ফিচার I নন-সার্জিক্যাল নোটিফিকেশন
কোনো রকম কাটাছেঁড়া বাদেই সুন্দর হয়ে ওঠার উপায়। তাতে ত্বক ও চুলের নানা সমস্যার সমাধানও মেলে
সৌন্দর্য জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে নন-সার্জিক্যাল বিউটি ট্রিটমেন্ট। পাল্টে দিয়েছে সনাতন সৌন্দর্যচর্চার ধারণা। বিভিন্ন ধরনের বিকল্পযুক্ত কাটাছেঁড়াহীন এসব ট্রিটমেন্ট অনায়াসেই দিতে পারে অনেক দিনের আকাক্সিক্ষত চেহারা। নন-সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টগুলোর নামের সঙ্গে পাল্টে যায় পুরো প্রক্রিয়া। ফলে সুবিধাও পাওয়া যায় একেকটা থেকে একেক রকম।
তবে সৌন্দর্যচর্চায় অস্ত্রোপচারহীন এসব নন-সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টের মধ্যে যে চিকিৎসাপদ্ধতি এখন সবচেয়ে জনপ্রিয়, সেটি হলো কার্বন ডাই-অক্সাইড লেজার রিসারফেসিং। একে দেখা হচ্ছে একুশ শতকের অ্যান্টি-এজিংয়ের বিরাট সাফল্য হিসেবে। এর মাধ্যমে জন্মদাগ, দীর্ঘদিনের ব্রণের দাগ, আঁচিল, কুঁচকানো দাগ, সূর্যরশ্মিজনিত পোড়া দাগ ইত্যাদি দূর হয়। এতে মূলত প্রসাধনী ব্যবহৃত হয় বলে অন্যান্য পদ্ধতির চেয়ে এটি কম ঝুঁকিপূর্ণ।
পদ্ধতির প্রথমে লেজারের সাহায্যে এপিডারমিস অর্থাৎ ত্বকের উপরের স্তর অপসারণ করা হয়। ফলে ডারমিস, মানে ত্বকের গভীর স্তর উন্মুক্ত হয়ে যায় এবং লেজার রশ্মি তা উষ্ণ করে দেয়। প্রক্রিয়াটি কোলাজেন উৎপাদন করে ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক মেরামত করতে সাহায্য করে। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন অব ডারমাটোলজিস্ট বলছে, লেজার সারফেসিং কার্যকর কৌশলের মাধ্যমে ত্বকের দাগ দূর করে। চেহারায় উজ্জ্বলতা আনে। এ জন্য অবশ্যই অভিজ্ঞ লেজার সার্জন প্রয়োজন।
যাদের ত্বকে কুঁচকানো দাগ, ব্রণের দাগ থাকে, তারা এই চিকিৎসার জন্য উপযুক্ত। অমসৃণ ও শুষ্ক ত্বকেও এটি প্রযোজ্য। তবে এ পদ্ধতি সংবেদনশীল ত্বকের জন্য নয়। অর্থাৎ চিকিৎসা নেওয়ার পর কোনো ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হয় না এমন ত্বক লেজার রিসারফেসিংয়ের উপযুক্ত। অন্যদিকে, কোনো সক্রিয় ব্রণযুক্ত ত্বক এই চিকিৎসার অনুপযোগী। ওজন বৃদ্ধির দাগ, গর্ভধারণের ফলে সৃষ্ট দাগযুক্ত ত্বকও উপযোগী নয়।
ত্বকের যে অংশে কার্বন ডাই-অক্সাইড লেজার রিসারফেসিং হয়, সেই অংশ অনুভূতিহীন করার জন্য ক্রিম দেওয়া হয়। এর এক ঘণ্টা পর সেটি তুলে ফেলা হয়। মুখজুড়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড লেজার রিসারফেসিং করতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। পরবর্তী ধাপে প্রথমে জীবাণুমুক্ত কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ করা হয়। এ সময় অস্বস্তি কমানোর জন্য প্রদাহরোধী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। এক থেকে তিন দিনের মধ্যে ব্যান্ডেজটি সরিয়ে ঠান্ডা পানি বা স্যালাইন কিংবা পাতলা ভিনেগারের দ্রবণ দিয়ে মুখমন্ডল পরিষ্কার করতে হয়। দিনে ২ থেকে ৫ বার। সঙ্গে যেকোনো ধরনের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য দেওয়া হয় ক্রিম। সেরে উঠতে সময় লাগে ১০ থেকে ২১ দিন। তবে পুরোপুরি ফল পেতে ৩ থেকে ৬ মাস লাগে; যা নির্ভর করে রোগীর বয়স, চিকিৎসার স্থানের ওপর। ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ পর ত্বকে গোলাপি আভা দেখা দেয়। দাগ কমে যায়। মসৃণ দেখায় ত্বক। স্বাভাবিক রঙ ফিরে আসার পর বলিরেখা সম্পূর্ণ মুছে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
রিসারফেসিংয়ের পর প্রথম দুদিন দৈনন্দিন কাজ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এ সময় ত্বকে সম্পূর্ণ বিশ্রাম দেওয়া জরুরি। চিকিৎসকদের মতে, ঘুম অত্যন্ত কার্যকর বিশ্রাম। কারণ, এ সময় ব্যথা বাড়তে থাকে। তবে উন্নত মানের ফেশিয়াল অ্যানেসথেসিয়া পদ্ধতি প্রয়োগ করা হলে ব্যথামুক্ত থাকা যায়। অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (ক্ষত, সংক্রমণ, হাইপার পিগমেনটেশন) দেখা দিতে পারে। তাই চিকিৎসার আগে সম্ভাব্য ঝুঁকি সম্পর্কে লেজার স্পেশালিস্টের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। ৭ দিন পর মুখে মেকআপ নেওয়া যায়। তবে ধুলাবালি, জাঙ্ক ফুড ও ধূমপান থেকে দূরত্ব রেখে চলতে হবে। ভালো ফল বজায় রাখতে এবং ঝুঁকি এড়াতে চিকিৎসক কসমেটিকস, ফেশিয়াল পদ্ধতি এবং উপযুক্ত স্কিনকেয়ারের নির্দেশনা দেন।
দাগ ও ক্ষতের মাত্রা অনুযায়ী এই চিকিৎসা নির্ভর করে। কেউ যদি ৭ দিনে সেরে উঠতে চান, তাহলে ১ থেকে ২টি ফ্রাকশনাল কার্বন ডাই-অক্সাইড লেজার রিসারফেসিং ট্রিটমেন্ট নিতে হবে।
বিভিন্ন ধরনের লেজার রিসারফেসিংয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এরবিয়াম, ফ্র্যাকজেল স্কিন রিসারফেসিং। পদ্ধতি একই। তফাত কেবল চিকিৎসার পরের পরিচর্যায়।
নন-সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্টের আরও কিছু পদ্ধতি রয়েছে। এগুলো হলো বোটক্স, ডারমাল ফিলারস, ফ্যাট ট্রান্সফার, ইনটেন্স পালস লাইট (আইপিএল), কাইবেলা, লেজার লিফট।
এসব নন-সার্জিক্যাল চিকিৎসা নিতে হলে ত্বকে কিছু সমস্যা থাকতে হবে। যেমন বড় চোয়াল, ঝুলে পড়া মাংসপেশি, ব্রণ, আঁচিল, মেছতা, বলিরেখা, চোখের নিচে গর্তবিশেষ।
বোটক্স
এটি জনপ্রিয় নন-সার্জিক্যাল বিউটি ট্রিটমেন্ট। মূলত ক্লসট্রিডিয়াম বোটুলিনাম নামের পরজীবী থেকে পাওয়া নিউরোটক্সিন। ত্বকের বলিরেখা, ব্রণের দাগ, অত্যধিক ঘাম, মাইগ্রেন সমস্যা, মূত্রাশয় এবং অন্ত্রের সমস্যায় বোটক্স ব্যবহৃত হয় প্রসাধনী হিসেবে। এটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়। মাংসপেশিকে নিস্তেজ করে ত্বকের সূক্ষ্ম দাগ এবং বলিরেখার উপস্থিতি কমিয়ে দেয়। চিকিৎসার খরচ নির্ভর করে কীভাবে সেবা নেওয়া হচ্ছে, তার ওপর। বোটক্স নেওয়ার পর এর কার্যকারিতা থাকবে ৪ থেকে ৬ মাস। সব সময় তা রাখতে চাইলে বছরে কয়েকবার এই চিকিৎসা নিতে হবে। চিকিৎসার কয়েক ঘণ্টা পরেই ফলাফল দৃশ্যমান হয়। ১ সপ্তাহ পর পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডারমাল ফিলার
জেলজাতীয় পদার্থ। ত্বকের গভীরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। চিকিৎসার শুরুতে ত্বকে প্রদাহরোধী ক্রিম লাগানো হয়। ৩০ মিনিট পর কার্যকর। চিকিৎসা নেওয়া হবে, এমন অংশে সূক্ষ্ম সুচ ব্যবহৃত হয়। এ সময় অস্বস্তি কমানোর জন্য বরফ ব্যবহার করা যায়। এই জেল কোলাজেন উৎপাদনের মাধ্যমে তারুণ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। ব্যথাহীন ও সহজ এই ট্রিটমেন্ট নেওয়ার পর দৈনন্দিন কাজ করা যায় অনায়াসে। অপেক্ষার প্রয়োজন নেই।
এই পদ্ধতি মুখের গঠন, বলিরেখা, ঠোঁটের আকৃতি, চিবুক, গাল, নাক ও চোখের চারপাশে কুঁচকে যাওয়া রোধ করে। ত্বক করে মসৃণ, টানটান ও তারুণ্যময়। ডারমাল ফিলার চটজলদি ও সহজ। করা হয় সূক্ষ্ম সুচের মাধ্যমে। কম সময়ের মধ্যে সব অস্বস্তি দূর হয়। কার্যকারিতা টিকে থাকে ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত। ব্যবহৃত ফিলারের ধরনের ওপর এর মেয়াদ নির্ভরশীল। ফিলারের বিভিন্ন নাম আছে। যেমন হায়ালুরনিক অ্যাসিড ফিলার, কোলাজেন অ্যাসিড ফিলার, সেমি পারমানেন্ট ফিলার, পারমানেন্ট ফিলার। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় হায়ালুরনিক অ্যাসিড ফিলার। ২০১৫ সালে এটি আমেরিকায় নেওয়া বিউটি ট্রিটমেন্টের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
ফ্যাট ট্রান্সফার
একে বলা হয় ফ্যাট ইনজেকশন। এটি মূলত শরীরের এক স্থানের চর্বি তুলে অন্য জায়গায় স্থাপনের পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে প্রথমে অনুভূতিনাশক প্রয়োগের মাধ্যমে ক্যানোলা ব্যবহার করে চর্বি বের করা হয়। তারপর পূরণযোগ্য স্থানে বসিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়োজনে দুবার চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। যতক্ষণ পর্যন্ত ফাঁকা স্থান পূরণ না হচ্ছে, ততক্ষণ চিকিৎসা নিতে হবে। এটি সাধারণত পেট, নাক, ঊরু, মুখ ও স্তনের জন্য। প্রক্রিয়া শেষ হতে কয়েক ঘণ্টা লাগে। সামান্য ব্যথা থাকতে পারে। সমতল করা অংশ লাল রঙ ধারণ করতে পারে। সেরে উঠতে সময় লাগে ১ থেকে ২ দিন।
ইনটেন্স পালসড লাইট
সংক্ষেপে আইপিএল। চুল বা অবাঞ্ছিত লোম দূর করতে এটি ব্যবহৃত হয়। ব্যথাহীন। আইপিএলে কাচের পৃষ্ঠতল লোমকূপে প্রয়োগ করা হয়। এ পদ্ধতিতে গরম আলো ফেলা কাচের পৃষ্ঠতল সরাসরি লোমকূপের গোড়ায় কাজ করে। ফলে লোমকূপ গজানো বন্ধ হয়। এটি ঘন লোম কমানো একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধান। লোম দূর করা ছাড়াও ব্রণ, রক্তনালি কমানো, তারুণ্য বজায় রাখা, মেছতা বা লালচে দাগ অপসারণেও আইপিএল কার্যকর। এতে লেজারের তুলনায় বিস্তৃত রশ্মি ব্যবহার করা হয়। একবার ত্বকে আলো ফেললে অনেক জায়গাজুড়ে চিকিৎসা নেওয়া যায়। ফলে ত্বকের বেশ খানিকটা জায়গায় এ চিকিৎসা সম্ভব। তাই এটি অন্যান্য লেজারের তুলনায় বেশি কার্যকর। যেকোনো চুল ও ত্বকের জন্য জুতসই এই পদ্ধতি। প্রয়োগে সময় লাগে কম। আলোকরশ্মি যত বেশি হয়, আইপিএলে তত কাজ দেয়। চুল ও ত্বকভেদে অনুভূতিনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হতে পারে। সব সময় তা না-ও হতে পারে। ২০ মিনিট লাগে। ফলাফল মেলে ৩ সপ্তাহে। এ সময় বিশেষ ধরনের চশমা পরতে হয়। চিকিৎসা নেয়া হবে, এমন স্থানে ঠান্ডা জেল ব্যবহার করা হয়। এটি ত্বকের প্রদাহ রোধ করে। এই চিকিৎসা নেওয়ার পর সূর্যরশ্মি থেকে দূরে থাকা উচিত।
কাইবেলা
এটি চিবুকের নিচে জমে থাকা চর্বি সরানোর নন-সার্জিক্যাল পদ্ধতি। প্রযোজ্য জায়গার কোষগুলোতে সিরিঞ্জের সাহায্যে প্রয়োগ করা হয় ডি-অক্সিকোলিক অ্যাসিড, যা দেহের চর্বি শোষণে সাহায্য করে। ফলে চিবুকের তলদেশের চর্বির কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। আর জমতে পারে না। ১৮ বছর বা তার চেয়ে একটু বেশি বয়সীরা এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা নেওয়ার উপযুক্ত। গর্ভবতীরা এর অনুপযোগী। এই ট্রিটমেন্টে শুধু মুখ পরিষ্কার করে নিলেই বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে মুক্ত থাকা যায়। কোনো ধরনের জ্বলুনিরোধী ক্রিম ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। ২০ থেকে ৩০ বা সর্বোচ্চ ৫০টি সিরিঞ্জ চিবুকের নিচে ব্যবহৃত হতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে চর্বির কোষগুলো কাজ শুরু করে। এরপরের সপ্তাহ থেকে দেহে বিপাক ক্রিয়া চলতে থাকে। ভালো ফলের জন্য একাধিকবার চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। তবে সর্বোচ্চ ৬টি কাইবেলার ট্রিটমেন্ট নেওয়া যায়। একটা সেশনের জন্য কমপক্ষে এক মাস সময় লাগে।
লেজার লিফট
এটি এমন একটি পদ্ধতি, যা ত্বক টানটান করতে সাহায্য করে। লেজার লিফটকে বলা হয় নির্ভুল সাইড ফায়ারিং লেজার ফাইবার। এই ফাইবার চিবুক বা চোয়ালের চর্বি সরাতে ব্যবহার করা হয়। কোলাজেন বৃদ্ধির কাজে দারুণ উপযোগী। এই ট্রিটমেন্টের ফলে ত্বক হয় টানটান। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট লাগে। তবে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে এমন চেহারা ফিরে পাওয়া যায়, মনে হবে মূল বয়স থেকে ১০ বছর কমে গেছে। এই ট্রিটমেন্টে সময় কম লাগে, ফলও হয় দ্রুত।
রেন্টিনা চাকমা
মডেল: আনিকা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন
I need this address. How can I?