস। গবেষকদের মতে, আত্মসম্মানও ভোক্তার ক্রয়কে প্রভাবিত করতে পারে। খুব দামি সৌন্দর্যপণ্য নিজের জন্য বেছে নেওয়ার বড় একটি কারণ হলো কৃতিত্বের অনুভূতি। এতে অবচেতন মনে পূর্ণ পরিতৃপ্তি মেলে।
রত্না রহিমা
মডেল: সিম্মি
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস