বুক রিভিউ I আলপনার কুকবুক
দ্রোণ সরাসরি শেখাননি একলব্যকে। সিদ্দিকা কবীরও সরাসরি শিক্ষক নন আলপনা হাবিবের। তবু দ্রোণকে গুরু মেনেছেন একলব্য। সেই মিল এখানেও। তাঁর বইকে সঙ্গী করে শেখা বলেই সিদ্দিকা কবীরকে মেন্টর মানছেন আলপনা।
অবশ্য কেবল তিনি কেন, বাংলাদেশে তাঁর বই পড়ে রান্না শেখেননি এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তা ছাড়া বাংলাদেশে রান্নার বই বললেই প্রথমে চোখের সামনে ভাসে প্রয়াত সিদ্দিকা কবীরের ‘রান্না খাদ্য পুষ্টি’ বইটি। বইটি খুঁজলে সম্ভবত সবার কাছে পাওয়া যাবে। পথিকৃৎ এই ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের রন্ধনশিল্পকে মর্যাদার একটা অবস্থান দিতে সক্ষম হয়েছেন। এরপর রান্নার নানা বই বেরিয়েছে। নানা ব্যঞ্জনের। টক-লাল-মিষ্টি; চোব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়। বাদ যায়নি কিছুই। কিন্তু এর কতগুলো মানে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে, তা নিয়ে আলোচনার অবকাশ থেকে যায়। বাংলাদেশের রান্নার বইয়ের তালিকায় কদিন আগে যোগ হয়েছে আরেকটি: আলপনা’জ কুকিং। আলপনার রান্না। সেলিব্রিটি হোম কুক আলপনা হাবিবের বই। ৫৫০ পৃষ্ঠার বৃহৎ কলেবর। সুদৃশ্য ও সুমুদ্রিত। নানা স্বাদের, নানা বৈশিষ্ট্যের ও নানা দেশের ২৫৯টি পদের সন্নিবেশ ঘটানো হয়েছে এতে। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন তাঁর দ্রোণ সিদ্দিকা কবীর এবং তাঁর মাকে।
বইটির শুরুতে আলপনার রান্না নিয়ে দুই বাংলার বিশিষ্টদের শংসা যেমন রয়েছে, আছে দৈনিক পত্রিকার মন্তব্যও। তাতে তারা সত্যের অপলাপ করেছেন, তা বিলক্ষণ নয়। কারণ, রান্না একটা শিল্প। এর প্রতি প্রেম না হলে রসায়ন জমে না। সেটা আলপনা হাবিবের রান্না না খেলে অনুভব করা যাবে না। কেবল রান্নায় শেষ নয়, উপস্থাপন ও পরিবেশনে তাঁর মুনশিয়ানা প্রশ্নাতীত। তাঁর আরেকটি বড় গুণ হলো, কোনো রেসিপি পেলে সেটা নিজে আগে রান্না করে নির্দ্বিধ হন, তারপর তিনি সেটা নিয়ে কথা বলেন বা কোথাও ছাপাতে রাজি হন। ক্যানভাসের এই সংখ্যায় তাঁর দেওয়া রেসিপির ক্ষেত্রেও সেটা ঘটেছে। ফলে তাঁর এই বইতে রেসিপি নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।
আলপনার বইটি দ্বিভাষিক হওয়ায় বিদেশিরাও এর সুফল পাবেন। বইতে ১৪টি পরিচ্ছেদ রয়েছে। প্রতিটিতে বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন ধরনের রান্না দেওয়া হয়েছে। শুরু স্যালাডে আর শেষ মৌলিক রান্নায়।
এখানে বাঙালি রীতি আর দেশীয় রীতিতে রান্নার নানা পদ দেখানো হয়েছে। দেশীয় রীতি বলতে বোঝানো হয়েছে ভারতীয় কিংবা বাঙালি। বিষয়টি স্পষ্ট নয়। তবে মাছের পদগুলো সবই পশ্চিম বাংলার। কিন্তু মাংসের পদগুলো নয়। যদিও এসব পদ এখন সব জায়গাতেই হয়। এখানে একটু বলে রাখা ভালো, পশ্চিম বাংলার মাংস রান্না আর অন্য প্রদেশের মাংস রান্নার প্রণালি আলাদা। তা ছাড়া প্রত্যেক প্রদেশের নিজস্বতা রয়েছে। আর ভারতীয় মাংস রান্নায় মোগল প্রভাব প্রকট ও অনুপেক্ষণীয়। আলপনার পদগুলোতেও সেটা স্পষ্ট।
শেষ পরিচ্ছেদটি হলো মৌলিক রান্না। এই অধ্যায়ে রান্নার ১৪টি মৌলিক বিষয় দেওয়া হয়েছে; যা বেশ কাজে আসবে।
পরিচ্ছেদ সন্নিবেশ নিয়ে কয়েকটা কথা বলা শ্রেয়। মনে হয়েছে, এ ক্ষেত্রে শুরু ও শেষের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকা প্রয়োজন ছিল। কারণ, নাশতা দিয়েই দিনের শুরু। আর শেষ নৈশাহারে। সেভাবে সাজানো যেত। আবার মধ্যাহ্নভোজ বা নৈশভোজে সবার আগে থাকে স্যালাড আর সবশেষে চাটনি। বিষয়গুলো নিশ্চয়ই তিনি ভবিষ্যৎ প্রকাশনায় বিবেচনায় রাখবেন।
বইটির একটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো, প্রণালিকে চমৎকার করে ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করা। এভাবে প্রণালি সাধারণত উপস্থাপিত হয় না। তবে পাঠক হিসেবে আমার চাহিদা ছিল আরেকটু বেশি। প্রতিটি রেসিপির সঙ্গে টুকরো গল্প, তার পরিচিতি, সেটা প্রথম রান্নার অভিজ্ঞতা, হেঁশেলে মজার ঘটনা ইত্যাদি থাকলে বইটি কেবল রান্নার বই হয়ে থেকে যেত না; বরং সুখপাঠ্য রন্ধন সাহিত্য হয়ে উঠত।
ডিজাইন, লেআউটও বেশ চমৎকার। বিশিষ্ট স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশের প্রচ্ছদ মনোগ্রাহী। বইয়ের মান আর কলেবরের সঙ্গে মূল্য সংগতিপূর্ণ। তবে সাধারণ পাঠক বা রন্ধনপ্রিয়দের পকেটের ওপর একটু চাপ পড়তেই পারে। অবশ্য খেতে আর খাওয়াতে যারা পছন্দ করেন, তাদের জন্য আলপনার বইটি হবে কার্যকর সঙ্গী। চমৎকার এই বই উপহার দেওয়ার জন্য আলপনার পাশাপাশি তাঁর জীবনসঙ্গী তথা প্রকাশক সৈয়দ আহসান হাবিবও ধন্যবাদার্হ হবেন।
প্রথম প্রকাশনা। ভবিষ্যতে নিশ্চয় এমন আরও বই উপহার দিয়ে তিনি এই ক্ষেত্রকে সমৃদ্ধ করবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
ছবি: সংগ্রহ