তনুরাগ I স্নানশাস্ত্র
স্বস্থস্য স্বাস্থ্য রক্ষণম। পাশাপাশি শারীরিক সৌন্দর্যবর্ধন। তবে যথার্থতা জরুরি প্রতিটি ধাপে। আয়ুর্বেদীয় আচার মেনে
পৃথিবীজুড়ে ফরাসি পারফিউমের কদর বরাবরই বেশি। কারণ, এর গন্ধ অতুলনীয়। এত দক্ষতার সঙ্গে ফরাসিরা কেন পারফিউম তৈরি করেন? এর পেছনে মজার সব কারণের কথা বলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চর্চিতটি শুনলে হাসি আসতে বাধ্য। কথিত আছে, সেখানকার বাসিন্দারা নাকি সপ্তাহে এক দিন গোসল করেন, কেউ কেউ আবার মাসে একবার। সুতরাং গায়ের গন্ধ ঢাকার জন্য তাদের পারফিউম ছাড়া উপায় নেই।
এ দেশের বাসিন্দাদের অভ্যাস আবার একেবারেই ব্যতিক্রম। গরমে কমপক্ষে দুবার আর শীতে দিনে একবার গোসল করাই হয়। অন্তত স্বাভাবিক পরিসংখ্যান তাই বলে। যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ দিনে একবার গোসলের জন্য কিছুটা সময় ব্যয় করেই থাকেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই গোসল কেমন? সেটি কি উপভোগ করা হয়, নাকি কেবল করতে হবে বলেই করা?
জানা আছে নিশ্চয়ই, এই উপমহাদেশে গোসল বা স্নান সব সময় একটি পবিত্র এবং নিরাময়কারী আচার হিসেবে বিবেচিত হয়। শুধু শরীরের জন্য নয়, আত্মার জন্যও। অনেক ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান এবং আধ্যাত্মিক শুদ্ধি অনুশীলনের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। আয়ুর্বেদ অনুসারে, গোসলকে আখ্যায়িত করা হয়েছে একরকম ধ্যান করার এবং পরিচ্ছন্ন হওয়ার অভিজ্ঞতা হিসেবে। তবে ওয়াশরুমে ঢুকে ঝটপট দুই মগ পানি ঢেলে নেওয়া হলো গায়ে, তাতে কিন্তু হবে না। এখানে আয়ুর্বেদিক স্নানের কথা বলা হয়েছে। নিজের শরীরকে উপভোগ করার পাশাপাশি পুনরুজ্জীবিত করার সবচেয়ে সহজ ও আরামদায়ক উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো আয়ুর্বেদিক সৌন্দর্য-স্নান। যারা অনেক মানসিক চাপে ভোগেন বা কাজের ব্যস্ততায় ক্লান্ত থাকেন, তাদের মানসিক শক্তি এবং ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ানোর জন্য এটিকে কার্যকর উপায় বলে মনে করা হয়। গবেষকদের মতে, সত্যিকারের সৌন্দর্য নিজের মধ্য থেকে উদ্ভাসিত করার দারুণ ফলপ্রসূ মাধ্যম এটি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গোসল তো গোসলই, কিন্তু আয়ুর্বেদিক উপায়ে গোসল করা আবার কী? ব্যাপারটি খুব সহজ বা কঠিন এমন নয়। একটু সময় ব্যয় বা নিয়মকানুন মানতে হয়, এই যা। তবে এর উপকারিতা এত বেশি, এটুকু কষ্টও গায়ে লাগবে না বললেই চলে। একটু বিস্তারিত জানা যাক।
আয়ুর্বেদ সাধারণত সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ঠিক আগে গোসল করতে উৎসাহিত করে, যা স্নানা নামে পরিচিত। একে দিনের পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি আচারের অংশ হিসেবে ধরা হয়। এ ক্ষেত্রে সেরা সময় সকাল। প্রাকৃতিক উপায়ে নিজেকে ডিটক্স করা, মন-শরীর মেরামতের পরে ত্বক পরিষ্কার করা এবং দিন শুরুর সংকেত হবে এই গোসল। তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠা চাই সে জন্য। গোসলের অন্তত ৪৫ মিনিট আগে। এতে হুট করে শরীরের তাপমাত্রা পাল্টে যাবে না। গোসলের পর কমপক্ষে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে সকালের নাশতা খাওয়ার জন্য। এতে হজম ভালো হয়। এবার নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে, যোগী এবং যারা আয়ুর্বেদিক জ্ঞানের অনুশীলন করেন, তারা কেন সূর্যের আগে ঘুম থেকে ওঠেন? শুধু দিনের শান্তিপূর্ণ এ সময়ে উৎপাদনশীল শক্তিকে ক্যাশ-ইন করার জন্য নয়, বরং একটি সুস্থ রুটিনে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর জন্য। আবার শোয়ার আগে ভালো ঘুমের জন্যও এ এক দুর্দান্ত উপায়। বলা হয়, সন্ধ্যার শুরুতে এবং রাতের খাবারের আগে হলো গোসলের মোক্ষম সময়। তবে যারা খাওয়ার পর গোসল করতে চান, তাদের উচিত রাতের খাবারের পর কমপক্ষে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করা। তাতে হজমের কাজ ত্বরান্বিত হয়।
ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে? তাহলে ধাপগুলো জেনে নেওয়া যাক। এ উপায়ে স্নান সারতে অনেক কিছু মেনে চলতে হবে।
তাপমাত্রা
আয়ুর্বেদিক উপায়ে গোসলের জন্য বেছে নিতে হবে কুসুম গরম পানি। যত গরমই হোক, খুব বেশি ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল শরীর-মনের জন্য উপযুক্ত নয় বলে বিবেচনা করা হয়।
আলো
আলোর সঠিক ব্যবহারও এ গোসলের জন্য জরুরি। তীব্র অপ্রাকৃত আলোর উৎস এড়িয়ে চলার কথা বলা হয়েছে। পরিবর্তে জ্বালানো যেতে পারে একটি মোমবাতি। গোসলের কিছুক্ষণ আগে থেকেই ফোন বন্ধ রাখতে হবে। ল্যাপটপ বা টিভিতে হাবিজাবি দেখা এড়িয়ে চলতে পারলেও ভালো।
শব্দ
গোসলের সময় বাইরের আওয়াজের মতো বিভ্রান্তি এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা চাই। মাথা-মন শান্ত করে চারপাশে পানির শব্দ নিতে পারলে সবচেয়ে ভালো। হালকা মিউজিক শোনা যেতে পারে, তবে আদর্শ হচ্ছে বৃষ্টি বা ঝিরঝির ঝর্নার শব্দ বেছে নেওয়া। আয়ুর্বেদের ভাষায় বলতে গেলে ডিজিটাল বাথ সাউন্ড বা প্রশান্তিদায়ক সংগীত বাজানো যেতে পারে।
প্রাক্-স্নানের প্রস্তুতি
গোসলের পরে তেল দেওয়ার পরিবর্তে, প্রাচীন গ্রন্থগুলো বরং গোসলের আগে এগুলো ব্যবহারের পরামর্শ দেয়। কারণ, পানির নিজস্ব তাপ তেলকে ত্বকের আরও গভীরে প্রবেশ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়, রক্তসঞ্চালন বাড়ায়। গোসলের পানিতে মেশানো যাবে উচ্চ মানের সুগন্ধযুক্ত বাথ অয়েলের কয়েক ফোঁটা। যেমন চন্দন, গোলাপ, জুঁই, গার্ডেনিয়া, পুদিনা বা ক্যামোমাইল। এই তেলগুলো প্রশান্তির পাশাপাশি সতেজ করে তুলবে ত্বক। তেল পছন্দ না হলে কিছুটা বাথসল্টও যোগ করা যেতে পারে পানিতে। তবে সবার ত্বকের জন্য সেটি উপযোগী না-ও হতে পারে।
পরিচ্ছন্নতা
প্রাকৃতিক পণ্য ব্যবহার করতে হবে। সিনথেটিক গন্ধ ও ফর্মুলারগুলো এড়িয়ে চলা চাই। কারণ, এগুলো শরীর বা পরিবেশ- কোনোটার জন্যই ভালো নয়। অতিরিক্ত নোংরা না হলে সারা শরীরে প্রতিদিন শাওয়ার জেল ও সাবানের ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। এতে বরং শরীরের প্রাকৃতিক তেলের স্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একটি সিল্ক গ্লাভস বা বডি ব্রাশ দিয়ে ত্বক মৃদুভাবে পরিষ্কার করতে হবে। ময়লা বা তৈলাক্ত ভাব দূরে ঘরে তৈরি মুগ ডালের স্ক্রাব ব্যবহার করা যায়। সাবান ব্যবহার করা যাবে না এমন নয়, তবে তা যেন খুব মৃদু হয়। ঝটপট হুটোপুটি করে নয় বরং আস্তেধীরে আরাম করে গোসল সারা চাই। যেন সময়টা উপভোগ্য হয়। শরীরের পাশাপাশি মনও হয়ে ওঠে শান্ত।
গোসলের পর
একেবারেই তাড়াহুড়ো করা যাবে না। ধীরগতিতে শরীর শুকিয়ে নিতে হবে, আস্তে আস্তে। খানিকটা সময় শিথিল অবস্থায় থাকতে পারলে তো আরও ভালো। যেন গোসল সারার পরও শরীরজুড়ে তার আমেজ থাকে। চুল ভেজা থাকলে, বাইরে যাওয়ার আগে পুরোপুরি শুকিয়ে নিতে হবে। শরীর তোয়ালে দিয়ে এমনভাবে মুড়িয়ে রাখতে হবে, যেন ধীরে ধীরে ঘরের তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।
নিয়মগুলো এমন কিছু কঠিন নয়, তবে দারুণ ফলদায়ক। বিশেষজ্ঞদের মতে, আয়ুর্বেদিক উপায়ে নিয়মিত গোসলের মাধ্যমে জীবনীশক্তি ফিরে পাওয়া সম্ভব। বিউটি বাথের সক্রিয় উপাদানগুলো থেকে প্রাপ্ত পুষ্টি ত্বককে করে তুলবে অনেক প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল। তাই আর দেরি কেন!
রত্না রহিমা
ছবি: সংগ্রহ