দৃশ্যভাষ্য I ড্রামাটিক ড্রিমস্পেস
‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি/ দেখা যায় তোমাদের বাড়ি/ তার নীল দেয়াল যেন স্বপ্ন বেলোয়ারি…’। ভারতের কলকাতাভিত্তিক বাংলাভাষী রক ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র গান। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, স্মৃতিকাতরতা ছড়ানো অদ্ভুত মায়াবী গানের পসরা সাজিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল তাদের অ্যালবাম ‘আবার বছর কুড়ি পরে’। ওই অ্যালবামের এই গান, দিব্য মুখোপাধ্যায়ের কথা আর অনুপ বিশ্বাস ও বাদল সরকারের সুর ও কণ্ঠের ইন্দ্রজালে সেই প্রজন্মের অনেক বাঙালি শ্রোতাকে করে ফেলেছিল মন্ত্রমুগ্ধ। ঘোরগ্রস্তও। সেই ঘোরের রেশ, প্রজন্মের হাত ধরে এখনো বিরাজমান। যে কাব্যিক কল্পচিত্র এ গানে ছড়িয়ে রয়েছে, তার সঙ্গে হুবহু মিলে না গেলেও, অন্যতর এক দোলা ঠিকই দর্শকমনে জাগিয়ে তোলে ব্রিটিশ ফ্যাশন ফটোগ্রাফার টিম ওয়াকারের তোলা একটি আলোকচিত্র। সেখানে ‘তুমি’তে মূর্ত হয়ে ক্যামেরায় ধরা পড়েছেন তারই স্বদেশি মডেল ও পরিবেশবাদী লিলি কোল। আলোকচিত্রটি ওই গান প্রকাশের এক দশক পরে তোলা। তাতে বাড়িটি ‘মেঘের কাছাকাছি’ ছড়িয়ে পড়েনি যদিও, বরং এর উল্টো হিসেবে, সিলিংয়ে আটকে পড়ে এক গুমোট আবহ তৈরি করেছে; তবু এর দেয়াল ঠিকই নীল, হয়তো কাকতালীয়ভাবেই! আর এই গানের শেষ দিকে রয়েছে যে বর্ণনা, ‘বাঁকানো সিঁড়ির পথে সেখানে নেমে আসে চাঁদের আলো’, আলোকচিত্রটিতেও তেমনই আবহের রয়েছে বিস্তার। আছে বাঁকানো সিঁড়ি। আর নীলাভ আলোর সম্মোহন, যদিও তা চাঁদের নয়, সূর্যের; কেননা, আলোকচিত্রটি দিনের আলোয় তোলা। তবু ওই গান আর এই আলোকচিত্র যেন এক কাব্যিক বোধে হয়ে আছে বিজড়িত। তাতে যেকোনো সংবেদনশীল মনে স্মৃতিকাতরতার এক হাহাকার মুহূর্তেই জেগে উঠতে যেন বাধ্য!
এই আলোকচিত্রের লোকেশনও ভারত। তবে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, গুজরাট। তাতে দেখা মেলে, প্রাকৃতিক দুনিয়া ও মনুষ্যনির্মিত পৃথিবীর মধ্যকার সীমারেখাগুলোর একাকার হয়ে যাওয়া। বেহিসেবি রকমের খরুচে সেটের সন্নিবেশ, ডিটেইলের সম্মোহনে দর্শক ও আলোকচিত্রকে কল্পনাবিলাসী জগতে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেলার সহজাত ক্ষমতা রয়েছে টিম ওয়াকারের। আলোচ্য ছবিটি এরই দারুণ উদাহরণ। এখানে ফুটে আছে ড্রামাটিক ড্রিমস্পেস। এই ছবি তোলার জন্য কোনো স্টুডিও নয়; বরং একটি নিমগ্ন ও নাটকীয় লোকেশন বেছে নিয়েছিলেন আলোকচিত্রী।
বাণিজ্যিক দুনিয়ার বিবিধ গরলে পড়ে একজন মডেলকে সাধারণত যা খোয়াতে হয়, সেই শিশুতোষ সারল্য ও নিষ্পাপতার ঝলক এই ছবির মূল থিম বলেই মনে হয়। আর তা মডেল লিলি দারুণ মুনশিয়ানায় ধারণ করেছেন ছবিটিতে। খানিকটা লো-অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা হয়েছে বলে একদৃষ্টিতেই মডেলের দেখা মিলেছে কর্তৃত্বপূর্ণ ও দাপুটে ব্যক্তিত্বে। একদিকে তার অঙ্গভঙ্গি ও মুখের অভিব্যক্তি এই ভিজ্যুয়ালের বিপরীত হয়ে উঠে সেই কর্তৃত্বপরায়ণতাকে করে তুলেছে প্রবল; অন্যদিকে মডেল দৃশ্যমান হয়েছেন এমন এক বিনম্র ও নিষ্পাপ ভঙ্গিমায়, যেখানে নিজের বাহুর আড়ালে মুখ লোকানোর প্রচেষ্টা এবং নিজেকে কুঁচকে ফেলার ঘটনা তার ভেতর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতিরই ইঙ্গিত দেয়।
বাঁকানো সিঁড়ি এখানে তার পরনের পোশাকের কোমল ভাঁজের সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হয়ে উঠেছে ওই উঁচু ছাদের রুম ও গথিক জানালাগুলোর শৈলশ্রেণিময় ও ভারসাম্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে। বলা বাহুল্য, এই ছবির নির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা প্রকাশ পায়নি বলে, একে আসলে যেকোনো দর্শকের পক্ষে নিজের মতো বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তবে ফ্যাশন ও আর্কিটেকচারাল ইজেরারির এই কম্বিনেশন সত্যি চমৎকার। উভয়ই চাকচিক্যময় পোশাক এবং ক্ষয়িষ্ণু স্থাপত্যশৈলী—উভয়ের একটি বেশ পুরোনো পরিশীলিত কালের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই ছবির কারিগর টিম ওয়াকারের জন্ম ১৯৭০ সালে। থাকেন লন্ডনে। ‘ভোগ’, ‘ডব্লিউ’ ও ‘লাভ’ ম্যাগাজিনগুলোতে নিয়মিতই দেখা মেলে তার তোলা আলোকচিত্রের। বিশেষত ‘ভোগ’-এর জন্যই বেশি খ্যাতিমান। বিখ্যাত ওই ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় ২৫ বছর বয়স থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে তার তোলা ছবি। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রবেশের আগেই তিনি ফ্যাশন ফটোগ্রাফার হিসেবে খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। তার ছবিতে থাকে জাদুকরী ও খেয়ালিপনার সম্মিলন। থিয়েট্রিক্যাল ক্যারেক্টার, ম্যাজিক্যাল সিনারিও এবং এক্সট্রাভ্যাগান্ট সেটের জন্য বিখ্যাত। আলোকচিত্রে প্যাস্টেল কালারের ব্যবহার তাকে অনেকটাই অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছে। লিলি কোলকে ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে তোলা তার এই আইকনিক ছবি এরই এক নিখুঁত নমুনা। ‘ব্রিটিশ ভোগ’-এর জন্য ছবিটি তিনি তুলেছিলেন ২০০৫ সালে। প্রকাশ পায় সে বছরের জুলাই সংখ্যার কভারে। ছবির শিরোনাম, ‘লিলি অ্যান্ড দ্য স্পাইরাল স্টেয়ারকেস’।
ছবিটির স্মৃতিচারণায় মডেল লিলির ভাষ্য, ব্রিটিশ লাক্সারি ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘স্টেলা ম্যাককার্টনির ড্রেস পরে ওই সিঁড়িতে উঠে ঝুলে থাকার সময় মনে হয়েছিল, যেভাবে ভীষণ কষ্ট করে দাঁড়িয়েছি, তাতে সিঁড়িটির সৌন্দর্যময় ভাঁজগুলোর মাঝে আমি বোধ হয় গলেই যাব! এখানে হাওয়া দিতে কোনো জানালা খোলা হয়নি; এমনকি ব্যবহার করা হয়নি উইন্ড মেশিন।’ অন্যদিকে, ‘ব্রিটিশ ভোগ’ ম্যাগাজিনের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর রবিন ডেরিক বলেন, ‘ক্যামেরায় ক্লিক করার আগেই, দিব্যচোখে ছবির দেখা পেয়ে যান টিম। তারপর অবতীর্ণ হন এক দারুণ লড়াইয়ে। যেখানে নিজের ভাবনায় ধরা দেওয়া ছবিটিকে কীভাবে ক্যামেরাবন্দি করবেন, তা নিয়ে চলে চ্যালেঞ্জের লড়াই। ওই সর্পিল সিঁড়িতে লিলি কোলের ছবিগুলো তিনি তুলেছিলেন আমাদের জুলাই ২০০৫ সংখ্যার জন্য। ছুটিতে ভারত ভ্রমণে গিয়ে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একটি পতনোন্মুখ পুরাতন প্রাসাদের। সেটির মধ্যে পেয়েছিলেন গুঁড়ো নীলরঙা হলওয়ের দেখা, যেখানে ওই ব্যাপকভাবে মরিচাধরা লোহার সর্পিল সিঁড়িটিও রয়েছে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে একটি ছবি তুলে ফিরে এসেছিলেন লন্ডনে; আর সেই ছবিতে মার্কার পেন দিয়ে ওই লোকেশনে লং ড্রেস পরিহিত এক নারীর দাঁড়িয়ে থাকার স্কেচ এঁকে, জমা দিয়েছিলেন আমাদের ফ্যাশন ডিরেক্টর টেক ফেলানের কাছে। টিমের প্রি-ভিজ্যুয়ালাইজেশন ক্ষমতা এতই তীক্ষè, মূল ছবিতে কোথায় কী রাখবেন, তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আগে থেকেই দেখতে পেয়েছিলেন। ওই লোকেশনে ছবি তুলতে হলে সেই আলো-হাওয়ায় মডেলের পোশাকের দৈর্ঘ্য, রং ও ওজন কতটুকু এবং কেমন হওয়া চাই—আগে থেকেই নির্ধারণ করতে পেরেছিলেন তিনি।’ আর পেরেছিলেন বলেই এটি হয়ে আছে বিশেষত ফ্যাশন ফটোগ্রাফির এক আইকনিক আলোকচিত্র।
সূত্র: বিস্ট্রল ফটোগ্রাফি রিসার্চ গ্রুপ; দ্য ইনডিপেনডেন্ট ফটোগ্রাফার ম্যাগাজিন; মেলিসা ব্র্যাডবুরি ব্লগ; দ্য জিনিয়ালজি অব স্টাইল
লাইফস্টাইল ডেস্ক