ছুটিরঘণ্টা I উল্কির আড়ালে মুখঢাকা নারীদের সন্ধানে
বিশেষ নৃগোষ্ঠীর নারীদের মুখজুড়ে আঁকা উল্কি। যতটা না সৌন্দর্যে ভিন্নমাত্রা যোগের উদ্দেশ্যে, তার চেয়ে বেশি প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে। লিখিত ইতিহাস না থাকলেও ধারণামতে, এ রেওয়াজ হাজার বছরের। তবে এখন বিলুপ্তির কিনারে। বিস্তারিত এলিজা বিনতে এলাহীর ভ্রমণরচনায়
আমার মিয়ানমার ভ্রমণ ছিল মাত্র আট দিনের। যাওয়ার আগে প্রচুর সতর্কবাণী—সাবধানে থাকবে, গাইড ছাড়া এক পা নড়বে না, গহিনে প্রবেশের দরকার নেই…। আমারও তেমনই ইচ্ছে ছিল। প্রতিটি শহরের মূল স্থানগুলোতেই শুধু যাব।
সে রকম চলছিল ভ্রমণটি। ইয়াঙ্গুন থেকে বাগো শহরের প্রত্নস্থলগুলো ভ্রমণ শেষ করে সড়কপথে রওনা দিয়েছি মান্দালয়ের উদ্দেশে। বাগোর গাইড ইও মু সঙ্গে রয়েছেন। আমাকে মান্দালয়ের গাইডের হাতে সঁপে দিয়ে তারপর ছুটি নেবেন।
বাগো থেকে মান্দালয়ে পৌঁছতে সময় লাগল প্রায় সাত ঘণ্টা। মান্দালয়ের নারী গাইডকে দেখে বেশ খুশি হলাম। অল্প যে কদিন এ দেশের শহরগুলো দেখেছি, তাতে বেশ অবাক হয়েছি। রাজনৈতিক অস্থিরতাপূর্ণ দেশে পর্যটনশিল্পকে দারুণ গুছিয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, তরুণ উদ্যোক্তা ও নারীদের ভীষণভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
মান্দালয় শহরে আমার গাইডের নাম মু সুই তাহি। তাকে আমি তাহি নামেই ডেকেছি। এ শহরের ইউ বেইন ব্রিজে আমরা কাটাচ্ছিলাম কিছু অলস মুহূর্ত। উদ্দেশ্য—সূর্যাস্তের ছবি তুলব আর শেষ বিকেলে জেলেদের মাছ ধরার ছবি। এমন সময়ে গল্পে গল্পে জানলাম, তাহির ১৭ বছরের ট্যুর গাইড ক্যারিয়ারে আমিই দ্বিতীয় বাংলাদেশি পর্যটক! তিনি নিজের মোবাইল থেকে চিন ও সান প্রদেশের, মুখে উল্কি আঁকা ও লং নেক কিছু নারীর ছবি দেখালেন। ছবিগুলো দেখে বিস্ময় কাটে না আমার!
‘আমি যেতে চাই ওখানে,’ বললাম তাকে। তাহির জবাব, ‘সে ক্ষেত্রে তোমার জন্য সহজ ছিল বাগোতে থেকে যাওয়া। এখন আবার তোমাকে পেছনে যেতে হবে। ভ্রমণ পরিকল্পনা বদল করতে হবে; টিকিটও।’ আমার মাথায় এত কিছু কাজ করছিল না। ততক্ষণে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, এত কাছে এসে এই নারীদের না দেখে দেশে ফিরব না!
দেশে আমার ট্রাভেল এজেন্সিকে ফোন করলাম, ফিরে যাওয়ার টিকিট সামলানোর জন্য। আর এখানে তো তাহি রয়েছেনই। দেখলাম, তিনিও দ্রুত যোগাযোগ করছেন। নিজ ভাষায় কথা বলছেন সেলফোনে। আমাকে জানালেন, গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু ওই সব গ্রামে যেতে হলে সেখানকার স্থানীয় কাউকে সঙ্গে নেওয়া দরকার। সেটি সকালে পথে যেতে যেতে ঠিক করে নেওয়া যাবে।
অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই হোটেলের দিকে পা পাড়ালাম। তাহি বলেছিলেন শীতের কাপড় সঙ্গে নিতে। সেখানে কিছুটা ঠান্ডা পড়বে। আমার ভ্রমণ প্ল্যান মোতাবেক সে রকম শীতের কাপড় সঙ্গে নেই; কারণ, চিন রাজ্য ভ্রমণের কোনো পরিকল্পনাই ছিল না।
পরদিন সকাল ৬টায় একটি গাড়ি নিয়ে তাহি এলেন হোটেলের সামনে। চোখে তখনো ঘুম লেগে আছে আমার। তবু মুখে উল্কি আঁকা নারীদের দেখার তর সইছিল না। ভিন দেশে সড়কপথের প্রতি ইঞ্চিতেই বিস্ময় অপেক্ষা করে। চলতি পথে চোখে পড়ল গ্রামের ছোট একটি বাজারের মতো জায়গা। সেখানে মাথায় মাটির হাঁড়ি চাপিয়ে কয়েকজন নারী গল্প করতে করতে যাচ্ছেন। কী দারুণ দৃশ্য! তাহির কাছে জানতে চাইলাম, মাথায় কী তাদের। জানালেন, পানি, দুধ কিংবা খাবার হতে পারে। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম, প্রতিটি হাঁড়ি উল্টো করে মাথায় ধরা এবং কবজি পর্যন্ত পাতিলের মুখে ঢোকানো। তাহি এবার নিশ্চিত করলেন, এই নারীরা সুপেয় পানির সন্ধানে চলেছেন।
গাড়ি চলছে, মন উতলা হয়ে আছে উল্কি আঁকা নারীদের দেখার জন্য। কত সবজির খেত, ফসলের জমিন পাড়ি দিচ্ছি। ধীরে ধীরে পাহাড়ি রাস্তা শুরু হলো। পথিমধ্যে সামান্য জলখাবারের জন্য থামলাম একটি ছোট শহরে। সেখানে নুডলস স্যুপ ছাড়া কিছুই নেই। এদিকে ভীষণ চায়ের তেষ্টা পেয়েছে আমার! আশপাশে সেই ব্যবস্থাও নেই। ঠিক হলো আবাসনে পৌঁছে দুপুরের আহার সারব।
যেতে যেতে তাহির কাছে শুনছিলাম চিন রাজ্যের কথা। যেমনটা আগেই বলেছি, এ প্রদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকে ঠিক করা ছিল না বলে এর সম্পর্কে কিছু জেনে আসিনি। তাহি জানালেন, চিন রাজ্যকে এখানে সবাই ডাকে চিন পাহাড় বলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় তিন হাজার মিটার। মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলের এ রাজ্য দুটি বিষয়ের জন্য বিখ্যাত—একটি মাউন্ট ভিক্টোরিয়া, অন্যটি মুখে উল্কি আঁকা নারী। গাড়ি একটি স্যুভেনির দোকানে এসে থামলে আলাপে ছেদ পড়ল আমাদের। ওই যে বলেছিলাম শীতবস্ত্রের অপ্রতুলতার কথা। পাহাড়ি নারীদের হাতে বোনা কাপড়ের দোকান এটি। চারদিকে রংবেরঙের কাপড় ঝুলছে। একটি জ্যাকেট কিনে নিয়ে আবার শুরু হলো চলা। একসময় তাহি জানালেন, আমরা মিন্দাত শহরে পৌঁছে গেছি। প্রায় ৬ ঘণ্টা ড্রাইভ শেষে এসে পৌঁছলাম আমাদের আবাসনে। তাহি তাড়া দিলেন, ফ্রেশ হয়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। খাওয়ার পর্ব সারতে হবে পথেই। আমাদের গন্তব্য মাত্র দুটি অঞ্চল—কানপালেট ও মিন্দাত। আজ বিকেলের গন্তব্য কানপালেট।
কানপালেটের সেই বিকেল
মিয়ানমারের এই অঞ্চল অন্য শহরগুলোর তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে হলো। আমাদের আবাসন মিন্দাত শহরে। যেতে হবে কানপালেটে; মিন্দাত থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে। কানপালেট একটি ছোট শহর। সম্ভবত চিন রাজ্যের সবচেয়ে ছোট শহর। পাহাড়ের ঢালে বড় বড় পাহাড়ের ছাউনি দিয়ে আবৃত একটি এলাকা। শহর থেকে দৃশ্যটি খুব সুন্দর, বিশেষ করে সূর্যাস্তের আগে। শীতকালে পাহাড়গুলো ঘন কুয়াশায় ঢেকে গিয়ে পুরো শহরকে একটি ছোট স্বর্গোদ্যানে রূপ দেয় যেন!
কানপালেট এখনো অক্ষত রয়েছে; আধুনিকতা পুরোপুরি প্রবেশ করেনি। চিন রাজ্যের ঐতিহ্যগত জীবনধারা পর্যবেক্ষণের জন্য একটি বেশ ভালো জায়গা। হয়তো শত বছর আগেও জীবনধারা এমনই ছিল এখানে। ট্র্যাকিং করার জন্যও জায়গাটি বেশ সুন্দর। কানপালেট শহরে আমাদের পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে এলো। একটি সরু রাস্তা ধরে এগোতে হবে এবার। তাই নির্দিষ্ট স্থানে গাড়ি থামিয়ে হেঁটে যাব আমরা। সেখানেই অপেক্ষা করছিলেন স্থানীয় একজন গাইড।
প্রথম যে নারীর সঙ্গে দেখা হলো, তার নাম ইয়িনুড। তার মুখটি উল্লম্ব রেখা দিয়ে আবৃত। জানালেন, মাত্র ১২ বছর বয়সে তার মুখে এই উল্কি করা হয়েছে। চোখের পাতার ওপরের অংশের উল্কি তাকে বেশি কষ্ট দিয়েছিল।
সেখানে খানিকক্ষণ কাটিয়ে আবারও পা বাড়ালাম। চারদিকে বাঁশের বাড়িঘরগুলো আমাদের পাহাড়ি অঞ্চলের মতোই মনে হলো। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনে মহিষের মুখের কঙ্কাল ঝুলছে। তাহি জানালেন, ঘরে অশুভ শক্তি যেন প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্যই এই রেওয়াজ। এই গ্রামের সব বাড়ি বাঁশের। কিছু কিছু ঘর বাঁশ দিয়ে উঁচু করা হয়েছে, আমাদের পাহাড়ি এলাকায় যেমনটা দেখা যায়। আমি তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা জানতে চাইলাম। তাহি বললেন, এখন ভাত-ডালই পছন্দ করেন আদিবাসীরা।
এরপর দেখা হলো ৮৬ বছর বয়সী একজন আদিবাসী নারীর সঙ্গে। সারা মুখে কালো কালিতে উল্কি করা। তিনি ইউ পিন জাতিগোষ্ঠীর। এরা মিয়ানমারে বিরল আদিবাসী। কানপালেট থেকে বেশ দূরের এক এলাকা থেকে তাদের এখানে আসা। ওই নারীর কাছে জানতে চাইলাম, তাদের গোত্রের কতজনের মুখে উল্কি আঁকা আছে। জবাব দিলেন, আর কারোরই নেই! এ পর্যায়ে গাইড আমাকে নিশ্চিত করলেন, আমি আসলে ইতিমধ্যেই চিন প্রদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও দুর্লভ কারও দেখা পেয়ে গেছি!
গল্পে গল্পে ওই নারীর কাছ থেকে জেনে নিলাম, তার মুখে উল্কি করে দিয়েছিলেন তার দাদি। বললেন, ‘আমাদের সময়ে প্রতিটি মেয়েকে মুখে উল্কি করাতে হতো। এটিই ছিল নিয়ম। আমি আমার উল্কির জন্য মোটেই লজ্জিত নই। অথচ আজকাল নতুন প্রজন্ম এই রেওয়াজ মানতে চায় না।’ তার আলাপ থেকেই জানা গেল, নারীদের মুখে উল্কি আঁকার এই ঐতিহ্য কত পুরোনো। কানপালেটের গাইড বলছিলেন, হাজার বছরের পুরোনো রেওয়াজ এটি। যদিও সময়ের প্রকৃত হিসাব বের করতে পারিনি।
বেলা গড়াচ্ছে। ঠান্ডা বাড়ছে। কানটুপির অভাব তীব্রভাবে অনুভব করছিলাম। আধঘণ্টার মতো হেঁটে ফিরে এলাম গাড়ির কাছে। আঁধার নামার আগেই আবাসনের দিকে এগোতে থাকলাম।
ট্যাটু-ফেস নারীদের কিংবদন্তি
রাতে খাবার টেবিলে আমি আর তাহি আবারও উল্কিতে মুখঢাকা নারীদের নিয়ে আলোচনায় বসলাম। আসলে আমার কৌতূহল ফুরাচ্ছে না। প্রায় বিলুপ্ত এই প্রথার কোনো নারীর সঙ্গে কথা বলেছি, সেটি অনুধাবন করতেই বেশ কষ্ট হচ্ছিল। পুরো মিয়ানমারে প্রায় ১৩০টি জাতিগোষ্ঠীর বাস। তাদের রয়েছে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, নানা ধরনের উপকথা, ভিন্ন রকম ধর্মীয় বিশ্বাস, নানান সামাজিক রীতি। তেমনি দেশটির চিন পাহাড়ে রয়েছে পুরো মুখে উল্কি করা নারী। এদের পূর্বপুরুষের বিশ্বাস ছিল, মুখমণ্ডলে এ রকম উল্কি আঁকা সুফল বয়ে আনে, ভালো বিয়ে হয়, জীবন সুন্দর হয়। এই সামাজিক বিশ্বাস থেকেই তারা মুখে উল্কি করার রেওয়াজ মেনেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। কোমল বয়স থেকেই এই সব নারীর মুখে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে উল্কি। প্রাথমিকভাবে চিন প্রদেশ এবং ট্যাটু-ফেস নারীদের সম্পর্কে এ রকমই জেনেছি তাহির কাছ থেকে।
মিয়ানমারের এই কোণে ভ্রমণ মানে হলো সেই পুরোনো সময়ে ফিরে যাওয়ার মতো। কিন্তু এটি খুব স্পষ্ট যে, সমাজ দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। যেহেতু চিন রাজ্য দেশটির বাকি অংশের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হচ্ছে, এর প্রভাবে স্থানীয় ঐতিহ্য ম্লান হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এ রাজ্যের জনগণ তাদের অ্যানিমিস্ট কিংবা সর্বপ্রাণবাদী জীবনধারার জন্য পরিচিত। যদিও সম্প্রদায়গুলো এখনো অ্যানিমিস্ট ঐতিহ্যকে বহন করে, তবু সম্প্রতি বেশির ভাগই খ্রিস্টধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে এখানকার সবচেয়ে অদ্ভুত দিক হলো, চল্লিশ বছরের কম বয়সী কোনো নারীর মুখে উল্কি নেই। আসলে, ট্যাটু-ফেস নারীদের বেশির ভাগই সত্তরোর্ধ্ব। জানা গেল, সামাজিক এই রীতিকে ১৯৭০ সাল থেকে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
আমার গাইড এ অঞ্চলের আটটি মুখের ট্যাটু প্যাটার্ন ব্যাখ্যা করে বোঝালেন আমাকে। আমি তাদের মধ্যে তিন রকম ট্যাটু প্যাটার্ন দেখেছি। আসলে এই কিংবদন্তি কিংবা প্রথার কোনো লিখিত ইতিহাস নেই। বংশপরম্পরায় গল্পগাথায়, মানুষের মুখে মুখে এক সময় থেকে অন্য সময়ে সেগুলো স্থানান্তর হয়েছে। যত দূর জানা গেল, এই প্রথার নেপথ্য কারণগুলোর একটি ছিল, দূর অতীতে বার্মিজ রাজারা চিন রাজ্যে ভ্রমণে এসে নিজেদের হারেমের জন্য সুন্দরী মেয়েদের বেছে নিতেন। তাদেরকে রক্ষা করতেই আদিবাসী গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষেরা অল্প বয়স থেকে নিজেদের মেয়েদের মুখে উল্কি এঁকে রাখতেন। তার মানে, উল্কির আড়ালে প্রকৃত সৌন্দর্য আড়ালের প্রচেষ্টা ছিল।
আরেকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, প্রতিবেশী আদিবাসীরা মেয়েদের অপহরণ করবে, এই ভয়ে নিজেদের স্বতন্ত্র আদিবাসী চিহ্ন মুখে এঁকে দেওয়ার একটি দুর্দান্ত প্রতিরোধ কৌশল ছিল এটি। কেউ কেউ আবার বলেন, যাজকেরা চিন লোকদের বলেছিলেন, মুখে উল্কি আঁকা নারীরাই শুধু স্বর্গে যাবে। তা যেভাবেই হোক, আদিবাসীরা হয়তো তাদের নারীদের কুৎসিত দেখানোর জন্য এমন সৃজনশীল উপায় বেছে নিয়েছিলেন; তবে এই নকশা নিয়ে তাদের গর্বেরও অন্ত ছিল না। নেই এখনো। একবিংশ শতাব্দীতে পর্যটনের ক্ষেত্রে মিয়ানমারের একটি ভিন্ন বৈচিত্র্য হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে এই নারীদের, যাদের মুখ, ঘাড় ও বাহুতে বিভিন্ন নকশা ফুটে আছে উল্কি হয়ে।
মিন্দাতের সকাল
কানপালেট ও মিন্দাতকে আমার কাছে একই রকম মনে হলো। এখান থেকেই ফিরে যাব মান্দালয়ে। পরের দিন সকালে আমরা চিন রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের ঘূর্ণায়মান পাহাড়ের ভেতর দিয়ে, তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছলাম। পথের দুধারে বড় বড় পাইন বন পেরিয়ে পৌঁছলাম একটি গ্রামে। আগের দিনের স্থানীয় গাইডও রয়েছেন সঙ্গে। মাকুন ও মান সম্প্রদায়ের আদিবাসী গ্রাম এটি। অন্য সম্প্রদায়ও থাকতে পারে। আমি আসলে তাহির কাছে যে রকম বর্ণনা পেয়েছি, সেটিই লিপিবদ্ধ করছি।
মাকুন নারীরা তাদের কপাল ও চিবুকের ওপর উল্কি আঁকেন। মানদের মুখে আঁকা উল্কি দেখতে ইংরেজি ‘বি’ অক্ষরের মতো। এই গ্রামে আমরা এসেছি মূলত ৯৩ বছরের এক নারীকে দেখতে। নাম ইও স্যান। নাক দিয়ে বাঁশি বাজাতে পারেন। তার কানের গয়না তৈরি হয়েছে লাউ শুকিয়ে সেই খোলসের ওপর পুঁতি বসিয়ে। উল্কি করার রং তারা প্রাকৃতিকভাবে তৈরি করেন। রং হিসেবে ব্যবহার হয় ঘাসের পাতা, আর একধরনের গাছের কাঁটা দিয়ে নকশা করা হয় মুখে।
ইও স্যানকে দেখেই মনে হলো, তার ছবি আগেও দেখেছি। কিন্তু মিয়ানমার ভ্রমণের আগে সে কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল, চিন প্রদেশের এই নারীদের কথা আমি প্রথম জেনেছিলাম বিবিসি ট্রাভেলের একটি প্রতিবেদন থেকে। দারুণ ছিল সেই প্রতিবেদন।
নাক দিয়ে বাঁশি বাজিয়ে আমাদের শোনালেন ইও স্যান। তবে তার কথায় ছড়িয়ে পড়ল বেদনা। জানালেন, এভাবে বাঁশি বাজানো তিনি পরের প্রজন্মকে শেখাতে পারেননি। যার ফলে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পরিবার থেকে এই ঐতিহ্য মুছে যাবে হয়তো।
কানপালেটে দেখেছিলাম প্রাণীর মুখের কঙ্কাল প্রতিটি ঘরের সামনে ঝোলানো। এখানে স্থানীয় গাইড আমাদের এমন একটি বাড়িতে নিয়ে গেলেন, যেখানে রয়েছে শত শত প্রাণীর মুখের কঙ্কাল। এই গ্রামের হেড হান্টার বা প্রধান শিকারির বাড়ি এটি। সবচেয়ে বেশি প্রাণী শিকার করেছেন এ বাড়ির কর্তা। মুহূর্তেই আমাদের সুন্দরবনের পচাব্দি গাজীর কথা মনে পড়ে গেল। সুন্দরবনের অন্যতম সেরা শিকারি ছিলেন।
যাহোক, ট্যাটু-ফেস নারীর খোঁজে দেড় দিনে মিয়ানমারের চিন প্রদেশের দুটি গ্রাম ভ্রমণ প্রায় বাক্যবিহীন অবস্থায় কেটেছে আমার। আমি যা বলেছি তাহিকে, তিনি সে কথা অনুবাদ করে স্থানীয় গাইডকে বলেছেন; তারপর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সেই কথার উত্তর ফিরে এসেছে আমার কাছে। উল্কিতে মুখঢাকা এই নারীদের সঙ্গে শুধু চোখে চোখেই কথা বলা হয়েছে; সে রকম ভাব বিনিময়ের সুযোগ ঘটেনি। তবে তাদের প্রতি আমি এতই অভিভূত ছিলাম, কানপালেট ও মিন্দাতের অপার্থিব প্রকৃতির সৌন্দর্য সেভাবে অনুধাবন করতে পারিনি!
ফেরার সময় হয়ে এলো। মান্দালয় শহর অপেক্ষায় রয়েছে আমার। হয়তো চিন রাজ্যকে পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি তাড়াহুড়োতে। চিন পাহাড়ের অনেক কিছু নিয়ে অতৃপ্তি রয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের ওপর থেকে এই শহর দেখা হয়নি, পাহাড়ি ঐতিহ্যবাহী খাবারও খাওয়া হয়নি। তবু পরিকল্পনাহীন চিন পাহাড় ভ্রমণ ও ট্যাটু-ফেস নারীরা স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছেন এক দারুণ উজ্জ্বলতায়।
ছবি: লেখক