ছুটিরঘণ্টা I রঙিন প্রাসাদের রূপকথা
শেকি। শাকিও বলেন কেউ কেউ। আজারবাইজানের ঐতিহ্যবাহী শহর। এককালে ছিল মধ্য এশিয়ায় সিল্ক রোডের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র। সেখানে ১৭৯৭ সালে রাজপ্রাসাদ গড়ে তোলেন তৎকালীন শাসক। শিল্প ও রঙের মহিমা ছড়ানো সেই প্রাসাদ এখনো পর্যটকদের সমানে টানছে যেন রূপকথার মন্ত্র ছড়িয়ে! ঘুরে এসে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
লেকের পানিতে ককেশিয়ান পর্বতমালার গাঢ় সবুজ ছায়া। পাড়ের রেস্তোরাঁয় পাতা চেয়ার-টেবিলে বসেছেন অনেকে। ভেতরে ঘন গাছপালায় ঘেরা বাগান। বাগানের মাঝে ছোট ছোট কাচের ঘর। সেখানেও বসে খাবার খাওয়া যাবে। আমি যাব শেকি। আজারবাইজানের একেবারে উত্তর-পশ্চিমের প্রাচীন একটি শহর। সময়স্বল্পতা আর বাজেটের কথা ভেবে একটি প্যাকেজ ট্যুর নিয়েছি। ট্যুর গাইডের নাম সাবরিনা। দেখতে একদম তুর্কি মেয়েদের মতো। সাদা টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার পরে কী যে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলেন, দেখলেই ভালো লাগে।
লেকের ধার ঘেঁষে একটু নিরিবিলিতে একটি টেবিল খুঁজে বসে দুপুরের খাবার খেলাম। এই বাগান-রেস্তোরাঁ এতই বড়, আমার ট্যুরের সহযাত্রীরা কে কোথায় আছেন—খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ভেতরের দিকে একটি কাচের ঘরে সাবরিনাকে খুঁজে পেলাম। পাশে বসে আছেন জোভাহির, যিনি এখন ট্যুর গাইড হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আরও আছেন মিষ্টি, লাজুক ছেলে ইউসুফ। একটি মিউজিক স্কুলে বাদ্যযন্ত্রের শিক্ষার্থী। হাত পাকানো এবং বাড়তি আয়ের জন্য ট্যুর কোম্পানিতে যোগ দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় বাজনা বাজিয়ে বেড়ান। বাকু শহর থেকে রওনা দেওয়ার পর থেকেই তিনি এমন সব মধুর আজারবাইজানি গানের সুর তুলেছেন নিজের ‘তার’ নামক বাদ্যযন্ত্রে, তাতে টের পাওয়া যায়নি সময়ের ঘেরাটোপ।
নতুন পরিবেশে, নতুন মানুষ পেলে বকবকানি বেড়ে যায় আমার! সাবরিনাদের রীতিমতো বিরক্ত করেই ছাড়লাম। জোভাহির অবশ্য খুব আনন্দের সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। ইউসুফ অতটা ইংরেজি জানেন না। আমিই প্রশ্ন করে করে বেচারাকে অস্থির করে তুলেছি। তিনি যখন একটু আগে আজারবাইজানি লোকসংগীতের সুর তারে তুলছিলেন, তখন আমি বাইরের জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। বাকুর রুক্ষশুষ্ক সোনালি পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে, ধীরে ধীরে সবুজের দিকে যাচ্ছিলাম আমরা। ককেশিয়ান পর্বতমালার এক জাদু আছে। কেমন যেন আচ্ছন্ন করে; ঘোরে আচ্ছাদিত করে নিয়ে যেতে থাকে। সে মোহ কাটতে চায় না।
এ দেশের প্রতিটি গ্রামে ও শহরে নানান সময়ে নানা রং খেলে; খেলিয়ে বেড়ায়। এই সোনালি শুষ্ক প্রান্তর তো খানিক পরে কাস্পিয়ান সাগরের নীল লম্বা তটরেখা; আরও উত্তরের দিকে সারি সারি ঢেউ খেলানো সবুজ মখমলে মোড়ানো পাহাড়। কখনো ইউরোপীয় ধাঁচের কোনো গ্রাম, কখনো হেলেদুলে উঁচু উঁচু গাছের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা এক গহিন বনের পথ; কোথাও পাহাড়ের কথা না শুনে ছুটে চলা কোনো অবাধ্য নদী। এক দেশে কত রং, কত বেশ! একেক সময়ে একেক উৎসবের পোশাক পরে সদা নবীন বেশে আবির্ভাব তার।
বাগান-রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে আমার সহযাত্রীদের নিয়ে সাবরিনা চললেন শেকি টাউনের দিকে। উত্তর আজারবাইজান আমাকে মুগ্ধ করেছে এর প্রকৃতির নানা রঙের চাদর দিয়ে। এক সবুজের যে কত বৈচিত্র্য, তা এই পাহাড় আর বনভূমি না দেখলে জীবনের অনেক বড় একটি অধ্যায় অসমাপ্ত থেকে যেত আমার।
শেকিকে এ দেশের মফস্বল শহরই বলা চলে। ছোট ছোট বাড়িঘর, অপ্রশস্ত রাস্তা, পরিচ্ছন্ন, সবুজের বাড়াবাড়িতে ইউরোপের কোনো এক বইয়ের মফস্বলি ছবির পাতা যেন। কোথাও কোনো খুঁত নেই। নেই কোনো অসামঞ্জস্য। শেকি খান প্যালেস এ শহরের প্রধান আকর্ষণ। উত্তর-পশ্চিমের এই শহরে পর্যটকেরা আসেন মূলত এই প্যালেস দেখার জন্যই।
বহুকাল ধরে শেকি রাজ্য ছিল ককেশিয়ান আলবেনিয়ানদের দখলে। পারস্য থেকে আজারবাইজানে আসা শাসকদের হাতে এ অঞ্চল শাসিত হয়েছে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। তখন থেকে শেকি ছিল ইরানের অংশ। এরপর আজারবাইজান শাসন করেছিলেন দোর্দ-প্রতাপশালী আমির নাদের শাহ। তিনিও পারস্য থেকে আসা। তার প্রয়াণের পর শেকি রাজ্যের দায়িত্ব নেয় রাজবংশ। তাদেরকে বলা হয় শেকি খানাত; ফারসিতে খানাত-এ শেকি। ১৭৪৩ থেকে ১৮১৩ সাল অবধি শেকি খানেরা রাজ্য শাসন করেন। এরপর আজারবাইজানকে রাশিয়ার হাতে সঁপে দেয় ইরান। কিছুকাল রাশিয়া শাসন করে এই অঞ্চল। এরপর ১৯২০ সালে আজারবাইজানের ঠাঁই হয় সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্তির ঠিক আগে আজারবাইজান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন শেকি পরিচিতি পায় দেশটির অন্যতম প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর হিসেবে।
শেকি খান প্যালেসে এসে সাবরিনার স্কুলের বাচ্চারা এদিক-ওদিক ছুটে গেল। আমি আর দুজন ব্রিটিশ ট্যুরিস্ট ইংরেজিতে কথা বলি। বাকি সব কলকলিয়ে ওঠা রাশিয়ান ভাষার ওস্তাদ! সাবরিনা বলে দিলেন, এই প্রাসাদ দেখা হয়ে গেলে বাইরে তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি আমার মতো প্রাসাদের বাইরের নকশা দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভারত, মধ্য এশিয়া, তুরস্কের বাঘা বাঘা রঙিন সব স্থাপনা দেখে এসে শেকি প্রাসাদকে দূর থেকে তেমন উল্লেখযোগ্য মনে হবে না। কারণ, এই প্রাসাদের বাইরের কারুকাজ ও রং খুবই হালকা; তবে আভিজাত্যপূর্ণ। কাছে গেলে বোঝা যায় এর প্রকৃত সৌন্দর্য। হালকা ফিরোজা রঙের মাঝে সাদা গুলদস্তা খোদাই করা কিংবা বাদামি ও কালো নকশার মাঝে ফুল-লতাপাতার সাদা অঙ্কন এক সূক্ষ্ম রুচিবোধের পরিচায়ক। কোথাও রং নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই। দোতলা প্রাসাদের কিছু অংশে ভাগ ভাগ করে খোদাই ছাড়াও টাইলসের ওপর নকশা করা, যা মধ্য এশিয়া ও পারস্যের নিজস্ব ধরন। প্রাসাদের উভয় তলায় সামনের দিকে টানা বারান্দা কাচ দিয়ে ঘেরা। কাচের ওপর ইসলামিক আর্ট অনুসরণ করে দেওয়া হয়েছে জ্যামিতিক নকশার কাঠের ফ্রেম। এর নিশ্চয় রহস্য আছে। আমি এ রকম অনেক প্রাসাদ দেখেছি, যার রহস্য ও সৌন্দর্য বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
বারান্দার উভয় পাশে মুসলিম স্থাপত্যশিল্পের অনন্য নিদর্শন মুকারনা করা। মুকারনা হলো দেয়ালে মিহরাব আকারের ভেতরের দিকে বসানো অনেকগুলো খোপ খোপ নকশা। সাধারণত মসজিদ, মাদরাসা বা সমাধিসৌধের প্রবেশদ্বারের ওপরের দিকে কিংবা ভেতরের দেয়ালের কোনায় কোনায় মুকারনা নকশা করা থাকে; আর মুকারনায় থাকে হাতে আঁকা ফ্রেসকো। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই প্রাসাদের বহিরাঙ্গের দোতলার মুকারনায় কোনো নকশা নেই। অনেকগুলো ছোট ছোট আয়না পাশাপাশি বসিয়ে মুকারনার খুবসুরতি রোশন করেছে। যেন নিচ থেকে তাকালেই নিজেকে একবার দেখে নেওয়া যাবে। এ যেন খোদ ইরানের ঝলমলে মুকারনার হাটবাজার! নিচতলার মুকারনাদ্বয়ের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দিয়েছে সোনালি রঙের ফ্রেসকো।
প্রাসাদের ভেতরে নিচতলায় তখন কেউ নেই। পা রেখে থ হয়ে গেলাম। পুবের দেয়াল, মেঝেতে নানা রঙের আলোর ফোয়ারা ছুটে বেড়াচ্ছে। রঙে নেয়ে উঠছি আমি। এক পা সামনে বা পেছনে গেলে একেক রং আমাকে গ্রাস করছে। আমি অবাক হয়ে দেখি। বাইরে থেকে যা বোঝা যায়নি, তা এখন রং হয়ে ধরা দিয়েছে। বারান্দার কাঠের ফ্রেমের মাঝে নানা রঙের কাচের টুকরো বসিয়ে তৈরি করা হয়েছে এক রঙিন আচ্ছাদন। সূর্যের আলো এই কাচগুলোতে পড়লে তা ভেদ করে সামনের দেয়ালে নকশা হয়ে ফুটে ওঠে। এক রঙের রহস্যপুরি হয়ে গেছে নিচতলার বারান্দা।
আজারবাইজানি নিজস্ব কায়দায় করা এই শিল্পকে বলে শেবেকে শিল্প। কয়েক শত বছরের পুরোনো শেবেকে শিল্প আজও ধরে রেখেছেন অল্প কিছু শিল্পী। আখরোট বা ওক গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি হয় কাঠের নকশাদার ফ্রেম। এর মাঝে কোনো পেরেক বা আঠা ছাড়া কাঠের ফাঁকে ফাঁকে বসানো হয় লাল, নীল, সবুজ, হলুদ রঙের কাচের টুকরোগুলো। এক পাশের ফ্রেমে ১৪ হাজারের বেশি ছোট ছোট রঙিন কাচের টুকরো ব্যবহার করা হয়েছে। মধ্য এশিয়ায় সিল্ক রোডের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল শেকি শহর। এই শেবেকে নকশা করার জন্য ইতালি থেকে কাচ বিকোতে আসতেন বণিকেরা; আর নিয়ে যেতেন সিল্ক ও মসলা।
একেকটি দরজা বা আস্ত দেয়ালের ফ্রেম তৈরি করতে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর। প্রথমে কাঠ খোদাই করে ফাঁকা ফাঁকা ছোট ছোট জ্যামিতিক শেপ বানিয়ে তারপর সেই মাপে কাচ কেটে বসিয়ে দেওয়া হয়। এক বর্গমিটার ফ্রেম তৈরি করতে সাধারণত সময় লাগে ছয় মাস। এই পরিশ্রম, নিষ্ঠা এবং শিল্পের প্রতি এই অনুরাগ অবশ্যই মধুর ফল এনে দিয়েছে আজারবাইজানের ঐতিহ্যে।
আমি এতক্ষণ বিভোর ছিলাম শেবেকে শিল্পের রঙিন জগতে। মূল দেয়াল বা ছাদ নজরেই পড়েনি। নিচতলা সাধারণত বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দেয়াল আর ছাদজুড়ে ফ্রেসকো করা। নানা রঙের ফ্রেসকোতে ফুটে উঠেছে ফুল, লতাপাতা, গুলদস্তা। দেয়াল থেকে ছাদ অবধি কোথাও কোনো জায়গা খালি নেই যেখানে শিল্পীর তুলির ছোঁয়া পড়েনি। ছাদ থেকে ঝুলছে রাজকীয় ঝাড়বাতি। এক কোনায় ফায়ারপ্লেস, সে-ও রাজকীয় চিত্রে মোড়ানো। রাজপ্রাসাদের সব ভাবমর্যাদা বজায় রেখে রঙের সাগরে ডুবে বলে যাচ্ছে শেকি খান সালতানাতের গল্প।
দোতলায় কক্ষ আছে সাকল্যে তিনটি; আর পেছনে ছোট আকারের দুটি। ছোট কক্ষগুলো বরাদ্দ ছিল নোকরদের অপেক্ষাস্থল হিসেবে; হুকুম হলেই বেরিয়ে এসে তা তালিম করার জন্য। ডান পাশের প্রথম কক্ষটি ছিল খাস বেগমের। এই কক্ষের জৌলুশ নিচের কক্ষের চেয়েও অধিক। ফ্রেসকোর সূক্ষ্ম কারুকাজ দেয়াল আর ছাদ দখল করে নিয়েছে। অপর রাজ্য যেমন দখল করেন কোনো শক্তিশালী রাজা।
এই আলিশান প্রাসাদে বেগমের কক্ষ দেখে চোখ ঝলসে যাচ্ছে এর রূপে। এক কোনার ফায়ারপ্লেস ঘিরে যেন ফাগুনের মৌসুম বসেছে। চারদিকের ফ্রেসকোতে শুধু ফুল আর ফুল। লাল, নীল, হলুদ, সোনালি ফুলে এ যেন চিরবসন্তের দেশ। কামরার ভেতরে কোনো আসবাব না থাকায় আরও সুরভিত করেছে এর হাওয়াকে। সুবাস আরও তীব্র হয়েছে। রংদার করেছে ফুলের গালিচাকে। এ কক্ষে ফ্রেসকোর পাশাপাশি শেবেকে নকশার কাচের জানালা আছে সামনের দেয়ালজুড়ে।
পরের কক্ষ সাধারণ বসার ঘর। এই কামরাও হেলা করার নয়। মেঝের প্রতিটি কোনা থেকে ছাদ অবধি শুধুই ফ্রেসকো শিল্পের বাহার। আমি বিভিন্ন দেশে রাজপ্রাসাদের ফ্রেসকো দেখেছি; কিন্তু এই ফ্রেসকোগুলোতে আলাদা এক আভিজাত্য রয়েছে। যেমন অভিজাত এর বহিরাঙ্গের কারুকাজ, তেমনি অন্দরমহল।
শেকি খান প্যালেস নির্মাণ করেছিলেন খান রাজবংশের আমির মোহাম্মদ হুসেইন খান মুশতাক, ১৭৯৭ সালে। মূলত এটি ছিল খান রাজবংশের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ। আকার দেখে আমারও তা-ই মনে হয়েছে। প্রাসাদের ভেতরে রসুই বা অন্যান্য কক্ষ নেই। এ প্রাসাদের মূল কক্ষ মোহাম্মদ হুসেইন খান মুশতাকের নিজস্ব রুচিতে সব ধরনের কল্পনা ও বাস্তবতার তুলিতে আঁকা। ফুল-লতাপাতা, গুলদস্তার সঙ্গে ছাদের দিকের দেয়ালে যুদ্ধ ও শিকারের চিত্র আঁকা যা রাজার শৌর্যের প্রতীক। এক পাশে ড্রাগন মুখ থেকে আগুনের হলকার বদলে ফুল বর্ষণ করছে, যা আমিরের শক্তি, ক্ষমতা ও দয়ার প্রতীক। দেয়ালের বিভিন্ন জায়গায় ময়ূর আঁকা, যা সৌন্দর্যের সাক্ষ্য বহন করছে। দেয়ালের ওপরের চার কোনায় ড্রাগনের লেজবিশিষ্ট সিংহ এই বারতা দেয় যে, মানুষের অহংকার তার নিজের শত্রু। এ রকম একেক চিত্রের সঙ্গে একেক ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে। প্রাসাদের সবচেয়ে জৌলুশময় এ কক্ষের আগাগোড়া ফ্রেসকো করা, যার নকশা অন্য কক্ষকে ছাড়িয়ে গেছে।
আমার প্রাসাদ দেখা শেষ হলে সামনের বাগানে কিছুক্ষণ ঘুরেফিরে দেখি সাবরিনা বেরিয়েছেন প্রাসাদ থেকে। অবাক করার মতো বিষয় হলো, প্রাসাদের এক কক্ষে তিন-চারজনের বেশি কাউকে অবস্থান করতে দেওয়া হয় না। একসঙ্গে অনেক মানুষ ঢুকলে কেউই ঠিকমতো এর সৌন্দর্য ও ফ্রেসকোর অর্থ বুঝতে পারবেন না বলেই এ ব্যবস্থা। জায়গাটি আসলে ছিল দুর্গের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আমিরদের গ্রীষ্মকালীন এক নিরাপদ আবাসস্থল। প্রাসাদের অদূরে দেয়াল ঘেঁষে দুর্গ ও প্রাচীরের ভেতরে অন্যান্য স্থাপনা। প্রাসাদ প্রাঙ্গণের পরের ভবনটি ছিল রসুইঘর। একতলা বড় বড় পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি এই ঘর এখন তালাবদ্ধ। এর পর পর রয়েছে হস্তশিল্প ও কার্পেট বোনার কারখানা, হাসপাতাল এবং শেষ মাথায় দুর্গের দেয়াল লাগোয়া উঁচু গেট। গেটের বাইরে তখন দূরে ককেশিয়ান পর্বতমালার নিচে ডুবে থাকা অল্প কিছু বাড়ির ট্যালি দেওয়া ছাদ উঁকি দিচ্ছে। এ দেশে এত কম লোকের বসবাস যে, শহর ছেড়ে একটু দূরে গেলেই মনে হবে পাহাড়ের নির্জনতা ছাড়া আর কিছুই নেই।
দুর্গ গেট থেকে বের হয়ে শহরের সরু পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম আমি আর জাভোহির। পেছনে সাবরিনা আর তার দলবল। পথটি দেখতে একদম ইউরোপের কোনো গ্রামের রাস্তার মতো। দুপাশে অল্প কয়েকটি ট্যালি দেওয়া একতলা, দোতলা বাড়ি। বাড়ির সামনের বাগানে ফুটে আছে লাল ফুল। বাড়ির ছাদ সমান বড় বড় জানালায় কাঠের ফ্রেম। এসব ফ্রেম ভেদ করে ওপাশে কেউ কি নেই? কাউকেই তো দেখা যায় না; কিংবা বলা ভালো, দেখা দেন না কেউই!
আরেকটু এগোলে অল্প কয়েকটি স্যুভেনির শপ। হস্তশিল্প বলতে সিল্কের কাপড়, ফুলের চা, মধু, জাফরান আর বিখ্যাত বাকলাভা। আমি জানতাম তুর্কিরা বাকলাভা খাওয়ায় ওস্তাদ; কিন্তু তা যে আজারবাইজানে বিস্তৃত, জানা ছিল না। আসার পথে এক জায়গায় সাবরিনা গাড়ি থামিয়েছিলেন একটি বাকলাভার দোকানে। রংবেরঙের বাকলাভা দেখে মনে হলো, এগুলো তা হতেই পারে না; এগুলো তো নানা রঙের চকলেট! আর একেক বাকলাভা খেতেও একেক রকম। গোলাপি বাকলাভা খেতে হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো, সবুজটা পেস্তাবাদামের স্বাদের; নীল বাকলাভা খেলে মনে হবে মুখের ভেতর আকাশ গলে গলে যাচ্ছে! এরপর সাজানো ছিল সারি সারি নানা রঙের, নানা স্বাদের হাতে তৈরি চকলেট। দেখতে বাজারে কিনতে পাওয়া চকলেটের মতো নয়। আমার দুপুরের ভোজ চকলেট দিয়ে সারা হয়ে যাবে ভেবে আহ্লাদিত হলাম।
বিশাল দোকানের অন্য পাশে মাঝারি আকারের অনেকগুলো ব্যারেলে রাখা নানা ধরনের পাহাড়ি ফুলের মধু। একেক মধুর একেক রং, একেক স্বাদ। এই বিস্তৃত রঙের ভুবনে আরেক দফা রং ছড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফুল থেকে তৈরি চা। গাঁদা, গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, অপরাজিতা, জবা…আরও কত যে ফুলের চা কাচের বাক্সে সারি সারি লাল, বেগুনি, হলুদ, কমলা রং ছড়াচ্ছে! এত ধরন যে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। সবচেয়ে অবাক হলাম বিভিন্ন ধরন ও রঙের জাফরান দেখে। আমি জানতাম, জাফরান শুধু কমলা রঙেরই হয়। এখানে দেখি লাল, কমলা, হলুদ রঙের নানা পদের জাফরান কাচের বাক্সের জগৎ আলো করে হাসছে। পথেও নানা জায়গায় নানা বেশে, নানা রঙের চা দোকানে দোকানে কিংবা পথের ধারে বিক্রি হতে দেখেছি এ-যাত্রায়।
এখন যে দোকানে দাঁড়িয়ে রয়েছি, এখানকার চা ও মধু দেখে খুব একটা খুশি হলাম না। পথে-ঘাটে কত কিছু ছড়িয়ে আছে কুড়িয়ে নেওয়ার মতো! পাশের দোকানে বিক্রি হচ্ছে মধু মেশানো কেক আর এদেশীয় মিষ্টি। খেতে চিনি বেশি দেওয়া সুজির বরফির মতো। তার পাশের দোকানের সামনে দোকানে থাকা রঙিন সিল্কের স্কার্ফ, কাপড়ের ছোট ছোট পুতুল, কাঠের খেলনা, পুঁতির গয়না, হাতে বোনা রঙিন উলের মোজার সঙ্গে রং মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের একটি পুরোনো মডেলের গাড়ি। আনমনেই মনে হলো, অনেক রঙে ডোবানো রাজপ্রাসাদ দেখে এসে বাইরের জগতে তার আবেশ ছড়িয়ে মনে রং মিশিয়ে দেওয়ার পদ্ধতিও আজারবাইজানের মানুষ ঠিক জেনে নিয়েছেন। তাতে যেন ছড়িয়ে পড়েছে রূপকথার মহিমা।
ছবি: লেখক